টেলিফোন বিল বকেয়া রেখে কোনো এমপি মারা গেলে তা মাফ করে দেওয়ার বিধান আছে। ২০০৯ সালের ১৭ আগস্ট মন্ত্রীপরিষদের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক ৬৪ সাবেক এমপির এক কোটি এক লাখ চার হাজার ৪৩২ টাকার বিল মওকুফ করা হয়। এর পর থেকে টেলিফোনের বকেয়া বিলের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। এমপির মৃত্যুর পর বকেয়া বিল মওকুফও হতে থাকে।
অনেকে বলেছেন, ইচ্ছে করেই অনেক এমপি টেলিফোন বিল দেন না। মৃত্যুর পর বিল মওকুফ হয়ে যাবে। এটাই তাদের আকাঙ্ক্ষা। ফলে টেলিফোন বিল পরিশোধে অনেক এমপির অনীহা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার নীতিগত অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তাতে কোনো এমপি মারা গেলেও তার উত্তরাধিকারদের কাছ থেকে পাওনা আদায় করা হবে। এরই মধ্যে মৌখিকভাবে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে বিষয়টি আবারও মন্ত্রীপরিষদে পাঠাবে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কোনো নাগরিক বিল বাকি রেখে মারা গেলে কি সেটি মাফ করে দেওয়া হয়? যদি সেটি না হয়, তাহলে সাবেক এমপিদের বকেয়া টেলিফোন বিল কেন মাফ হবে? যেখানে
টেলিফোন বিল হিসেবে তারা মাসে মাসে টাকা পান, সেখানে তাদের বিল মাফ করা আইনের শাসনের পরিপন্থী। বিটিসিএলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মারা গেলেই মাফ এমন সিদ্ধান্তের কারণে যারা টাকা পরিশোধ করতে শুরু করেছিলেন, তাদেরও অনেকে বকেয়া বিল পরিশোধ করা বন্ধ করে দেন। এ ক্ষেত্রে বছরের পর বছর মামলা চললেও বকেয়া বিল আদায় হচ্ছে না। ২০০৯ সালের আগস্টে ১৩৫ জন সাবেক এমপির কাছে এক কোটি ৬০ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৭ টাকার টেলিফোন বিল বকেয়া ছিল। পরের দুই বছরের বেশি সময়ে মাত্র কয়েক লাখ টাকা আদায় হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ৬৪ সাবেক এমপির বকেয়া বিল মাফ করে দেওয়ার পর মারা যাওয়া আরও নয়জন সাবেক এমপির বকেয়া টেলিফোন বিলও মাফ করে দেয় বিটিসিএল বোর্ড। তাদের কাছে বিটিসিএলের পাওনা ছিল ১২ লাখ ৩৯ হাজার ২৯৭ টাকা। ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ৫৪তম বোর্ডের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। পরে মন্ত্রণালয়ও তা গ্রহণ করে।
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত টেলিফোন বিল বকেয়া রেখে আরও ১৩ সাবেক এমপির মৃত্যু হয়। এই ১৩ জনের কাছে বিটিসিএলের পাওনা রয়েছে ছয় লাখ ৯৬ হাজার ৫১৭ টাকা। এই টাকাও মাফ করা হবে কি-না, সে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আটকে যায় বিটিসিএল বোর্ড। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে মন্ত্রণালয় সে বিষয়ে আরও পর্যালোচনা করে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে পাঠায়। মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ বিষয়টি মন্ত্রীপরিষদের বৈঠকে উত্থাপনের জন্য বলেছে।
