বিশ্বকাপের স্মরণীয় ১০ মুহূর্ত

Author Topic: বিশ্বকাপের স্মরণীয় ১০ মুহূর্ত  (Read 1293 times)

Offline kwnafi

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 190
  • Never loose your hope, success will come
    • View Profile

ঘটনার অভাব নেই, অঘটনেরও। ঘটন-অঘটন মিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ হয়ে গেল ব্রাজিলে। সেখান থেকে স্মৃতিতে সঞ্চয় হয়ে থাকার মতো ১০টি অধ্যায়ে আলো ফেলা যাক।
Print Friendly and PDF
2
 


6
 

906
 


১. মিনেইরাওয়ের লজ্জা

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের চিরন্তন দুঃখ হয়ে আছে ‘মারাকানা’। পাঁচ-পাঁচটি বিশ্বকাপ জিতলেও ১৯৫০ সালে ঘরের মাঠের আসরে উরুগুয়ের কাছে হারটির কথা ভোলেননি তারা। ৬৪ বছর পর আবার বিশ্বকাপ আয়োজনে উপলক্ষ ছিল সেটি ভোলার। কিন্তু মারাকানা পর্যন্ত যে যেতেই পারল না ব্রাজিল! উল্টো মারাকানা দুঃখের পিঠে যোগ হয়েছে মিনেইরাও লজ্জা।

জার্মানির বিপক্ষে সেমি-ফাইনালটি ছিল বেলো হরিজন্তের মিনেইরাও স্টেডিয়ামে। সেখানেই ব্রাজিলকে ৭-১ গোলের বিস্ময়কর হারের লজ্জায় ডোবায় জার্মানি।

১৯৭৫ সালের পর দেশের মাটিতে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে এটিই ব্রাজিলের প্রথম পরাজয়। সেবার কোপা আমেরিকায় পেরুর কাছে এই বেলো হরিজন্তেতেই ৩-১ গোলে হেরেছিল ব্রাজিল।

বিশ্বকাপের মতো আসরে স্বাগতিকদের অমন অসহায় আত্মসমর্পন আক্ষরিক অর্থেই ব্যখ্যাতীত। প্রথমার্ধে ১৯ মিনিটের ব্যবধানে পাঁচ গোল খাওয়ারও যেমন কোনো ব্যাখ্যা নেই। না হয় চোটের কারণে নেইমার ছিলেন না, বহিষ্কারাদেশের কারণে চিয়াগো সিলভাও, তবু এভাবে বিধ্বস্ত হবে ব্রাজিল, কেউ ভাবেনি। দেশের সমৃদ্ধ ফুটবল ইতিহাসে এত বড় ব্যবধানে আর কখনো হারেনি তারা।

১৯৫০ বিশ্বকাপের মারাকানার মতো ২০১৪ আসরের মিনেইরাও ভূত ব্রাজিলবাসীদের তাড়িয়ে বেড়াবে অনন্তকাল।

২. কামড়-কাণ্ড

ঠিক আগের ম্যাচে ফিরেছিলেন চোট থেকে। ফিরেই জোড়া গোল করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উরুগুয়েকে জিতিয়ে নায়কের আসনে লুই সুয়ারেস। কিন্তু এরপর খলনায়ক হতেও বেশি সময় নেননি। পরের ম্যাচে ইতালির জর্জো কিয়েল্লিনিকে কামড়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শাস্তি পান এই ফরোয়ার্ড।

ঘটনাটা এড়িয়ে গিয়েছিল রেফারির চোখ। কিয়েল্লিনির কাঁধ কামড়ে উল্টো দাঁত ধরে মাঠে পড়ে গিয়ে এমন অভিনয় করেন সুয়ারেস, যেন আঘাত করা হয়েছে তাকেই। ইতালিয়ান ডিফেন্ডারের অভিযোগেও তাই কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু এরপর ঘটনার তদন্ত শুরু করে ফিফা। ক্লাব ফুটবলে তার অভিন্ন অপরাধে শাস্তি পাওয়ার অতীত বিবেচনায় এবার কঠোর শাস্তি দেয় ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। উরুগুয়ের হয়ে ৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং ফুটবল সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রম থেকে চার মাসের নিষেধাজ্ঞা। শুরুতে ঘটনাটি বেমালুম অস্বীকার করলেও পরে ঠিকই কিয়েল্লিনির কাছে ক্ষমা চান তিনি।

৩. বিস্ময়বালক

ফুটবল-বিধাতা যে তার জন্য এমন রূপকথার চিত্রনাট্য লিখে রেখেছিলেন, মারিও গোটসে কি তা ভেবেছিলেন!

