দাঁত তোলা যখন বিপজ্জনক
চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক ধারণায় দাঁত তোলা একটি দুর্ভাগ্যজনক এবং ধ্বংসাত্মক চিকিৎসা পদ্ধতি। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞানের বাস্তবিক প্রয়োগ এতটাই অগ্রসরমান যে, দাঁতের ফিলিং, রুটক্যানাল, পাল্প ক্যাপি, পাল্পোটমি, এপেক্সিফিকেশন, এপেক্সোজেনেসিস ইত্যাদি আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে দাঁত তোলার প্রয়োজন হয় না। তথাপি ক্ষেত্রবিশেষে রোগাক্রান্ত দাঁত চিকিৎসার প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণেও দাঁত তোলার প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে দাঁত তোলাকে যত হালকা করেই দেখা হোক না কেন মনে রাখতে হবে, এটি একটি অপারেশন।
সুতরাং শরীরের যে কোনো অপারেশনের জন্যই যেমন পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন, তেমনি দাঁত তোলার ক্ষেত্রেও তা অপরিহার্য। কিন্তু এ কথাটি আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। অসহ্য যন্ত্রণাকাতর রোগী যেমন তাৎক্ষণিক মুক্তির জন্য দাঁত তোলা ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে চায় না এবং ডাক্তারের কাছে পীড়াপীড়ি করে, তখন রোগীর ভূত-ভবিষ্যৎ না ভেবেই ডাক্তার কখনও কখনও দাঁত তুলে ফেলেন। ফলে সামান্য একটি দাঁত তোলা থেকে ভয়াবহ পরিণতিতে জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সবারই সচেতনতা এবং পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন। সুতরাং যেসব অবস্থার কারণে দাঁত তোলা বিপজ্জনক হতে পারে তার কিছু নমুনা নিচে তুলে ধরা হলো
হৃদরোগ : হার্টের জন্মগত ত্রুটি, রিউমেটিক হার্ট ডিজিজ ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ কিংবা হার্টে কৃত্রিম সংযোজিত ভাল্ব থাকলেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া দাঁত তোলা বিপজ্জনক। এসব অবস্থায় দাঁত তোলার আগে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ না খেলে মুখের ব্যাকটেরিয়া রক্তের মাধ্যমে হৃদপিে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হয়ে রোগীর প্রাণনাশ হতে পারে। এ ছাড়া যেসব রোগী নিজের হৃদরোগ সম্পর্কে নিশ্চিত নয় অথচ ঘনঘন শ্বাস নেওয়া, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ধরা, মাথা ঘুরানো, অনিন্দ্রা ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রেও পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া দাঁত তোলা বিপজ্জনক হতে পারে। এ ধরনের সমস্যায় রোগীদের দুটি বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত। যেমন- দাঁত তোলার আগে ডাক্তারকে অবশ্যই হৃদরোগ সম্পর্কে জানানো এবং পরে নিয়ম অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটক গ্রহণ।
রক্তরোগ : এনিমিয়া [রক্তশূন্যতা] লিউকেমিয়া [রক্তের ক্যান্সার], হিমোফিলিয়া, পারপুরা ইত্যাদি রক্তরোগের কারণেও দাঁত তোলা বিপজ্জনক হতে পারে। এ ছাড়া পলিসাইথেমিয়াভেরা নামক রক্তরোগের কারণেও দাঁত তোলা বিপজ্জনক। এসব রক্তরোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- সামান্য আঘাতেই, এমনকি আঘাত ছাড়াও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হয়। রক্তক্ষরণ ছাড়াও মুখ গহ্বরের ঝিল্লি আবরণ, জিহ্বা, তালু ইত্যাদি স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও রক্তক্ষরণ এত প্রচুর এবং দীর্ঘক্ষণ হয় যে, এ থেকে রোগীর মৃত্যু ঘটাও অস্বাভাবিক নয়। তাই দাঁত তোলার আগে এ ধরনের রোগীদের অবশ্যই রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি।
ডায়াবেটিস : অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীর দাঁত তোলা নিষিদ্ধ। ডায়াবেটিস রোগীর দাঁত তোলার আগে রোগীদের অবশ্যই তিনটি বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার।
০১. রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত আছে কি-না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এ ক্ষেত্রে এইচবিএওয়ানসি পরীক্ষার স্বাভাবিক ফলাফল থাকা জরুরি।
২. দাঁত তোলার আগে বা পরে নিয়ম অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ।
৩. মুখ গহ্বরে কোনো ইনফেকশন থাকলে তা সারানোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
কিডনি রোগ : রোগাক্রান্ত দাঁত দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করালে তা থেকে কিডনিতে প্রদাহজনিত রোগ সৃষ্টি হতে পারে। মুখ গহ্বরে এ ধরনের রোগীর প্রধান উপসর্গ হলো মুখ শুকিয়ে যাওয়া। মুখের মধ্যে অস্বস্তিকর জ্বালাপোড়া এবং মুখ গহ্বরের ঝিল্লি আবরণীতে প্রদাহ সৃষ্টি। এ অবস্থায় দাঁত তোলা জরুরি হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
জন্ডিস বা লিভারের রোগ : লিভারের সমস্যার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে রোগীর জীবন হতে পারে সংকটময়। তাই দাঁত তোলার আগে অবশ্যই জন্ডিস বা হেপাটাইটিস ও লিভারের চিকিৎসা করানো উচিত। দাঁত কোনো হেলাফেলার জিনিস নয়। চোখ, কান, নাক, গলা ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো দাঁতেরও রয়েছে শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ। বিষয়টি রোগী এবং চিকিৎসক উভয়কেই অনুধাবন করতে হবে। তবেই কেবল অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা থেকে আমরা রেহাই পাব। পাশাপাশি একজন চিকিৎসকের মানবিক ও সামাজিক দায় বোধও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চেতনার চৌহদ্দিতে তাকে ধারণ করতে হবে, গভীর মমতায় তাকে লালন করতে হবে।
Source:রোগ শোকের কথা