কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা

Author Topic: কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা  (Read 2950 times)

Offline Md. Zakaria Khan

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 376
  • active
    • View Profile
কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা

কুরবুন বা কোরবানি অর্থ আত্মত্যাগ, উৎসর্গ বা বিসর্জন ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর নামে কোনো কিছু উৎসর্গ করার নাম কোরবানি। প্রচলিত অর্থে কোরবানি হলো পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নির্দিষ্ট জানোয়ার জবেহ করা। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির ওপর কোরবানির নিয়ম করেছি যাতে তারা চুতষ্পদ জন্তু জবেহ করে এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হাজ,আয়াত-৩৪)।
‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো।’ (সূরা কাওসার, আয়াত-২)।
কোরবানির ইতিহাসঃ কোরবানির বিষয়টি মানব ইতিহাসের মতো অতি প্রাচীন। হজরত আদম আঃএর পুত্রদ্বয় হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোরবানির সূচনা হয়। সে সময় কোরবানির নিয়ম ছিল অন্য রকম। ভেড়া, দুম্বা,শস্য বা গম ইত্যাদি কোরবানির জন্য আল্লাহর দরকারে পেশ করা হতো। যার কোরবানি কবুল হতো আল্লাহর হুকুমে আকাশ হতে আগুন এসে তা ভস্মীভূত করে দিতো। আর যারটা কবুল হতো না তারটা পড়ে থাকত। হজরত নূহ আঃ, হজরত ইয়াকুব আঃ, হজরত মূসা আঃ-এর সময়েও কোরবানির প্রচলন ছিল। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম জাতির জনক হজরত ইব্রাহিম আঃ আল্লাহর প্রেমে প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় সোনালি ইতিহাস সৃষ্টি করে গিয়েছেন।
হজরত ইব্রাহিম আঃ-এর প্রিয় বস্তু কোরবানিঃ হজরত ইব্রাহিম আঃ স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দেয়ার জন্য আদিষ্ট হন। এ জন্য তিনি তিন দিনে শত শত উট কোরবানি করলেন কিন্তু তা আল্লাহর দরবারে কবুল হলো না। বারবারই স্বপ্নযোগে আদেশ করা হলো, ‘তোমার প্রিয়বস্তু কোরবানি করো।’ হজরত ইব্রাহিম আঃ বুঝতে পারলেন, বৃদ্ধ বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান এবং হজরত হাজেরার নির্বাসিত হয়ে বহু কষ্টে লালিত নয়নের মণি হজরত ইসমাইল আঃ সেই প্রিয় বস্তু।
আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে হজরত ইব্রাহিম আঃ ও মা হাজেরা কোরবানির জন্য কলিজার টুকরা পুত্রকে সাজিয়ে নিলেন। কিশোর ইসমাইল আঃ নিজের জানকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। পবিত্র কুরআনে ওই বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। ‘হজরত ইব্রাহিম আঃ বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে,আমি তোমাকে জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী, বলো? তিনি বললেন, আব্বাজান! আপনি যে বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে আদিষ্ট হয়েছেন, তা পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবনে। যখন তারা উভয়ে আত্মসমর্পণ করলেন এবং পিতা কাত করে পুত্রকে শোয়ালেন, তখন আমি তাকে ডাকলাম, হে ইব্রাহিম! নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্নকে সত্য পরিণত করে দেখিয়েছেন। আমি বিশিষ্ট বান্দাদের এরূপ পুরস্কার প্রদান করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল বড় পরীক্ষা। আর ইসমাইল আঃ-এর পরিবর্তে একটি শ্রেষ্ঠ জবেহর পশু দান করলাম।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২ থেকে ১০৭)।
আল্লাহু আকবার তাকবিরঃ হজরত ইব্রাহিম আঃ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কলিজার টুকরা পুত্রের গলায় যখন ছুরি চালান, তখন হজরত জিব্রাইল আঃ আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে একটা দুম্বা নিয়ে রওনা হলেন। তাঁর মনে ভয় ছিল না জানি পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই ইব্রাহিম আঃ জবেহ কাজ শেষ করে দেন! আর এ জন্যই জিব্রাইল আঃ আকাশ থেকে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন ‘আল্লাহু আকবার’। এমন মধুর ধ্বনি শুনে হজরত ইব্রাহিম আঃ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। হজরত ইসমাইল আঃ পিতার মুখে তাওহিদের বাণী শুনতে পেয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ হজরত জিব্রাইল আঃ এবং দুই নবীর কালামগুলো আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত ঈদুল আজহার দিনগুলোতে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে ওই কালামগুলো উচ্চারিত হতে থাকবে।
সুন্নতে ইব্রাহিমঃ আল্লাহর প্রেমিক হজরত ইব্রাহিম আঃ এর ধারালো ছুরি হজরত ইসমাইল আঃ-এর একটি পশমও কাটতে পারেনি। তার পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে জিব্রাইল আঃ বেহেশত থেকে জান্নাতি দুম্বা এনে দিলে তিনি তা কোরবানি করেন। হজরত ইব্রাহিম আঃ প্রাণ প্রিয় পুত্রকে কোরবানি দেয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর প্রেমের গভীরতা কত তাই প্রমাণ করেছেন। তাই অনন্তকাল ধরে কোরবানির এ মডেল সুন্নতে ইব্রাহিম হিসেবে বিশ্বের সব মুসলমানের কাছে আজ স্মরণীয়, বরণীয় এবং অবশ্য পালনীয় হয়ে আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