মারিও গোটসের সেই সোনালি গোল। এই গোলেই দুই যুগ পর বিশ্বকাপ জিতলো জার্মানি। ছবি: রয়টার্স

মারিও গোটসের সেই সোনালি গোল। এই গোলেই দুই যুগ পর বিশ্বকাপ জিতলো জার্মানি। ছবি: রয়টার্স
ফাইনালের একমাত্র গোলদাতার হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি। ছবি: রয়টার্স

ফাইনালের একমাত্র গোলদাতার হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি। ছবি: রয়টার্স
জার্মানির জার্সিতে হতাশার এক টুর্নামেন্ট কাটাচ্ছিলেন, এমনকি বাদ পড়েছিলেন একাদশ থেকেও। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালে তিনি নামলেন ৮৮তম মিনিটে। নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ে গড়ানোর পর সেই গোটসেই হয়ে ওঠেন নায়ক। বাঁ দিক থেকে আন্দ্রে শুরলের ক্রস বুক দিয়ে যখন দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণে নেন, তখন তার দুই পা-ই শূন্যে। এরপর বলটি শূন্যে থাকতে থাকতে আরো দারুণভাবে শরীর ঘুরিয়ে মারেন বাঁ পায়ের ভলি। আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক সের্হিয়ো রোমেরোকে হতভম্ব করে বল ঢুকে যায় জালে। আগের ১১২ মিনিটে যে গোল হয়নি, সেটি হল অবশেষে। শেষ পর্যন্ত যা পরিণত জয়সূচক গোলে। আর তাতে জার্মান-ফুটবল রূপকথার চিরন্তন রাজকুমার হয়ে গেলেন গোটসে।

৪. বিদায়ের কান্না

পরিসংখ্যানের পাতায় লেখা থাকবে, জার্মানির কাছে হেরে বিশ্বকাপের ট্রফি জয়ের দৌড় থেকে ছিটকে পড়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, এক কলম্বিয়ানই আসলে শেষ করে দেয় সেলেসাওদের শিরোপা স্বপ্ন। হুয়ান সুনিগার হাঁটুর আঘাতে নেইমারের চোটটাই যে কাল হয়েছে অবশেষে!

কোয়ার্টার-ফাইনালের শেষ দিকের ঘটনা এটি। কান্নার জলে ভিজে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান ব্রাজিলের পোস্টার বয়। চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দিলেন সেই বিপর্যয়ের খবর। চার গোলের সঙ্গে জাদুকরী ফুটবলের মেলবন্ধনে ব্রাজিলকে অত দূর নিয়ে এসেছিলেন যে নেইমার, তিনি না থাকায় তাসের ঘরের মাঠে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সেলেসাও। জার্মানির কাছে সেমিতে ১-৭ গোলের হারে আরেক দফা কান্না উপলক্ষ পেয়ে যান নেইমার।

কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার সুনিগা পরে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু ব্রাজিলবাসী কি আর কখনো তাকে ক্ষমা করবে!

৫. রেকর্ড

স্ট্রাইকার হিসেবে রোনালদোর মানের নন মিরোস্লাভ ক্লোসা। তাতে কী! বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটি তো ঠিকই ব্রাজিল কিংবদন্তির কাছ থেকে নিয়ে নিলেন তিনি।

জার্মানির ৩৬ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন আগের তিন বিশ্বকাপের ১৪ গোল নিয়ে। পর্তুগালের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে খেলেননি। ঘানার বিপক্ষে বদলি হিসেবে মাঠে নামলেন, আর নেমেই গোল! রোনালদোর ১৫ গোলের সিংহাসনে ভাগ বসানোর পর থেকেই ক্লোসার অপেক্ষা রেকর্ডটি নিজের করে নেওয়ার। সেই অপেক্ষার অবসান ব্রাজিলের বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে। ২৩তম মিনিটে গোল করে ইতিহাসকে আলিঙ্গন করলেন প্রজন্মসেরা জার্মান ফরোয়ার্ড।

১৩৬ ম্যাচে ৭১ গোল করে জার্মানির সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাও এখন ক্লোসা।

৬. ধূমকেতুর আবির্ভাব

টুর্নামেন্টের আগে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন লিওনেল মেসি, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, নেইমাররা। কিন্তু পারফরম্যান্স দিয়ে বিশ্বকাপে তাদের সবাইকে পিছু ফেলেছেন হামেস রদ্রিগেস। না হয় সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার ‘গোল্ডেন বল’ পাননি, কিন্তু সর্বোচ্চ গোলদাতার ‘গোল্ডেন বুট’ তো জিতেছেন ঠিকই। আর তার ছয় গোলের মধ্যে উরুগুয়ের বিপক্ষে করা গোলটি যে আসরের সেরা, এ নিয়ে দ্বিমত সামান্যই।

সতীর্থের হেড থেকে বলটি যখন উড়ে আসছিল রদ্রিগেসের দিকে, তখন তিনি উরুগুয়ের গোললাইন থেকে ২৫ মিটার দূরে। বলটি বুক নিয়ে নামিয়ে এরপর শরীর ঘুরিয়ে বাঁ পায়ের বিস্ফোরক ভলি। তাতেই তৈরি বিস্ফোরক এক ফুটবল-মুহূর্ত। সবাইকে স্তব্ধ করে বলটি যে ঠিকই হয়ে যায় গোল! স্পেনের বিপক্ষে রবিন ফন পের্সির উড়ন্ত হেড কিংবা ডাচদের বিপক্ষে টিম কাহিলের ভলি ছাপিয়ে রদ্রিগেসের এই গোলটিই বেশিরভাগের চোখে টুর্নামেন্টসেরা।

