পপগায়িকা শাকিরার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। শুধু সংগীতশিল্পী হিসেবেই নন, গানের সঙ্গে নাচের উপস্থাপন তাঁর খ্যাতি বাড়িয়েছে বহু গুণে। জগদ্বিখ্যাত এই গায়িকা ১৯৭৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কলম্বিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এই বক্তব্য দেন।
সবাইকে ধন্যবাদ এই অসাধারণ, উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য। আমি ১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা চুকিয়ে ফেলি। তারপর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ওপর একটি কোর্স করা ছাড়া আর কখনো ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ানো হয়নি। তাই আজ হার্ভার্ডের সীমানায় পা রেখেই মাকে ফোন করলাম, ‘আমি হার্ভার্ডে এসেছি মা!’ মাত্র এক দিনের জন্য, তা-ই বা কম কী!
আমার জন্ম হয়েছে উন্নয়নশীল একটি দেশে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, লাখ লাখ শিশু তাদের শৈশব পার হতে না-হতেই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে যায় আর বাকি জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দেয়। আমি যখন দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় বেড়ে উঠছিলাম, তখন এ সবকিছুই আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি ধরে নিয়েছিলাম—যা কি না সমগ্র উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের ধারণা, যদি কেউ গরিব হয়ে জন্ম নেয়, তবে তাকে গরিব হয়েই মরতে হবে।
আমার চোখে স্পষ্ট ভেসে ওঠে কলম্বিয়ার বারানকিইয়ায় বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা। আমি অসম্ভব মেধাবী ও প্রতিভাবান অনেক শিশু-কিশোরকে দেখেছি। কিন্তু তারা থাকত রাস্তায়, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো আশা ছিল না। আসলে, তাদের জীবনে ভবিষ্যৎ বলে আদৌ কিছু ছিল না! ছোটবেলায় এসব দেখে আমার যত না মন খারাপের হতো, তার চেয়েও বেশি হতো রাগ। পরে বুঝতে পেরেছি, এসব সমস্যার সমাধান আছে। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে চেষ্টা করলে ভাগ্য বদলানো সম্ভব। পৃথিবীজুড়ে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন হবে, বিশেষত রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করা ও সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজানো। কিন্তু তা অসম্ভব নয়।
এসো, সাহসে বুক বেঁধে এগিয়ে যাই। আমাদের আইডিয়া আছে, বুদ্ধি আছে, জনবল আছে। সরকারের সম্পদ আছে আর তরুণদের উদ্দীপনা আছে। আমরাই পারব।
আমরা যদি পৃথিবীকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাই, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। ২০ কোটির বেশি শিশু আজও শিক্ষার আওতার বাইরে। এর পরিণাম ক্ষুধা, সহিংসতা, বৈষম্য, যুদ্ধ। কেবল শিক্ষাই এসব থেকে মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। বিশ্বজুড়ে শান্তি স্থাপনের জন্য এটিই সবচেয়ে ভালো কৌশল। আমরা তাহলে বসে আছি কেন?
২০ কোটি শিশুকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার অর্থ ২০ কোটি মানুষকে তাদের পূর্ণ প্রতিভায় বিকশিত হওয়ার পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া। এই শিশুরা আগামী দিনের বিজ্ঞানী হতে পারত, শিক্ষক হতে পারত, শিল্পী হতে পারত, চিকিৎসক হয়ে লাখো মানুষের সেবা করতে পারত। হয়তো পৃথিবীটাকেই বদলে দিত এই শিশুরা। আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে আজকের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পেয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবীর বড় বড় আবিষ্কার আর উন্নয়নের নেতৃত্ব দেবে, গোটা পৃথিবীটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আমি মানবতায় বিশ্বাস করি। মানুষের অসীম সামর্থ্যে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সম্ভাবনার খুব সামান্যই আমরা কাজে লাগাই। এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে।
তবে সবকিছু সরকারের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। প্রতিদিন যেখানে অসংখ্য শিশু ঝরে যাচ্ছে, সেখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নষ্ট করার মতো এক মুহূর্ত সময়ও আমাদের হাতে নেই। লাখ লাখ শিশু সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, তাদের প্রতিভা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই। তাই এর প্র্রতিকারে সমাজের সবাইকে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, শিক্ষা নিয়ে আমার এত উৎসাহের কারণ কী? আমি খুব ভালো করে জানি, শিক্ষায় অল্প একটু বিনিয়োগ কীভাবে একজনের জীবনকে আমূল বদলে দিতে পারে। ১৮ বছর বয়সে আমি কলম্বিয়ায় ‘বেয়ারফুট’ নামে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুলি। ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা সেখানে কাজ করছি। অসম্ভব দরিদ্র, সহিংসতায় পরিপূর্ণ কিছু এলাকায় আমরা স্কুল চালু করছি, ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে কাজ করছি। আমাদের প্রতিষ্ঠিত আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ছয়টি স্কুলের মাধ্যমে ৩০ হাজার পরিবারকে সহায়তা দিচ্ছি, তাদের শিশুদের লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিচ্ছি। আমাদের স্কুলগুলোর মোট ছয় হাজার শিক্ষার্থীকে পুষ্টিকর খাবার দিচ্ছি। এটি এমন একটি মডেল, যেখানে স্কুল হয়ে উঠেছে একটি এলাকার প্রাণকেন্দ্র।
এই উদ্যোগ থেকে আমি শিক্ষা পেয়েছি দিনে মাত্র দুই ডলার কীভাবে একটি শিশুর জীবন বদলে দিতে পারে। যেসব শিশুর হয়তো এত দিনে জঙ্গি দলে যোগ দিতে হতো, তারা আজ স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। আমাদের বুক গর্বে ভরে ওঠে যখন শুনি আমাদের স্কুলেরই কোনো শিক্ষার্থী দেশের মধ্যে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পায়। কয়েক বছর আগে এমন কিছু চিন্তাও করা যেত না। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জেনেছি, চাইলে পরিবর্তন সম্ভব। এ আমার নিজের চোখে দেখা, আমি জানি এটি সম্ভব। আমরা সরকারের সঙ্গেও কাজ করি। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমি বুঝেছি বেসরকারি উদ্যোগ কত গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি উদ্যোগে যখন স্কুলের কাজ শুরু হয়, তখন সরকারকে বাধ্য হয়েই এগিয়ে আসতে হয়। তাই সাধারণ নাগরিকেরা যদি এগিয়ে আসে, তাহলেই রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করা সম্ভব।
আমরা যদি নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করি, তাহলে তারা আরও উদ্যমী, উদ্যোগী হয়ে উঠবে।
পৃথিবীটা এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে, এখন আমরা সবাই একই সমাজের সদস্য। বাংলাদেশ কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশে যদি একটি শিশুও পেটে খিদে নিয়ে ঘুমাতে যায়, যুক্তরাষ্ট্রে যদি কোনো অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান স্কুলে যেতে না পারে, তবে সে দায়ভার আমাদের সবার।
বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করাই হলো পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। পরিবর্তন তোমাদের হাত ধরেই আসবে। পৃথিবীর সামনে নিজেদের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করো। সমাজব্যবস্থাকে নতুন করে গড়ে তোলো।
মনে রেখো, সময় এখন তোমাদেরই।
সূত্র: ওয়েবসাইট।