প্রথমেই একটা ভূমিকা দিয়ে শুরু করি। যদিও ফোর-জি প্রযুক্তিটি এখনও ততটা স্ট্যান্ডার্ড হয়নি, তারপরেও বাংলাদেশে এটা নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। তার একটি বিশেষ কারণ হলো, সরকার একই সাথে থ্রি-জি এবং ফোর-জি লাইসেন্স দেয়ার কাজে হাতে দিয়েছে। বাংলাদেশের ইন্টারনেট মানেই হলো ওয়্যারলেস ইন্টারনেট। মোবাইল এবং ওয়াইম্যাক্স সার্ভিস প্রোভাইডাররা বাজারের সিংহভাগ দখল করে আছে। এদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ডাটা থেকে মোটামুটি অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে হয়তো ৮০ লক্ষ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। এবং তার ভেতর কয়েক লক্ষ ব্যবহারকারী ভালো ব্যবহারকারী। বাকিটা নাম মাত্র।
দেশে ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি আসাতে মোবাইল কোম্পানীগুলো তাদের হাই-স্পীড গ্রাহকদেরকে হারিয়ে ফেলেছে। এবং দেশের মানুষ কিছুটা হলেও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে যে, মোটামুটি দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ তো পাওয়া যাচ্ছে। এবং এতোদিন ধরে মানুষ আশায় বুক বেঁধে বসে ছিল যে, থ্রি-জি প্রযুক্তি এলে হয়তো দ্রুতগতির ইন্টারনেট আরো সহজলভ্য হবে। কিন্তু তার ভেতরই আবার ফোর-জি ঢুকিয়ে দেয়াতে দুটো বিষয় একত্রে আলোচিত হচ্ছে। এমন কেন করা হলো, কাদের স্বার্থ দেখা হলো - সেগুলো নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে, সন্দেহ রয়েছে। অপারেটররা চালাকি করে থ্রি-জি'র জন্য আলাদা লাইসেন্স ফি না দিয়ে একই খরচে ফোর-জি লাইসেন্স নিয়ে নিতে চাইছে, এমন একটা মতবাদ খুব শোনা যাচ্ছে। তবে, এগুলো শোনা কথাই। আসল বিষয়টি এখনও তেমন করে প্রকাশ পায়নি। হয়তো কিছুদিন পরেই বিষয়টি বুঝা যাবে।
তবে যেহেতু নিত্যদিনের আলোচনায় বিষয়টি চলে আসছে, তাই এটার উপর কিছু বেসিক তথ্য সন্নিবেশিত করা হলো। এর ফলে, যারা টুকটাক করে বিষয়টি জানতে চান, তাদের বিষয়টি খুঁজে পেতে সহজ হবে। যদিও বাংলাদেশে ফোর-জি এলটিই চালু হয়তো এখনও অনেক সময় বাকি, কিংবা হয়তো খুবই সীমিত আকারে ঢাকা শহরে চালু হবে, তবুও কেবলমাত্র প্রযুক্তিটি সম্পর্কে সাদামাটা জ্ঞান দেয়ার জন্য কয়েকটি আর্টিকেল কম্পাইল করার এই চেষ্টা। এটি একটি চলন্ত ডকুমেন্ট হবে। প্রাথমিক ধারনায় কিছু বাদ থেকে গেলে, সেগুলো ক্রমান্বয়ে আপডেট করা হবে।
কয়েকটা চ্যাপ্টার মিলে একটা অনলাইন বইয়ের মতো হবে এটি। আমি চেষ্টা করছি বিভিন্ন সোর্স থেকে বিষয়গুলো যোগাঢ় করে একটা জায়গায় নিয়ে আসতে, যেন মোটামুটি প্রযুক্তি-জ্ঞান সম্পন্ন মানুষও এটা ধরতে পারেন। হয়তো কিছুদিন পর বিস্তারিত বিষয়গুলো/চ্যাপ্টার যোগ করা যেতে পারে। এবং আপনাদেরকে অনুরোধ করবো, কোথায় কোথায় আর কি কি যোগ করা যেতে পারে, এবং কোথায় আরো সংশোধন করা যেতে পারে, সেগুলো আমাকে একটু ফিডব্যাক আকারে পাঠাতে। তাতে একটা সময় পর বিষয়টা অনেক পরিপক্ক হবে। বাংলা ভাষায় এই ধরনের সিরিয়াস টপিক নিয়ে ডকুমেন্ট খুব বেশি নেই। তাই আপনাদের সহযোগিতা সব সময়ই কাম্য। আমাদের কোনও পাঠক যদি কোনও চ্যাপ্টার/অনুচ্ছেদ লিখতে চান, তাহলে সরাসরি প্রিয় টেকে পোষ্ট করে দিতে পারেন। আমরা সেটাকে সাদরে সংযোজিত করবো।
প্রাথমিক ধারণা
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক, এলটিই আসলে কি?