৭. উদযাপনের নাচ

১৯৯০ বিশ্বকাপে রজার মিলার সেই কোমড় দোলানো নাচ কে ভুলতে পেরেছে! ২০১৪ বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার নাচও তেমনি রইবে স্মরণীয় হয়ে।

নাচের নেতৃত্বটা লেফট ব্যাক পাবলো আরমেরোর। ক্লাব ও জাতীয় দলের জার্সিতে স্বতস্ফূর্ত উদযাপনের রেকর্ড তার আগেই ছিল। সেটির পুনর্মঞ্চায়ন বিশ্বমঞ্চে হল, যখন গ্রিসের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে প্রথম গোলটি করেন তিনি। দ্রুত দৌড়ে বেঞ্চের দিকে চলে যান, ডাক দেন সতীর্থদের, এরপর ‘সালসা’ ছন্দে শরীর দোলানো। সেই শুরু। বিশ্বকাপে ১২ গোল করা কলম্বিয়ানরা এরপর বারবারই মনে করিয়েছেন নব্বইয়ের ক্যামেরুনকে। গোল উদযাপনে তাদের কাছাকাছি গিয়েছিল ঘানা; জার্মানির বিপক্ষে আসামোয়াহ জিয়ানের গোলের পর সবাই মিলে নেচে।

৮. ঢুস

‘আফ্রিকান অদম্য সিংহ’ ক্যামেরুন তাদের নখরে এবার ক্ষতবিক্ষত করতে পারেনি কাউকে। উল্টো মাঠের মধ্যে নিজেরা মারামারি করে লিখেছে লজ্জার নতুন অধ্যায়।

২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে জিনেদিন জিদান তো মাথার ঢুস মেরেছিলেন প্রতিপক্ষকে। ক্যামেরুনের ডিফেন্ডার বেনোইত আসু-একোত্তা একইভাবে আঘাত করেন সতীর্থ বেঞ্জামিন মৌকাঞ্জোকে। পক্ষ-প্রতিপক্ষ দুই দলের খেলোয়াড়রা এসে মারামারি থামান তাদের। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ০-৪ গোলে হারা ম্যাচের শেষ দিকের ঘটনা সেটি। এই ম্যাচের প্রথমার্ধে রেফারির চোখের সামনে কনুই চালিয়ে লাল কার্ড দেখেন অ্যালেক্স সং। এখানেই শেষ না। এই খেলাটি পাতানো ছিল বলেও ওঠে অভিযোগ। পরে অবশ্য সেই অভিযোগ ধোপে টেকেনি। তবে নিজ খেলোয়াড়কে ঢুস মারার কেলেঙ্কারি ঠিকই সঙ্গী হয়ে থাকল এবারের ক্যামেরুনের।

৯. প্রার্থনা

বিশ্বকাপ গোলের জন্য আলজেরিয়ার অপেক্ষা ছিল ২৮ বছরের। বেলজিয়ামের বিপক্ষে মুফিয়ান ফেঘুইলি পেনাল্টি থেকে যখন সেই অপেক্ষার অবসান ঘটান, আরব দেশটির আনন্দ দেখে কে! দল বেঁধে সেজদার ভঙ্গিতে প্রার্থনা করে গোলটি উদযাপন করেন আরব দেশের খেলোয়াড়রা।

২৮ বছরের গোলখরা ঘোচার পর অবশ্য গোল পেয়েছে আলজেরিয়া নিয়মিত, ফেঘুইলির গোলের পর আরো ছয় বার। উঠে যায় তারা দ্বিতীয় রাউন্ডেও। জার্মানির কাছে হেরে অবশেষে শেষ হয় ব্রাজিলের একমাত্র আরব দেশের বিশ্বকাপ অভিযান।

১০. ক্রসবার

ব্রাজিলের বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ড ম্যাচের শেষ সময়ের ঘটনা। চিলির স্ট্রাইকার মাওরিসিও পিনিইয়ার বুলেট-শট পরাস্ত করে জুলিও সেজারকে। কিন্তু স্বাগতিকদের ত্রাতা হয়ে আসে ক্রসবার। সেখানে লেগে ফেরত আসে বলটি, খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে আর সেখানে জিতে ব্রাজিল উঠে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে।

চিলির জাতীয় বীর হওয়ার অত কাছাকাছি যাওয়ার দুঃখ কখনোই ভোলা হবে না পিনিইয়ার। চাইলেও যেন ভুলতে না পারেন, দেশে ফিরে সে ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। পিঠে আঁকিয়েছেন ট্যাটু, যেখানে চিত্রিত বলটির ক্রসবারে লাগা। সঙ্গে নিজ ভাষা স্প্যানিশে লেখা, ‘গৌরব থেকে মাত্র এক সেন্টিমিটার দূরত্বে।’ রসিক বটে পিনিইয়া!
Kawser Wazed Nafi
Lecturer, CSE department
Daffodil International University
nafi.cse@daffodilvarsity.edu.bd