আব্দুল্লাহ আল আরিফ
সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছি আর বাংলাদেশের বৃষ্টির সঙ্গে দিল্লির বৃষ্টির পার্থক্যটা বোঝার চেষ্টা করছি। অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল, বাংলাদেশের বৃষ্টি অনন্য। কিন্তু সেই ধারণা রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ল। ঢাকার মতো দিল্লি শহরটাও দুই ভাগে বিভক্ত। পুরান দিল্লি আর নতুন দিল্লি। নতুন দিল্লি মূলত মূল দিল্লি শহরের সম্প্রসারিত অংশ। আর আমি যেখানে থাকি সেটাকে ঠিক নতুন দিল্লি বলাটা ঠিক হবে না। এটা নতুনতম দিল্লি। ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ থেকে মাইলখানেকের পথ। টার্মিনাল-৩-এর বয়স মাত্র এক বছর। আয়তনে বিশাল, ঝকঝকে তকতকে আর আধুনিক সব উপকরণে সুসজ্জিত। বিমানবন্দর থেকে আমার আবাস পর্যন্ত রাস্তাটার কোনোদিকে কোনো স্থাপনা নেই। একদম ফাঁকা। কয়েক জায়গায় অবশ্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। অদূর ভবিষ্যতে কিছু হবে হয়তো। দিল্লির নতুনতম এই অংশটা আসলে নির্মাণাধীন।
দিল্লির বৃষ্টিকে বাংলার বৃষ্টি থেকে আলাদা করতে পারছি না একটি বিশেষ কারণে। সেটা গাছপালা। এখানে আসার পর এক মাস নতুনতম দিল্লি ঘুরে আমার মনে হয়েছে একটা সবুজ বনাঞ্চলের মাঝে একটা শহর গড়ে উঠেছে। কিন্তু গাছগুলোর অবস্থান আর প্রকৃতি দেখলে বোঝা যায় ব্যপারটা তা নয়। সুপরিকল্পিতভাবে আর সযত্নে গাছগুলোকে লাগান হয়েছে সারি সারি করে। বেশির ভাগ গাছই নিম, দেবদারুর মতো দীর্ঘজীবী বনজগাছ।
বৃষ্টি দেখার পর এ লেখা লিখছি। আজ আকাশে সূর্যের চোখ রাঙানি নেই। নেই রোদের উত্তাপও। এমনিতে দিল্লির সূর্য ভয়ানক। মনে হয় শহরটাকে ভালোমতো দেখার জন্য অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে। আর ভালোবেসে হূদয়ের উষ্ণতাও বাড়িয়ে দিয়েছে খানিকটা। মনে হচ্ছির কয়েক দিন টানা কাজ করে ক্লান্ত সূর্যটা আজ সকালে একটু আরাম করছিল। সেই সুযোগে ভোরবেলাতেই দলবল নিয়ে ছুটে এসেছে মেঘেরা। শুষ্ক শহরটাকে দেখে তাদের মায়া হলো। তাই অনেক দূর থেকে কষ্ট করে বয়ে আনা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। দিল্লিতে একটা জিনিস এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। সেটা জলাশয়। পুকুর-নদী-খাল-বিল-হ্রদ-সাগর কিছুই না। সমুদ্র তো ধারেকাছে নেই। অবশ্য যমুনা বয়ে গেছে দিল্লির একপাশ দিয়ে। আমার এখনো দেখার সুযোগ হয়নি।
গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে, কিন্তু আমাদের দেশে ভিজে চুপচুপ গাছগুলো যেমন জড়সড় হয়ে থাকে, এখানে সে রকম নয়। মনে হচ্ছে সুইমিংপুলে ঝাপাঝাপি করে গাছগুলো আরও সতেজ, আরও সবুজ হয়ে উঠছে। হবেই না বা কেন? সূর্যের অত্যাচারে যে ওরা শুকিয়ে তেজপাতা হয়ে থাকে বছরের বেশির ভাগ সময়।
আজ শুক্রবার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। শুক্রবার এখানে সরকারি ছুটির দিন নয়। কিন্তু আজ কী একটা কারণে যেন বন্ধ। কারণটা জানার চেষ্টা করলাম আমার ভারতীয় সহপাঠীদের কাছ থেকে। অনেকেই তেমন কিছু বলতে পারল না। উত্তর প্রদেশের ছেলে রহুল শ্রীভাস্তভ বলল, আজ ওনম। এটা দক্ষিণ ভারতের বিশেষত কেরালার একটা উৎসব। সম্ভবত ওদের আঞ্চলিক বর্ষপঞ্জি অনুসারে কোনো বিশেষ দিন। সরকারি ছুটি না হলেও যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেরালার ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা আছে সেখানে আজ ছুটি। ভারত এত বিশাল আর বিচিত্র সংস্কৃতির দেশ যে এক প্রান্তের উৎসবের ঢোলের আওয়াজ অন্য প্রান্তে প্রায়শ পৌঁছায় না।
আমি এখানে এসেছি সার্কের বিশ্ববিদ্যালয় সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে পড়তে। আমি দ্বিতীয় শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। গত বছর এটি যাত্রা শুরু করেছে। কোনো হোস্টেল এখনো তৈরি হয়নি। তাই ছাত্রছাত্রীদের রাখা হয়েছে আধা সরকারি একটি তিন তারকা হোটেলে। এটাই আমাদের অস্থায়ী হোস্টেল।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। দ্রুতই মেঘেরা যে যার কাজে চলে যাবে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে সূর্য। এসে দেখবে দুষ্টু মেঘেরা তার শুকনো শহরটিকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। রাগে গজগজ করতে করতে সে আবার তাকে রোদে শুকাতে বসবে।
দিল্লির মানুষগুলোও এখানকার মেঘের মতো কাজ শেষে বসে থাকে না। ঝিমায় না। ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে যায়। তাই ঢাকার মতো এখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান নেই আর সেই সব দোকানে বসে আমাদের মতো শিকড় গজানো আড্ডা দেবার লোকও নেই। ইউরোপ-আমেরিকা যাইনি। ওখানকার ব্যস্ত জীবনযাপন সম্পর্কে যা জানি তা বইপত্র আর অন্তর্জালে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ঢাকা-দিল্লির চালচলনের পার্থক্য দেখে দিল্লি-ডান্ডির পার্থক্যটা আন্দাজ করতে পারি।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি একটা ভেজা কাক দেখব বলে। পাচ্ছি না। এমনিতে কাক খুব একটা চোখে পড়েনি এখানে। যারা আছে তারাও মনে হয় ভীষণ কেউকেটা নাগরিক পাখি। বৃষ্টিতে তারা ভিজে না। তবে আমি যা দেখলাম তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। গাছপালার আড়ালে ইটের স্তুপের ওপর কাকভেজা হয়ে বসে আছে একটা জলজ্যান্ত ময়ূর। পেখম মেলা ময়ুর দেখেছি, মেঘের তালে তালে নৃত্যরত ময়ূর কল্পনাও করেছি। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাওয়া জড়সড় ময়ূর—এটা বুঝি শুধু দিল্লিতেই সম্ভব। কারণ, দিল্লির পথেঘাটে, গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়শই চোখে পড়ে হেলেদুলে অনেকটা নাচের ভঙিতে হেঁটে যাওয়া দু-একটা ময়ূর।
উৎসঃ
http://www.prothom-alo.com/we_are/article/2672/%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BF