দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই ভয়াবহ রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত। মূল্য সংযোজন কর বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট এলটিইউ) আওতাধীন ১৫৮টির মধ্যে ১৩৭ প্রতিষ্ঠানই কমবেশি রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত। ভ্যাট আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশী-বিদেশী নামিদামি এসব প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত সরকারের প্রায় ১০ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত। শুধু তাই নয়, জনগণকে সেবা প্রদানকারী ৪৬টি নামি প্রতিষ্ঠানই সিংহভাগ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে।
বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ভয়াবহ চিত্রই প্রমাণ করে রাজস্ব প্রদানকারী অন্য প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম আরও কত ভয়াবহ হতে পারে। অথচ নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা এবং দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব প্রদানকারীর সুনাম নিয়েই ১৫৮টি বড় প্রতিষ্ঠান এলটিইউর অধীনে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা দেশে-বিদেশে সাফল্যের সম্মানে ভূষিত। দেশের অর্থনীতিরও অন্যতম চালিকাশক্তি তারা। কিন্তু ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানই সরকারি অর্থে ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকার মুনাফার পাহাড় গড়ছে। ভ্যাট এলটিইউ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বহুমুখী প্রতারণা, জালিয়াতি, উৎপাদন ও বিক্রি কম দেখানো, কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য এবং ঘোষণা প্রদান, অবৈধ রেয়াত নেয়াসহ নানাধিক কায়দায় রাজস্ব ফাঁকি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কে নেই এই তালিকায়! : অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা, এয়ারটেল, ওরাসকম টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড (বাংলালিংক), ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার বাংলাদেশ, বাটা স্যু, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক লিমিটেড, হোলসিম বিডি লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড, এসিআই, সানোফি এভেন্টিস বাংলাদেশসহ এমন একটি বিদেশী মালিকানাধীন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানও নেই যারা রাজস্ব ফাঁকি দেয়নি। পাঁচতারা হোটেল সোনারগাঁও, রূপসী বাংলা, র্যা ডিসনও বাদ যায়নি।
দেশের নামি প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মা, আকিজ গ্র“প, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল, অটবি লিমিটেড, আরএকে সিরামিকস, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড, এ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেড, তাবানী বেভারেজ লিমিটেড, বোম্বে সুইটস, ঢাকা টোব্যাকো, বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড, নিউজিল্যান্ড মিল্ক প্রোডাক্টস, শাহ সিমেন্ট, সেভেন সার্কেল বিডি, ইউনিক সিমেন্ট, ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সরকারি সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, টেলিটক, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন কে নেই এ তালিকায়!
সরকারের রাজস্ব কোষাগারের এই সাগরচুরি অতীতের সব ঘটনাকে ম্লান করে দিয়েছে। মূলত জনগণের কাছ থেকে সেবা প্রদান এবং পণ্য বিক্রির মাধ্যমে ভ্যাট আদায় করা হলেও তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে অভিনব কায়দায় আত্মসাৎ করা হয়েছে। কিছু নামিদামি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। ধরা পড়ার পর উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়ে আবারও রাজস্ব ফাঁকিতে জড়িয়ে পড়ছে।
এভাবে দেশের নামিদামি শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠান রাজস্ব আদায় করেও তা সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে রীতিমতো সাগরচুরি করছে বলে জানা গেছে। ফাঁকির শীর্ষে বহুজাতিক কোম্পানি : দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ভ্যাট এলটিইউর নিয়ন্ত্রণাধীন ১৪টি বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে অনিয়ম মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সিগারেট উৎপাদনকারী বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৭টি পৃথক রাজস্ব অনিয়মের মামলায় সরকারের পাওনার পরিমাণ ১৯২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। সর্বশেষ দুটি ঘটনায় বিএটিবির বিরুদ্ধে আরও ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির জন্য ২৪ নভেম্বর দাবিনামা জারি করেছে ভ্যাট এলটিইউ। এতে বিএটিবির কাছে সরকারের মোট রাজস্ব পাওনা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১১৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ ছাড়া দেশীয় শীর্ষ সিগারেট উৎপাদনকারী আকিজ গ্র“পের ঢাকা টোব্যাকোর কাছে সরকারের রাজস্ব বকেয়া আছে ৭৪৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৪টি রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনাতেই ঢাকা টোব্যাকোর রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ৫৬৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