খুব সাদামাটা ভাবে বললে, এলটিই (LTE - Long Term Evolution) হলো মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের ফোর-জি বা চতুর্থ প্রজন্মের একটি প্রযুক্তি। ইংরেজী এলটিই দিয়ে হয় - লং টার্ম ইভ্যুলুশন, এর পুরো নাম থ্রিজিপিপি লং টার্ম ইভ্যুলুশন (3GPP Long Term Evolution)।
অন্যান্য প্রযুক্তির মতো মোবাইল প্রযুক্তিটিও মূলত ড্রাইভ করে কোনও না কোনও আদর্শ মান। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সেই আদর্শমানটি ঠিক করে দেয়। এবং সেই অনুসারেই সবাই পণ্য উৎপাদন করে থাকে। নইলে একটার সাথে আরেকটা ঠিক মতো কাজ করবে না। এলটিই আদর্শ মানটি তৈরী করছে থ্রিজিপিপি বা "থার্ড জেনারেশন পার্টনারশীপ প্রজেক্ট" নামের একটি দল, যারা কাজ করছে "ইউনিভার্সেল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন্স সিস্টেম" (UMTS ইউএমটিএস)-এর জন্য। সেদিক থেকে এটার নাম হলো - থ্রিজিপিপি ইউএমটিএস এলটিই। অনেকগুলো টার্ম চলে এলো, তাই না? আবার এখানেও "থ্রিজিপিপি"-এর সাথে রয়েছে "থ্রিজি" শব্দটি। আমরা কথা বলছিলাম ফোর-জি নিয়ে, তাহলে আবার থ্রিজি এলো কিভাবে! এই ইউএমটিএস-ই জিএসএম নেটওয়ার্কের জন্য "থ্রি-জি" স্ট্যান্ডার্ড তৈরী করে দিয়েছিল; এবং এখন তারা কাজ করছে এলটিই'র জন্য। খুব টেকনিক্যাল মানুষ না হলে, এগুলো একটু তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে। তবে সাধারন মানুষের জন্য একটু বুঝলেই হবে যে, থ্রিজিপিপি নামের একটি দল এলটিই বিষয়টির আদর্শমান ঠিক করে দিচ্ছে। এবং আমরা তাকেই সংক্ষেপে এলটিই বলবো।
তবে এই এলটিই-এর বেলায় যে ঝামেলাটি হয়েছে তাহলো, এটার আদর্শমানটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এটা অনেকটা জীবন্ত স্ট্যান্ডার্ড বলা যেতে পারে। অর্থ্যাৎ আগামী আরো কয়েকটি বছর এটার পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন চলতে থাকবে। সেই হিসাবে এটা এখনও স্ট্যান্ডার্ড নয়।
ভেরাইজনের জন্য এলটিই স্মার্ট ফোন। ছবি: উইকিপিডিয়া
এখনও যা স্ট্যান্ডার্ড হয়নি, তাহলে এটা নিয়ে বাইরে এতো কথা হচ্ছে কেন! তার মূল কারণ হলো - ব্যবসা। মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো তো আর সেই স্ট্যান্ডার্ডের জন্য বসে থাকতে চাইছে না। বিশেষ করে আমেরিকার সবচে বড় মোবাইল অপারেটর ভেরাইজন এবং এটিএন্ডটি এই প্রযুক্তিটিকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারা নেটওয়ার্ক বসিয়ে ফেলে ট্রায়াল দিয়ে কিছু কিছু এলাকায় গ্রাহক সেবাও দিতে শুরু করে দিয়েছে। তারা জানে যে, পুরো নেটওয়ার্ক বসাতে অনেক সময় লাগবে; আর স্টান্ডার্ড হতেও সময় লাগবে। তাই মাঠে গিয়ে দেখা যাক, কিভাবে কাজ করে এই প্রযুক্তি। তারপর ধীরে ধীরে এর যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে সেটা করে নেয়া যাবে।
