বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষা

Author Topic: বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষা  (Read 1211 times)

Offline vcoffice

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 55
    • View Profile
বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষা

মামুন রশীদ | তারিখ: ২২-০৪-২০১৪

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ক্রমবর্ধমান পরিসর উপযুক্ত ব্যবস্থাপকের প্রয়োজনীয়তা দিনকে দিন বাড়িয়ে তুলছে। যেকোনো বেসরকারি সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে দেখা যায়, তাদের কাছে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন বিনিয়োগ বা অর্থায়ন বিশ্লেষক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক, বিপণন ব্যবস্থাপক ও উত্পাদন নির্বাহীরা। এক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রয়োজন মেটাতে পারলে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোয় তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয় না। যারা দ্রুত ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটাতে চান, তারা অন্যের সঙ্গে মালিকানা ভাগাভাগি বা অন্যকে শুরুতে মালিকানা স্বত্ব দেয়াটাও তেমন সমস্যার বিষয় বলে মনে করেন না।

বেসরকারি খাতে জনসম্পদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো কেবল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। এ অবস্থায় আমরা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেতে দেখি, যারা ব্যবসায়-সম্পর্কিত উচ্চশিক্ষা দিয়ে থাকে। এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে যে কেউ বলেই বসতে পারেন, এগুলো ব্যবসায় শিক্ষাকে কেন্দ্রে রেখে প্রতিষ্ঠিত এবং ব্যবসায় বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করেই উপযুক্ত আয় করে থাকে।

বাংলাদেশের প্রথম ব্যবসায়ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) কথা বলা যেতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায় শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দেশের অন্য সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এ বিষয়ে সুযোগ সৃষ্টি হয়। তরুণ প্রজন্ম ও তাদের অভিভাবকদেরও দেখা যায়, চিকিত্সাবিজ্ঞান কিংবা প্রকৌশলবিদ্যা থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে ব্যবসায় শিক্ষায় বেশি আগ্রহী হতে।

বেসরকারি খাতে ব্যবসায় শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হলে বিজনেস কমিউনিটি তাকে স্বাগত জানায়। করপোরেট এক্সিকিউটিভ হিসেবে যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষায় যে কঠিন বাধার সম্মুখীন হতে হয়, ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই সেটা উতরে যেতে পারছেন দেখে অভিভাবকদের প্রত্যাশার পারদ আরো ঊর্ধ্বমুখী হয়। বিশেষ করে এ শিক্ষা তাদের সামনে নতুন বিকল্প হিসেবে উপস্থিত হয়, যা বিশ্ববাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করতে যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু তাদের এত বড় প্রত্যাশার কতটুকু বাস্তবে রূপায়ণ হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, খুব বেশি নয়।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। স্থানীয় করপোরেট হাউসগুলো দ্রুততার সঙ্গে তাদের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিজনেস স্কুলগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের উচিত স্ট্র্যাটেজিক্যালি ভবিষ্যত্ সম্পর্কে ধারণা নির্দিষ্ট করে সেভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। প্রয়োজন থেকে ৫-১০ বছর পিছিয়ে গেলে সেটার কোনো মূল্য থাকছে না। তাদের হতে হবে ভবিষ্যত্মুখী বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।