অপরদিকে বহুজাতিক ৪ মোবাইল অপারেটরের বিরুদ্ধে সিম রিপ্লেসমেন্ট কারচুপির মাধ্যমে বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি প্রমাণিত হয়েছে। গত ২৮ জানুয়ারি ভ্যাট এলটিইউ কমিশনার গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি এবং এয়ারটেলের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ এনে সিম রিপ্লেসমেন্ট পর্যালোচনা সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এনবিআরে। এর বাইরে সরকারি টেলিটক এবং সিটিসেলসহ এ ৪টি মোবাইল অপারেটরের কাছে সরকারের আরও পাওনা আছে ৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের কাছে সরকারের পাওনা ২ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা- এককভাবে যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রাজস্ব ফাঁকি। এছাড়া বাংলালিংকের বকেয়া ৮৬০ কোটি টাকা, এয়ারটেল ৩৭৩ কোটি এবং রবি আজিয়াটার কাছে পাওনা বকেয়ার পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্যাসিফিক টেলিকম বা সিটিসেলের কাছে ৫ কোটি ৩১ লাখ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটকের কাছে রাজস্ব ফাঁকিজনিত পাওনার পরিমাণ ৮৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে শুধু প্রধান দুটি সিগারেট উৎপাদনকারী এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের মোট রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ হচ্ছে ৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।
আরও বহুজাতিক কোম্পানি : রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত অন্যতম আরও বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে রয়েছে সাবান প্রস্তুতকারী বহুজাতিক ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড ৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ২২ কোটি টাকা, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেড ১২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, বাটা স্যু কোং বাংলাদেশ ৩৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা, এসিআই লিমিটেড ৩৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, হোলসিম বিডি লিমিটেড ১৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড ৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, সানোফি এভেন্টিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
গলদঘর্ম এলটিইউ : ভ্যাট এলটিইউ সূত্র জানিয়েছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব অনিয়মে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু তা আদায় করাটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। গত কয়েক বছর ধরে অডিট কার্যক্রম ও অনিয়ম তদন্তের মাধ্যমে এই বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে ভ্যাট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা আদায়ে এখন গলদঘর্ম তারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজস্ব আত্মসাৎকারীরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না নিয়ে সরাসরি উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দেন। কারণ দর্শানো নোটিশ বা দাবিনামা জারি করা হলেই অভিযুক্তরা উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়ে রাজস্ব আদায়কারীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করে। সরকারের আত্মসাৎ করা অর্থে দেশের প্রখ্যাত আইনজীবীদের নিয়োগ দিয়ে একতরফা সুবিধা লাভ করে। এদের দাপটে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা অসহায় হয়ে পড়েন। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বেশকটি স্পর্শকাতর মামলার রায়ও সরকারপক্ষে এসেছে। এলটিইউ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এসব রিট মামলা মোকাবেলায় সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও মামলা নিষ্পত্তিতে ৫ থেকে ২৫ বছরও লেগে যাচ্ছে। এভাবে আদালতে আইনি লড়াইয়ে দীর্ঘসূত্রতার জালে আটক সরকারের এই বিপুল রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
রিট মামলায় আটক সিংহভাগ দাবি : অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভ্যাট এলটিইউর মোট রাজস্ব ফাঁকির দাবির মধ্যে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকাই আটকে আছে উচ্চ আদালতে দায়ের করা রিট মামলায়। অডিট এবং তদন্তে উদঘাটিত এ রাজস্ব ফাঁকির ঘটনায় ভ্যাট কর্তৃপক্ষ ৪৯২টি বিভাগীয় মামলা দায়ের করেছে। ভ্যাট আইনে অভিযুক্তকে প্রথমে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়। এরপর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে দাবির সঠিক অংক নির্ধারিত হয়।
আনীত অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে কমিশনার ন্যায়নির্ণয় আদেশের মাধ্যমে অনিয়মের জন্য অর্থদণ্ড আরোপ করেন এবং অর্থদণ্ডসহ ফাঁকি দেয়া সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধের নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হলেই অভিযুক্তরা উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেন। ভ্যাট কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। রাজস্ব আত্মসাৎকারীরা সরকারের অর্থ তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে মুনাফার পাহাড় গড়লেও হারানো রাজস্ব উদ্ধার সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
Source : 17-02-2014:hyMvš—i: Newspaper