কোরবানি কার ওপর ওয়াজিবঃ যার ওপর ফিতরা ওয়াজিব তার ওপর কোরবানিও ওয়াজিব। বালেগ জ্ঞানবান, নিজ বাড়িতে অবস্থানকারী ব্যক্তির স্বাভাবিক সাংসারিক প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ছাড়া ঈদুল আজহার দিনে নিসাব পরিমাণ মাল থাকলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কমেরপক্ষে একটি বকরি, ভেড়া বা দুম্বা কোরবানি করতে হবে। আর যদি গরু/মহিষ/উট কোরবানি করে তবে তা উত্তম অথবা প্রতিটি গরু/মহিষ/উটে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারেন।
কোরবানির পশুঃ পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া জরুরি। কানা, খোঁড়া, রোগা, জীর্ণশীর্ণ, অর্ধেক কান কাটা বা ছিদ্র করা, অর্ধেক শিং ভাঙা, অর্ধেক লেজ কাটা পশু দিয়ে কোরবানি করা যাবে না। (মিশকাত)। কোরবানি করার সময় তকবির বলা চাই। কোরবানির সম্পূর্ণ দোয়া পড়া মুস্তাহাব। কোরবানির পশু আট প্রকার, যথা ভেড়া বা দুম্বা, ছাগল,গরু, উট এই প্রতিটির নর ও মাদি এ হিসেবে আট প্রকার (সূরা- আনআম)।
কোরবানির উদ্দেশ্যঃ কোরবানির মুখ্য উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়ার মাধ্যমেই আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলো, আমার সালাত, আমার হজ ও কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে।’ (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)। কোরবানি আমাদের শিক্ষা দেয় আল্লাহর প্রেমে পূর্ণ তাকওয়া (আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা) নিয়ে কোরবানি করতে হবে, লোকদেখানোর জন্য নয়। জিলহজ মাসের দশ, এগারো, বারো তারিখ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এ কোরবানির উৎসব বা ঈদুল আজহা শুধু প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্র নয়, এর প্রকৃত রূপ হলো মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর নামে উৎসর্গ করা। o Sacrifice to make offerings to Allah. আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছায় না। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহকে রাজি-খুশি করা, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই হলো মুখ্য উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেন, আমার কাছে এগুলোর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সূরা হাজ, আয়াত-৩৭)।
কোরবানির ফজিলত ও গুরুত্বঃ কোরবানির দিন কোরবানি করাই আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। কোরবানির পশুর রক্ত ভূমিতে পতিত হওয়ার আগেই আল্লাহতায়ালার দরবারে কবুল হয়ে যায়। রাসূলে করিম সাঃ বলেছেন, কোরবানির পশুর যত পশম থাকে তার পরিবর্তে ৩৩টি পুণ্য লেখা হয়ে থাকে। হজরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে।
কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘যে ব্যক্তির সামর্থøথাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’ (ইবনে মাজাহ)।
কোরবানি কবুল হওয়ার শর্তঃ আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন হালাল উপার্জন, ইখলাছ ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার অপরিহার্য শর্ত। কে কত টাকা খরচ করে পশু ক্রয় করল, কার পশুটি কত মোটাতাজা বা সুন্দর,আল্লাহ তা দেখেন না। তিনি দেখেন কার নিয়ত সহি এবং অন্তরে কতটুকু তাকওয়া বা পরহেজগারি আছে।
কোরবানির গোশত ও চামড়াঃ কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, একভাগ আত্মীয়স্বজনের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া মুস্তাহাব। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরিব-দুঃখীদের দান করে দিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তরা, দীন-দুঃখীরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষে কেবল ভোগ নয়,ত্যাগ-তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত ও চামড়ার টাকা বিলিয়ে দিতে হবে। কোরবানির নির্দেশ মোতাবেক কোরবানি করে গোশত ও চামড়ার টাকা গরিব, নিঃস্ব, দীন-দুঃখীদের দেয়া মানে আল্লাহর নামেই উৎসর্গ করা।
কোরবানির মহান শিক্ষাঃ মানবজীবনে কোরবানির মূল শিক্ষা সমাজের অভাবগ্রস্তদের সাহায্য-সহায়তাদান, সহমর্মিতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সৌহার্দø প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর রাস্তায় মানুষের আপন সম্পদ উৎসর্গ করা। যিনি যত পরিমাণ সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবেন তিনি আল্লাহর তত নৈকট্য লাভ করবেন। কোরবানির ত্যাগ বা উৎসর্গ একটি বড় ইবাদত।
প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যরূপী আমাদের ভেতরের পশু তথা নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতাকে অর্থাৎ অন্তরের মধ্যে বসবাসকারী পশুকে জবাই করা এবং হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অহঙ্কার, প্রভাব-প্রতিপত্তি বিসর্জন দিয়ে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বোধে উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষাই কোরবানির মহান শিক্ষা। ফলে আত্মশুদ্ধি ঘটবে, মনের তাকওয়া অর্জিত হবে। আল্লাহর প্রেম শুধু কোরবানির দিনে সীমাবদ্ধ না রেখে সে প্রেম ভালোবাসা তাঁর সৃষ্টির জন্য আজীবন অব্যাহত রাখতে হবে এবং সর্বক্ষণ মনে জাগ্রত রাখতে হবে কোরবানির মহান শিক্ষাকে। তা হলেই আমাদের পৃথিবী হবে সুন্দর, শান্তিময় ও নিরাপদ।