এক্ষেত্রে তাদের চ্যালেঞ্জ বহুমুখী। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যবসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় উপযুক্ত শিক্ষক বা প্রশাসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম, যা মূল টিমের ওপর অসম্ভব রকম চাপ সৃষ্টি করে। এসব প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর বা ডিন নানা ঝামেলায় ব্যস্ত থাকায় শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সময় দেয়া তাদের পক্ষে অনেকটাই সম্ভব হয় না। অন্যদিকে শিক্ষাদান নিয়ে ভাবতে হওয়ায় তাদের পক্ষে কেবল ব্যবসায়িক কাজেও পুুরোপুরি মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বাজার চাহিদা মাথায় রেখে যখন দুটোর মাঝামাঝি কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন ব্যবসায় শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো আবশ্যিকভাবেই বিবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের স্বল্পতা দিনের পর দিন বিজনেস স্কুলগুলোর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ব্যবসায়িক জগত্ সম্পর্কে তেমন ধারণাই থাকে না। ফলে তাদের পাঠ্যপুস্তকসর্বস্ব শিক্ষাদান শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়। এদের অনেকে আবার শ্রেণীকক্ষে চেয়ারে বসে বছরের পর বছর একই বিষয় বা একই বই পড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা বছরের পর বছর একই কথা বলে শুধু শিক্ষার্থীদের বিরক্তির মাত্রা চরমে তুলতে পারেন, শিক্ষার অবস্থা ক্রমে নিম্নমুখী হতে থাকে।

এদিকে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি কিংবা টপ এক্সিকিউটিভরা মাত্র দু-একটি সেমিস্টারে ক্লাস নিয়ে থাকেন। সেই কর্মব্যস্ত সিইও যদি শিক্ষাদানের প্রতি নিজের থেকে তাগিদ অনুভব না করেন, সেটা আর কিছুই নয়, কেবল অন্য শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষি আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার মাত্রাটাই বাড়াতে পারে। এক্ষেত্রে ভিজিটিং লেকচারগুলো হয়ে গেছে কেবল ব্রান্ডিংসর্বস্ব, যেখানে একজন ব্যক্তি সপ্তাহের দু-একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে গেলেই হলো। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত উপযুক্ত সহকারী বা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের ব্যবস্থা করে ওইসব ব্যস্ত এক্সিকিউটিভের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব শিক্ষালাভ, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেয়া। এটি অন্য সব সিনিয়র ভিজিটিং শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই একইভাবে প্রযোজ্য।

এক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, যেকোনো বিজনেস স্কুলের ইনপুট ও আউটপুট বলতে যা বোঝায়, তা তাদের শিক্ষার্থী। অনেক ক্ষেত্রে চাপ সামলাতে গিয়ে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করে। তাদের কাছে তখন কোয়ালিটি বা মানের চেয়ে কোয়ান্টিটি বা পরিমাণ মুখ্য হয়ে পড়ে, ফলে শিক্ষার মানে ক্রমান্বয়ে অবনমন ঘটতে দেখা যায়।
প্রয়োজনকে সামনে রেখেই গুণগত মান নিশ্চিতকরণে জোর দেয়া উচিত। প্রাক্তন শিক্ষার্থী কিংবা এলামনাই থেকেও প্রয়োজনে বিভিন্ন গ্রান্ট, ডোনেশান কিংবা সময় নিশ্চিত করে নানা ত্রুটি ও শূন্যতা পূরণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। কয়েক বছর আগে একটি সংবাদে খুশি হয়েছিলাম যে, মহিন্দ্রার ১০ মিলিয়ন ডলার ডোনেশনের পর টাটাও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে ৫০ মিলিয়ন ডলার ডোনেশন দিয়েছিল।

গত কয়েক বছরে এমবিএ কিংবা ইএমবিএতে আমার শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রফেশনালরাই বেশির ভাগ এসাইনমেন্ট ও পরীক্ষায় অনেক ভালো করেছেন। কারণ তারা বাস্তবজীবন তথা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের শিক্ষাকে ভালোভাবে সম্পর্কিত করতে পারেন। আসলে এমবিএর মতো প্রোগ্রামগুলো তাদের জন্যই, যাদের কর্মক্ষেত্রে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই কোনো একটি কর্মক্ষেত্রে যোগদান করে কিছুটা বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের পর এমবিএ প্রোগ্রামে যুক্ত হলে সেটা ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে। এটা কেবল সিভি বা জীবনবৃত্তান্ত ভারী করতে পারে এমন একটি ডিগ্রিই নয়, বরং এর মাধ্যমে একজন কর্মকর্তা কিংবা প্রফেশনাল ভবিষ্যত্ কর্মজীবনে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার রসদ লাভ করেন।