প্রথম দফায় যখন বিলখেলাপি মারা যাওয়া এমপিদের মাফ করা হয়, তখন তালিকায় সবচেয়ে বেশি ১১ লাখ সাড়ে ৩৫ হাজার টাকার খেলাপি বিল মাফ পান সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নামে যত টেলিফোন বিল বকেয়া হয়, পুরোটাই তার ব্যক্তিগত টেলিফোন। তখন পর্যন্ত এমপিরা নির্দিষ্ট একটি টেলিফোনে দেশের মধ্যে আনলিমিটেড বিল তোলার সুযোগ পেতেন। একটি ফোনে অসীম কথা বলার সুযোগ পেলেও অন্য টেলিফোনগুলোয় ১১ লাখ টাকার বেশি টেলিফোন বিল বাকি ফেলে দেন মিজানুর রহমান চৌধুরী।
সপ্তম সংসদের অ্যাডভোকেট আবদুল লতিফের বকেয়া হয় ১০ লাখ ৩৬ হাজার টাকার টেলিফোন বিল। মারা যাওয়ায় পুরো টাকাই মাফ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের মো. শহীদ উদ্দিন খানের ছয় লাখ ১৬ হাজার টাকার খেলাপি বিল মওকুফ করা হয়। পাঁচ লাখ তিন হাজার টাকা মাফ পেয়েছেন দিনাজপুরের রেজাউল হক চৌধুরী।
এদিকে মারা যাওয়া এমপিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর (অব.) বজলুল হুদার নামও রয়েছে। বিচারের পর তার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে। তার দুটি টেলিফোন নম্বরের (৩২৮১২০ এবং ৮১২২২৯) বিপরীতে বিটিসিএলের পাওনা ৪৯ হাজার ১৪৮ টাকা। এই টাকা মাফ করা হবে কি-না, সে বিষয়েও এসেছে আরেক প্রশ্ন। এই প্রশ্নও মন্ত্রীসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া যারা বিলখেলাপি হয়ে মারা গেছেন, তাদের মধ্যে চতুর্থ সংসদের ইব্রাহিম বিন খলিলের কাছে পাওনা তিন লাখ ৮৯ হাজার ৩৪৫ টাকা। একই সংসদের মমতা ওহাবের বকেয়া এক লাখ ৬১ হাজার ৪০৯ টাকা। আবদুল বাকেরের বকেয়া এক লাখ ১০ হাজার ১৭০ টাকা। যশোর-২ আসনের মীর শাহাদাতুর রহমান ৬৮ হাজার ৮৫৬ টাকা বকেয়া রেখে মারা গেছেন। পঞ্চম সংসদে বগুড়া-৪ আসনের আজিজুল হক মোল্লা (৬৫ হাজার ৭৮৫ টাকা), সপ্তম সংসদের আবদুল লতিফ মির্জাও (৫৯ হাজার ৩৫৮ টাকা) টেলিফোন বিল বকেয়া রেখে মারা গেছেন।
বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সময় এলেই কেবল এমপিরা বকেয়া বিলের খোঁজ নেন। না হলে তেমন কোনো প্রাপ্তি হয় না। গত নির্বাচনের আগেও এভাবে বিটিসিএলের অনেক টাকা আদায় হয়েছে।
এদিকে সংসদ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে একজন এমপি টেলিফোন বিল হিসেবে মাসে সাত হাজার ৮০০ টাকা পান। এর আগে অষ্টম সংসদে এই বিল ছিল ছয় হাজার টাকা। তার আগে সপ্তম সংসদে ছিল সাড়ে চার হাজার টাকা। এর আগ পর্যন্ত নির্দিষ্ট একটি টেলিফোনের (আইএসডি ছাড়া) কোনো বিলই আসত না। ওই একটি টেলিফোন ছাড়া আরও অনেক ব্যক্তিগত টেলিফোনে লাখ লাখ টাকা বাকি ফেলে দেন এমপিরা। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে সপ্তম সংসদে একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপিদের বিলের অর্ধেকটা মাফ করে দেন। তখন বলা হয়, বিলের অর্ধেক দিলেই বাকিটা মাফ করে দেওয়া হবে। অনেকেই এ সুযোগ নেন।
সৌজন্যে: সমকাল