ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগের শ্রেণিকক্ষ মাত্র একটি। আবার দু-তিনটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা একটি কম্পিউটার ল্যাবও ‘ভাগাভাগি’ করেন। এমন চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় সব বিভাগেই।
তবে এ এফ মুজিবুর রহমান গণিত ভবন পাল্টে দিয়েছে সেই চিত্র। ১৫টি শ্রেণিকক্ষ, পাঁচটি কম্পিউটার ল্যাব, দুটি গ্রন্থাগার, সেমিনার কক্ষ, সম্মেলনকক্ষসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আটতলার এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে গণিতের শিক্ষার্থীদের জন্য। গতকাল শনিবার ছিল ভবনটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বক্তারা আশা প্রকাশ করেছেন, ভবনটি একদিন সারা বিশ্বের গণিতচর্চার কেন্দ্র হবে। প্রায়োগিক গণিতের আরও শাখা-প্রশাখা তৈরি হবে। ‘গণিতের বাতিঘর’ হিসেবে পরিচিত হবে এই ভবন।
একটি বিভাগের জন্য পুরো একটি ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিই প্রথম। তবে চলতি বছরের প্রথম সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন পাওয়া নতুন বিভাগ ফলিত গণিতও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে এই ভবনে। দুটো বিভাগ মিলিয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৫০-এর বেশি। তা ছাড়া বিভাগবহির্ভূত অন্য সাতটি বিভাগে মাইনর কোর্স হিসেবে গণিতের শিক্ষার্থী প্রায় এক হাজার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগের প্রধান ফটকের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমিতে স্থাপিত লাল ইটের এই ভবন নির্মাণে পুরো টাকাই দিয়েছে ‘এ এফ মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশন’। আবুল ফয়েজ (এ এফ) মুজিবুর রহমান ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম বাঙালি মুসলিম আইসিএস কর্মকর্তা। তিনি ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ গণিতে (স্নাতকোত্তর) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তিনি বিখ্যাত গণিতবিদ স্যার আশুতোষ মুখার্জির সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তির রেকর্ডও ভাঙেন।
ক্ষণজন্মা এই মানুষটির স্মরণে তাঁর নামে ১৯৮৫ সালে ছেলে রেজাউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন এই ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস প্রসারে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে সম্পৃক্ত হয়ে চলতি বছর বাংলাদেশ গণিত সমিতি আয়োজিত গণিত অলিম্পিয়াডে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়েছে ফাউন্ডেশনটি। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্মিত এ এফ মুজিবুর রহমান গণিত ভবনগতকাল ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নয়জন এ স্বর্ণপদক পান। ১৮তম এ এফ মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক পাওয়া এ নয়জন হলেন ফারজানা ইসলাম, সানজিদা ইসলাম, ফারহানা আহমেদ, মো. আলমগীর হোসেন, চিন্ময়ী পোদ্দার, কামরুন নাহার, কামরুন্নাহার, মো. লোকমান হোসেন ও শাহেনূর বেগম। তাঁদের প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা, একটি পদক ও একটি সনদ দেওয়া হয়। ২০১১ ও ২০১২ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখায় স্বীকৃতি হিসেবে তাঁরা এ পদক পান।
ভবন উদ্বোধন ও সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি মঞ্চের পাশে রাখা মুজিবুর রহমানের একটি ছবির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এটি ভবন সাজানোর কোনো উপাদান নয়, এটি আমাদের অনুপ্রেরণা।’ তিনি এভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথি ছিলেন ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক নাইলা কবির। তিনি মুজিবুর রহমানের নাতনি। তিনি বলেন, বাবলু মামার (রেজাউর রহমান) খুব ইচ্ছে ছিল এই অনুষ্ঠানে থাকার। কিন্তু তিনি এখন লন্ডনে আছেন, তিনি খুব অসুস্থ। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের ভিডিও তিনি দেখবেন। তাঁকে সব ছবি দেখানো হবে। এগুলো দেখার জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
সভাপতির বক্তব্যে গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অমূল্য চন্দ্র মণ্ডল বলেন, আগের ১৭ বার এই পদকপ্রাপ্ত ৮১ জনের ১৭ জন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। আটজন অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। বাকিদের সবাই বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা বা গণিতচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এভাবে তাঁরা জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এই ভবন ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানচর্চার মূল কেন্দ্র হবে।
স্বাগত বক্তব্যে ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুস ছামাদও এই ভবনটি ভবিষ্যতে ‘বাতিঘর’ হিসেবে গড়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, গণিতচর্চা ও ব্যবহারিক গণিতের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়।
২০০৬ সালে প্রথম ‘এ এফ মুজিবুর রহমান গণিত ভবন’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ভবনটির নকশা করেন প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন।