ডালিম
সংস্কৃত দাড়িম্ব
ইংরেজি : pomegranate
Lythraceae গোত্রের একটি পাতাঝরা চিরহরিৎ বৃক্ষ। এই গাছের আদি জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ মনে করেন ডালিমের ভারতবর্ষ, অনেকে মনে করেন ডালিমের আদি নিবাস ইরান।
এই গাছ ১০ থেকে ১৫ ফুট লম্বা হয় এবং এর কাঠের রঙ ফিকে পীত, কাঠে অল্প কালো দাগ থাকে। এর শাখা প্রশাখাগুলো গোলাকার। পাতা সাধারণত ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা এবং উভয় দিক সরু এবং উপরিভাগ চকচকে মসৃণ। ফুল ভেদে ডালিমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক প্রকার গাছে শুধুমাত্র পুং ফুল ফোটে অন্যটিতে পুং এবং স্ত্রী দু’প্রকার ফুলই ফোটে।
ডালিমের ভক্ষণযোগ্য অংশের পুষ্টির পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রামে)
৭৮ ভাগ জলীয় অংশ
১৪.৬ ভাগ শর্করা
১.৬ ভাগ আমিষ
০.১ ভাগ স্নেহ
৫.১ ভাগ আঁশ
৬৫ কিলোক্যালরি তাপশক্তি
০.০৬ মিলিগ্রাম থায়ামিন
০.১ মিলিগ্রাম রাইবোফ্লেভিন
০.৩ মিলিগ্রাম নায়াসিন
১৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি
১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম
০.৭ মিলিগ্রাম ফসফরাস
০.৩ মিলিগ্রাম লৌহ ।
ডালিম ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হলুদ এবং লাল হয়। ফলের ভিতরে বীজের কোষ হয় এবং কোষের উপর পাতলা আবরণ থাকে। পাকা ফলে বীজ গোলাপী ও সাদা হয়। সাধারণত মে মাসে ফুল ও আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ফল পাকে। তিন প্রকার স্বাদের ডালিম দেখা যায় যথা, মিষ্টি, টক মিষ্টি এবং অম্লরস। দেশ ভেদে ডালিমের আকৃতি ও স্বাদের পার্থক্য দেখা যায়। ডালিমের সবচেয়ে ভালো প্রজাতির নাম— স্পেনিশ রুবি। এ ছাড়া অন্যান্য ভালো প্রজাতিগুলো হলো— ঢোল্কা, ভাদকি ও জিবিজিআই, পেপার শেল, মাসকেড রেড, বেদানা ও কান্ধারী। ডালিম ফলের মোট ওজনের বৃহত্তর অংশই খোসা ও বীজ।
ডালিম গাছ চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে ফল দেওয়া শুরু করলেও, শুরুর দিকে ভালো ফলন হয় না। সাধারণত ৮-১০ বছর বয়সের গাছ থেকে ভালো ফলন শুরু হয়। একটি পূর্ণ বয়ষ্ক সুস্থ সবল ডালিম গাছে বৎসরে ১০০-১৫০টি ফল ধরে। তবে ভালো পরিচর্যা নিলে ২০০-২৫০টি ফল পাওয়া যেতে পারে। একটি ডালিম গাছ ত্রিশ বছর পর্যন্ত লাভজনক ফলন দিতে সক্ষম।
আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি মতে— চিকিৎসায় রোগাগ্রস্থ বা রোগোত্তর কালে পথ্য হিসেবে ডালিমের রস খাওয়ানো হয়। ডালিমে বিউটেলিক এসিড, আরসোলিক এসিড এবং কিছু আ্যলকালীয় দ্রব্য (সিডোপেরেটাইরিন, পেপরেটাইরিন, আইসোপেরেটাইরিন, মিথাইলপেরেটাইরিন প্রভৃতি) থাকায়, বিভিন্ন রোগ উপশমে ব্যবহৃত হয়। কবিরাজি মতে ডালিমের রস হৃদপিণ্ডের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কোষ্ঠকাঠিন্যে এই ফলের রস বিশেষ উপকারী। এই গাছের শিকড়, ছাল ও ফলের খোসা দিয়ে আমাশয় ও উদরাময় রোগের ওষুধ তৈরি হয়। এছাড়া ত্রিদোষ বিকারের উপশামক, শুক্রবর্ধক, দাহ-জ্বর পিপাসানাশক, মেধা ও বলকারক, অরুচিনাশক ও তৃপ্তিদায়ক। ডালিমের ফুল স্ত্রীলোকের রক্তস্রাবনাশক।
যেকোনো মাটিতে ডালিম গাছ জন্মালেও, ডালিম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী মাটি হচ্ছে বেলে দোআঁশ বা পলি মাটি। অনুর্বর মাটিতে এটি টিকে থাকতে পারলেও ফলন ভালো হয় না। এই গাছ চুন বা ক্ষারযুক্ত মাটিও সহ্য করতে পারে।
এই গাছ বীজ, শাখা কলম, গুটি কলম ও শেকড়ের মাধ্যমে চাষ করা যায়। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছে গাছের মাতৃগুণাগুণ ও ফলের গুণগতমান বজায় থাকে না। উৎকৃষ্ট মানের গাছ পাওয়ার জন্য, কোনো উৎকৃষ্ট মানের গাছের ডালিম গাছ থেকে শাখা কলম পদ্ধতিতে চারা তৈরি করাই উত্তম। এর জন্য এক বছর পূর্ণ বয়সের কোনো শক্ত নিরোগ ডাল নির্বাচন করে, ২৫-৩০ সেন্টিমিটার পরিমাণ জায়গার ছাল তুলে কলম করা উচিৎ। গুটিকলম পদ্ধতিতেও ডালিমের চারা উৎপাদন করা যায়। কাটিং বা শাখা কলম এর নিচের অংশ ২০০০ পিপিএম ইনডোল অ্যাসেটিক অ্যাসিড বা ৩০০০ পিপিএম ইনডোল বিউটিরিক অ্যাসিড-এর পানির মিশ্রণে চুবিয়ে নিলে, কলমে শিকড় গজানোর হার ত্বরান্বিত হয়। গুটিকলম পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিকড় গজানোর হার ত্বরান্বিত করার জন্য ১০,০০০ পিপিএম-এর পানির মিশ্রণ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ফলছিদ্রকারী এক প্রকার পোকা ডালিম ফলের জন্য মারাত্মক শত্রু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। স্ত্রী প্রজাপতি ফুলের বৃতি ও ছোট ফলের ওপর ডিম পাড়ে। ডিম থেকে শূঁককীট বের হয়ে বর্ধনশীল ফলে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং ফলের বীজ ও অন্যান্য অংশ খেয়ে ফেলে। পরে মূককীটে পরিণত হওয়ার পূর্বে ফলের ত্বকে গোলাকার ছিদ্র করে ফল থেকে বের হয়ে আসে। এই পোকায় আক্রান্ত ফলে মাধ্যমিক সংক্রমণ হিসেবে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে ফুল থেকে ফল হওয়ার পরপরই কাপড় বা পলিথিন বা বাটার কাগজ ফল মুড়ে দিলে এ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে ম্যালাথিয়ন বা কার্বরিল বা ফস্ফামিডন গ্রুপের কীটনাশক দিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর গাছে ও ফলে স্প্রে করলে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া কাণ্ড ছিদ্রকারী কিছু পোকা, রস শোষণকারী পোকা (ছাতা পোকা, সাদা মাছি, শুল্ক বা আঁশ পোকা, থ্রিপস, জাব পোকা ও মাকড়) ডালিম গাছের ক্ষতি করে থাকে।
সূত্র
বাংলা বিশ্বকোষ (দ্বিতীয় খণ্ড)। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
দ্রব্যগুণ। কবিরাজ দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও উপেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত/নবপত্র প্রকাশন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