উপযুক্ত ভাবনা-চিন্তার সুযোগ থাকার পাশাপাশি যোগ্য সিনিয়র ফ্যাকাল্টির তত্ত্বাবধানে জুনিয়র ফ্যাকাল্টিরা গড়ে উঠতে পারেন। এক্ষেত্রে বিজনেজ স্কুলগুলোয় শিক্ষকদের মূল্যায়নের জন্য একটি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট প্রসেস থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে ফিডব্যাক নিয়ে সবার মধ্যে আলোচনা ও সবার জানার সুযোগ থাকতে হবে এবং এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাগত ধস থামাতে এ মূল্যায়নে অন্তবর্তীকালীন যাচাইয়ের সুযোগও থাকতে হবে, যাতে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ফ্যাকাল্টিরা আরো যত্নবান হন। এক্ষেত্রে প্রতিটি স্কুলের টার্গেট থাকা উচিত, তাদের শিক্ষা কারিকুলামে সর্বোচ্চ র্যাংকের ফ্যাকাল্টিরা যেন স্থান পান। এক্ষেত্রে এলামনাইরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তারা প্রতিটি ক্যারিয়ার মেলা থেকে শুরু করে সার্ভিস-সম্পর্কিত শিক্ষাদানে উপযুক্ত অবস্থান জানান দিতে পারেন। তবে ব্যবসায় শাখার মূল পটভূমি থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য অনুষদ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোটাই এখানে বেশ জরুরি।

প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে এ ধরনের বিজনেস স্কুল রয়েছে, তাদের অবশ্যই সমৃদ্ধ পাঠাগার, হাইস্পিড ইন্টারনেট সুবিধাসহ অত্যাধুনিক কম্পিউটার ল্যাব এবং উচ্চতর গবেষণার সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর উপযুক্ত কেস স্টাডিও করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষাদান বিষয়ে বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সমন্বয় থাকাও জরুরি। বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমি যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব হবে। মাঝে মধ্যে ফিল্ড ভিজিট কিংবা প্রতি ত্রৈমাসিকে ন্যূনতম একবার আবাসিকভাবে শিক্ষাদান বিজনেস স্কুলে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা আরো বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক হবে।

শিক্ষাকেন্দ্রের অবকাঠামোগত সুবিধাও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভ ও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে যথেষ্ট হতে পারে। সামনের বছরগুলোয় আমরা যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন দেখি, তা বাস্তবে রূপদান করতে হলে উপযুক্ত বিজনেস স্কুলের বিকল্প নেই। ভালো বিজনেস স্কুলসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নিঃসন্দেহে আগামীর জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তারা কীভাবে উপযুক্ত প্রশাসনিক দক্ষতা ও বাস্তব জগত্মুখী শিক্ষাদানের সঙ্গে গবেষণাকর্মকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। বছরে তিনটি সেমিস্টার ব্যবস্থায় একটি সেমিস্টারে ১২-১৪টি  দুই-আড়াই ঘণ্টার ক্লাস করে শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কতটুকু শিখতে পারছেন, তারও মূল্যায়ন করা উচিত। এক্রেডিটেশন কাউন্সিল বা মান নির্ণায়নের ব্যবস্থা করে অধিকতর যোগ্য ব্যবসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুপ্রেরণা প্রদানও প্রয়োজন।

পুরো ব্যবসায়ের জগত্ এখন পরিবর্তনের গতিশীলতায় সামনে এগিয়ে চলেছে। নিজেদের প্রয়োজনের কথা চিন্তায় রেখে বিজনেস স্কুলগুলোর উচিত এই গতিশীলতার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা কিংবা অনেক ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে চলা।
 
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
বাংলাদেশ এমবিএ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট
- See more at: http://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2014/04/22/38533#sthash.PwbrOkB7.dpuf