আমেরিকায় পিএইচডি অধ্যয়নরত এক বাংলাদেশী আপু জানাচ্ছিলেন সে দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট। অনেক আমেরিকান নারীদের সাথে কথা বলে দেখা গেছে তারা পরিবারে নিগৃহিত হচ্ছেন। উন্নত দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে পরিবারে যথার্থ মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। সে দেশের পরিবারগুলোতে নারী এবং শিশুদের সমপর্যায়ে দেখা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত গৃহকর্ম কেবল নারীদের বলে ভাবা হচ্ছে, খুব কম পুরুষই গৃহকর্মে তাদের স্ত্রীদের কাজে সহায়তা করেন। এই গৃহকর্মের সুত্র ধরেই অনেক পরিবারে ভাঙ্গন ধরছে। এছাড়াও পারিবারিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতেও পরিবারের নারীদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে বা তাদের মতামত নেয়াই হচ্ছে না। এমনকি নারীদের গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনাও ঘটে চলেছে। পশ্চিমা বিশ্বে পুরুষের এই রাগের মাথায় স্ত্রী গায়ে হাত তোলার পিছনে কারণ হিসেবে মদ দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বেও এ ধরণের ঘটছে, অথচ এসব দেশে মদের প্রকোপ অনেক কম! এর পিছনে কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে আমাদের মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে শেকড় গেঁড়ে বসতে পারেনি। এখনো মজ্জাগতভাবে এ অঞ্চলে একনায়কতন্ত্রের কদর বেশি। এর প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিপর্যায়েও। মানুষের এই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের ফলেই সে তার ঘরের নারীদের মতামতের মুল্য দেয় না, এমনকি গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না।
এই যে নারীদের শিশুর সমতুল্য ভাবা হয় তার আবেগপ্রবণতা বা যুক্তির ধার কম ভেবে বা কম বিচক্ষণ ভেবে এটা ঠিক নয়। নারীকে পুরুষের সমতুল্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অনেকেই ইসলামের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন কুরআনেই নাকি নারীদের মর্যাদা পুরুষের অর্ধেক করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে কোরআনের আয়াতসমুহকে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করেন। তারা পুরুষের প্রতি যে পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব ন্যস্ত করা আছে সেদিকটা আর উল্লেখ করেন না। আবার সূরা নিসার এই ৩৪ নং আয়াতের কথা উল্লেখ করে বলেন যে পুরুষকে পরিবারের স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে তাকে পরিবারের প্রধান করা হয়েছে, স্ত্রীর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাই পুরুষের কথা মেনেই নারীকে চলতে হবে। আবার অবাধ্য স্ত্রীকে প্রহার করার কথাও কোরআনে বলা আছে। অথচ রাসূল(সাঃ ) নিজেই কোনদিন উনার স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলেননি। যখন তার স্ত্রীরা অপর্যাপ্ত ভরণপোষণ নিয়ে রাসূল(সাঃ ) এর সাথে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়েছিলেন, আল্লাহর তরফ থেকে তাদেরকে সম্মানের সাথে ডিভোর্স দেবার কথা বলা হয়েছিল (সূরা আহযাব, ২৮ নং আয়াত)। আর রাসূল (সাঃ ) নিজে ধর্মপ্রচারসহ রাষ্ট্রীয় নানান কাজে ব্যস্ত থাকার পরেও ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। এছাড়াও একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কখনোই তার অধিনস্তদের গায়ে হাত তোলেন না, কর্মচারীরা যতই ভুল করুক না কেন, বড়জোর তাদেরকে চাকুরি থেকে ছাঁটাই করেন।
নারী পুরুষের সমান মর্যাদার প্রমাণস্বরূপ কোরআনে বেশ কিছু আয়াতই আছে। এছাড়াও কোরআনের আয়াতগুলো বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপন করা ঠিক নয়। একই বিষয়ের সবকটি আয়াতকে বিবেচনা করেই কোন একটা ইস্যুতে উপসংহারে আসা উচিত। সূরা বাকারার ৪৭ নং আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেছেন, “আমি বনী আদমকে সম্মানিত করেছি।” এখানে নারীপুরুষ উভয়ের কথাই বলা হয়েছে। এছাড়া ইসলামী শরিয়তের প্রথম অধ্যায়েই বলা হয়েছে, এই শরিয়ত মানার বাধ্যবাধকতা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষের (মুকাল্লাফ), পাগল এবং শিশু ব্যতীত। শরিয়তে নামায না পড়ার শাস্তির বিধান নারীপুরুষ উভয়ের জন্য সমান। চুরির দায়ে হাত কাটার শাস্তিও নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। পুরুষকে আর্থিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে নামায বা চুরির ক্ষেত্রে শাস্তি কম-বেশি করা হয়নি। তাই কেবল সামাজিক রীতি নীতির কাছে নতি স্বীকার করে নারীকে অবহেলা করার বা অমর্যাদা করার কোন সুযোগ নেই। আর কিভাবে নারীদের ব্যাপারে পুরুষের এই মনোভাব বদলানো যাবে সেটা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের জুম্মার খুতবাগুলোতে নারীদের প্রহারের বিরুদ্ধে বেশি করে করে বলতে হবে। ইমামদের যখন ট্রেনিং দেয়া হয় উনাদেরকে ভাল করে বলে দিতে হবে, সচেতন করে দিতে হবে যাতে করে সবাই নিজ নিজ কর্মস্থল মসজিদে এবং মসজিদসংলগ্ন এলাকাতে এই কথাগুলো বেশি বেশি করে প্রচার করেন।
আর পরিবারগুলোতে স্ত্রীকে সম্মান করার ব্যাপারে যে ইসলামে কোন বাঁধা নেই সেটা আমরা উপরের আলোচনাতেই দেখলাম। পরিবারের সব বিষয়ে স্ত্রীর মতামত নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই পরিবারে নারীদের মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব।
সূত্রঃ সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ভাবনা – জনাব শাহ আবদুল হান্নান