আর একবার যখন ভেরাইজন এবং এটিএন্ডটির মতো বিশাল অপারেটর বিনিয়োগ করতে চাইছে, সেখানে নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি এবং হ্যান্ডসেট তৈরীর কোম্পানীগুলো তো বসে থাকবে না। তারাও খেলতে নেমেছে সেই মাঠে। এবং ধীরে ধীরে বিশ্বের আরো কিছু দেশের অপারেটর ছোট ছোট করে ফোর-জি'র এই এলটিই নেটওয়ার্ক বসাতে শুরু করেছে। তবে, যেহেতু এটা খুবই আধুনিক একটি নেটওয়ার্ক, ওর মূল্যমান অনেক বেশি। অনেক বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে এই সেবা দেয়ার জন্য। উন্নত দেশগুলোতে গ্রাহকদের ক্রয় ক্ষমতা অনেক বেশি। তারা হয়তো সেটা অ্যাফোর্ড করতে পারবে - কিন্তু পৃথিবীর সকল অর্থনীতি হয়তো এখনও সেটা অ্যাফোর্ড করতে পারবে না। যেমন আফ্রিকার অনেক দেশ এখনও টু-জি মোবাইল ফোন অ্যাফোর্ড করতে পারছে না।
এলটিই খুবই ভালো একটি প্রযুক্তি - তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এটা দিয়ে খুব উচু গতিতে ডাটা আদান প্রদান করা যায়, এবং এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ডাটা প্যাকেট পাঠাতে সময়ও কম প্রয়োজন হয়। আবার এটা বসানোও অপেক্ষাকৃত সহজ। একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার হতে পারে। ভেরাইজনের একটি থ্রি-জি নেটওয়ার্কে ডাউনলোড গতি পাওয়া গিয়েছে ১.০৯ মেগাবিটস/সে. এবং আপলোড গতি হলো ০.৬৭ মেগাবিটস/সে.। সেই ভেরাইজন যখন এলটিই বসিয়েছে, সেখানে ডাউনলোড গতি পাওয়া গিয়েছে ১৫.৭৫ মেগাবিটস/সে. এবং আপলোড গতি পাওয়া গেছে ১.৪৯ মেগাবিটস/সে.। বুঝতেই পারছেন, দুটো নেটওয়ার্কের গতির পার্থক্য অনেক। তবে তাত্ত্বিকভাবে এর ডাউনলোড গতি হতে পারে ২৯৯.৬ মেগাবিটস/সে. এবং আপলোড হতে পারে ৭৫.৪ মেগাবিটস/সে.।
তবে এখানে একটি বিষয় না বললে অন্যায় হবে, তাহলো - যদিও আজকে ভেরাইজন, এটিএন্ডটি, জাপানের কেডিডিআই ইত্যাদি বড় বড় অপারেটর এলটিই নিয়ে লাফালাফি করলেও সর্বপ্রথম এলটিই কিন্তু বসিয়েছিল ইউরোপের টেলিয়া-সোনেরা। তারা সুইডেনের স্টকহোম এবং নরওয়ের ওসলোতে এলটিই বসিয়েছিল ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে।
(Collected)