সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহাম ক্লিনটনের জন্ম ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটিতে ১২ জুন ২০১২ তিনি এই বক্তব্য দেন।
শুভ অপরাহ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হয়তো আয়ারল্যান্ডে এটাই আমার শেষ সফর।
আজ আমি মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামের চারটি সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে কথা বলব। প্রথমেই আসে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের অধিকারের বিষয়টি। গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী যেখানে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এমন অস্থির ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ সময়ে অনেক স্থানেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পুরোনো শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর লক্ষ্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। এতে শুধু নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর জন্যই বিপদ নেমে আসছে তা নয়, বরং গোটা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সামাজিক কাঠামো তখনই শক্তিশালী বলে গণ্য হয়, যখন তা শুধু সবলের অধিকার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট না হয়ে দুর্বলের জন্যও সমান সুযোগ সৃষ্টি করে।
বছর দুয়েক আগে মিশরের কায়রোর রাস্তায় তরুণেরা সত্যিকারের পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের অধিকার আছে স্বচ্ছ, উদারমনা, পক্ষপাতহীন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা পাওয়ার। মিসরের পরিস্থিতি আমাদের কাছে এটাই প্রমাণ করে যে সময় এসেছে আলোচনার মাধ্যমে রক্তপাতহীন, শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করার।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ইন্টারনেটে তথ্য পাওয়ার স্বাধীনতা। ১০ বছর আগে হলে আমি হয়তো একে প্রথম চারটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করতাম না, কিন্তু এই এক দশকে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। চীন, রাশিয়া থেকে শুরু করে ভারত, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া—এই দেশগুলোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের ভবিষ্যৎ। রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেমন খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশদূষণ ও দুর্নীতি নিয়ে জনগণের হাজার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। অনেক আগে আমি যখন প্রথম রাজনীতিতে জড়িত হই, তখনই শিখেছিলাম যে সমালোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়, তবে কখনোই ব্যক্তিগতভাবে নয়। আমাদের জানতে হবে সমালোচনা থেকে কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। অবশ্যই সব সমালোচনা যৌক্তিক হয় না, সঠিকও হয় না। কিন্তু সমালোচকেরা অনেক সময় আমাদের সবচেয়ে দরকারি বন্ধুর ভূমিকা পালন করে।
আর এ ক্ষেত্রেই ইন্টারনেটে তথ্যের অবাধ প্রবাহ দরকার, কারণ আজকের দিনে ইন্টারনেটেই অগণিত আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ২১ শতকের সর্বজনীন প্ল্যাটফর্ম বলতে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা ইন্টারনেট ছাড়া আর কিছু নয়। মত প্রকাশের অধিকার একটি সর্বজনীন ব্যাপার, তা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আড্ডায় বসে হোক, আর ফেসবুক পেজে হোক। স্বাধীনতা সব ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয় ইস্যুটি হলো সুশীল সমাজের ভূমিকা। সমাজের সেই সব মানুষ, যাঁরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন এবং সরকারকে সঠিক দিকে পরিচালিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা প্রতিটি দেশেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেসব দেশে অস্থিরতা বিদ্যমান, জনগণের ভবিষ্যৎ যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে সুশীল সমাজের সক্রিয় কার্যক্রম এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এটা সত্যি যে রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে থেকে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা কিংবা অবকাঠামোগত সংস্কার করার সুযোগ অনেকাংশে সীমিত। অনেকে ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েও নাগরিকদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করেন। আন্দোলনকারী ও সাংবাদিকেরা অনেক সময় হুমকির মুখে পড়েন, জেল-জরিমানা সহ্য করেন, কখনো কখনো জীবননাশের আশঙ্কাও থাকে। তবুও, সুশীল সমাজ সব সময়ই নিপীড়নকারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে। সুশীল সমাজ নাগরিকদের মধ্যে এই বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে যে জনগণ সরকারের জন্য নয়, সরকার জনগণের জন্য। এটি জনগণকে অধিকার আদায়ে একত্র করে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো নারী অধিকার। একে গত শতকের ফেলে রাখা কাজ বললে অত্যুক্তি হবে না। দেশের অর্ধেক জনগণকে অবজ্ঞা করে বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো গণ্য করে সবল অর্থনীতি কিংবা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাটাও বোকামি। কিন্তু অনেক দেশে এটাই বাস্তবতা, এমনটাই ঘটে চলছে নারীদের সঙ্গে। তাদের রাজনৈতিক অধিকার নেই বললেই চলে, তারা ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা নেই, বেঁচে থাকাই যেন তাদের জন্য বড় পাওয়া। অনেক মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা খেলার পুতুল কিংবা পণ্য, মানুষ নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চিত যে নারীদের যদি সমান অধিকার ও সম্মান দেওয়া হতো, তাহলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হতো। শুধু নির্যাতনের ঘটনা কমে আসত না, সঙ্গে সঙ্গে সরকারব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হতো।
আমি নিজে একজন মেয়ের মা এবং নারী-পুরুষ সম-অধিকার ও সমান সুযোগে বিশ্বাসী একজন মানুষ। আমি অত্যন্ত দুঃখবোধ করি, যখন আমি কোথাও যাই এবং পুরুষ নেতারা আমাকে আলাদা করে দেখে কিংবা আমাকে গুরুত্ব দেয় এই কারণে যে আমি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হয়তো সেদিন খুব দূরে নয়, যখন কন্যাসন্তানেরা পুত্রসন্তানের মতো যত্ন পাবে, মেয়েরা ছেলেদের সমান পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে, নারীরা পুরুষদের মতো পরিবার ও সমাজে নিজেদের অবদান রাখতে পারবে।
আমি যেসব অধিকারের কথা তুলে ধরলাম, সেসব আদায় করা সহজ নয়। আমাদের লেগে থাকতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে, প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে। এ কাজগুলোর জন্য তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। তোমাদের সব আছে— প্রতিবাদী কণ্ঠ, ভোট দেওয়ার অধিকার, শিক্ষা, বুদ্ধি ও বিবেচনা। এ সংগ্রামের নেতৃত্ব তোমাদেরই দিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা এক ছোট্ট মেয়ে হিসেবে আমি যে স্বপ্ন দেখতাম, আমি তারচেয়ে অনেক বেশি পথ পাড়ি দিয়েছি, অনেক বেশি দেশ ঘুরেছি, অনেক কিছু দেখেছি। এসব দেখে আমি বুঝেছি যে পৃথিবীজুড়ে মানুষের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। আমি বিশ্বাস করি, এই চেতনা তোমাদের জীবনে পাথেয় হয়ে থাকবে, সামনের দিনগুলোতে আশার আলো জোগাবে।
সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।
courtesy: Prothom-alo