কোনো ব্যক্তি চমত্কার কোনো ভাবনা বা আইডিয়া আত্মস্থ করার পর ব্যস্ত হয়ে পড়েন আইডিয়াটি বাস্তবায়নে। এত উতলা হওয়ার কারণ তার ধারণা, আইডিয়াটি অতুলনীয়, অভূতপূর্ব ও বিশ্বসেরা। এমন চমত্কার আইডিয়া এর আগে কখনো কারো মাথায় আসেনি (প্রত্যেক মা ভাবেন, তার সন্তান বিশ্বসেরা; তেমনি প্রত্যেক আইডিয়া তৈরিকারকও)। কিন্তু আইডিয়া বাস্তবায়ন যে কঠিন। অনেক কিছু দরকার— একটা অফিস ও কারখানা, কাঁচামাল, কর্মচারী, প্রচার, আরো কত কি! আর এসব কিছু জোগাতে প্রয়োজন টাকা। কোথায় মিলবে টাকা? ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে হবু উদ্যোক্তা একসময় ‘মূল্যবান কিছু’ অর্জন করেন।
অর্থ নয়, অভিজ্ঞান
ব্যাংকের ঋণ তাদের জন্য নয়। স্বপ্নের জন্য তার বুকে তুমুল ভালোবাসা। নিজের জমানো টাকা দিয়ে তাই হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু করেন অনেকে; আইডিয়াটা মহীরুহ থেকে কাটছাঁট করে বনসাই আকারে। পথে নামলে পথ চেনা যায়। কিছু কিছু সহায়তা মেলে। পরিবার থেকে। বন্ধুদের কাছ থেকে। কিন্তু হায়! স্বপ্নের গাছ যত বাড়ে, ততই যে তার খিদে বাড়ে! টাকা দরকার। আরো টাকা। অভাগা যেদিকে চায়, সবই শুকিয়ে যায়। কত সম্ভাবনাময় মহীরুহ অঙ্কুরে মারা যায়! অথচ বাংলাদেশে যদি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থাকত, তাহলে এসব অঙ্কুর মহীরুহ না হোক, বৃক্ষ বা নিদেনপক্ষে ঝোপঝাড় হয়ে বেড়ে উঠতে পারত।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ব্যবসা শুরু বা সম্প্রসারণের জন্য পুঁজির জোগান দেয়। তবে সব ব্যবসায় নয়। যে ব্যবসা উদ্ভাবনীয়, বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ আছে, সেটাই পছন্দ এবং সেখানে বিনিয়োগ করে। উদ্ভাবন শুধু যে বৈজ্ঞানিক হবে, তা নয়। নতুন ধরনের পণ্য বা সেবা অথবা নতুন কোনো চাহিদা মেটানোও হতে পারে। কারণ এসব ব্যবসায় লাভের সম্ভাবনা বেশি। লাভের সঙ্গে ঝুঁকিও হাত ধরাধরি করে চলে। তাই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল একটা ‘অধিক লাভ অধিক ঝুঁকি’ মডেলের অর্থায়ন।
ভেঞ্চার ক্যাপিটালের কাজের পদ্ধতি
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম বা কোম্পানি নির্দিষ্ট উদ্দেশে (যেমন আইটি, কৃষি অথবা এসএমই) গঠিত ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড বা তহবিল’ উত্তোলন করে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান বা বিত্তশালী ব্যক্তিরা এ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডে বিনিয়োগ করেন। সাধারণ বা খুচরা বিনিয়োগকারীকে এ ধরনের তহবিলে বিনিয়োগ করতে নিরুত্সাহিত করা হয়। কারণ এতে ঝুঁকি বেশি ও ফল আসে দেরিতে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম বা কোম্পানি এ তহবিল ব্যবস্থাপনা করে। বিনিময়ে তারা ব্যবস্থাপনা ফি পায়। ভেঞ্চার ফান্ডের মেয়াদ দীর্ঘ। ৫ থেকে ১০ বছর। ভেঞ্চার ফান্ডে যারা বিনিয়োগ করেন, তাদের লিমিটেড পার্টনার বা এলপি বলে। আর যারা এ ফান্ড ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগ করেন, তাদের জেনারেল পার্টনার বা জিপি বলে। জেনারেল পার্টনাররা সাধারণত বিনিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে পরিচালক হিসেবে মনোনীত হন। ভেঞ্চার ফান্ড থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়। ভেঞ্চার ফার্ম বা কোম্পানি এ বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদের। তিন থেকে আট বছর পর্যন্ত। বিনিয়োগ প্রধানত সাধারণ ও অগ্রাধিকার শেয়ার কেনার মাধ্যমে করা হয়। মেয়াদ শেষে অথবা সুবিধাজনক সময়ে ভেঞ্চার ফার্ম সে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। কখনো লাভে আবার কখনো লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়। বিনিয়োজিত কোম্পানি দেউলিয়া হলে পুরো বিনিয়োগ জলে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী পাঁচ বছরের গড়ে দেখা যায়, ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্যের কমে অর্থাৎ লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি করতে হয়েছে। পক্ষান্তরে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রায় পৌনে ছয় বছরে বিক্রয়মূল্যের ১০ গুণ বা ততোধিক মূল্য মিলেছে।
উদ্যোক্তা উন্নয়নে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ভূমিকা
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল একটি উদ্যোগের বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থায়ন করে। যথা— বীজ, অর্থাৎ ব্যবসা যখন উদ্যোক্তার মনে আইডিয়া আকারে থাকে। ২. প্রাথমিক পর্যায় উদ্যোক্তা ব্যবসা শুরুর জন্য কাজ শুরু করেছেন; কিন্তু বিক্রি শুরু হয়নি। ৩. সম্প্রসারণ বিক্রি শুরু হয়েছে; কিন্তু কোম্পানি লাভ করছে না। ৪. বর্ধিষ্ণু আইডিয়া পরীক্ষিত। ভালো আয় আসছে। ব্রেক ইভেন হয়েছে বা কাছাকাছি।
আমরা জানি, নতুন কোনো উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান উপরিউক্ত পর্যায়ে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয় না। তবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে। তার পূর্ববর্তী রেকর্ড বা অন্যান্য ব্যবসার ওপর নির্ভর করে। ব্যাংকঋণ পাওয়ার জন্য আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় নিয়ামক ১. ব্যবসাটি লাভজনক হতে হবে। ২. ব্যবসা বা উদ্যোক্তার পূর্বসাফল্যের উদাহরণ থাকতে হবে। ৩. জামানত হিসেবে বন্ধক দেয়ার মতো যথেষ্ট স্থাবর সম্পত্তি থাকতে হবে। নতুন উদ্যোক্তার এসব কোনো যোগ্যতাই থাকে না। সেক্ষেত্রে ভেঞ্চার ক্যাপিটালই তার একমাত্র ভরসা। এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশ।
শুধু দুষ্প্রাপ্যতা বা প্রাপ্তির জটিলতা নয়, নতুন উদ্যোক্তার জন্য ব্যাংকঋণ প্রকৃতিগতভাবে অসুবিধাজনক। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর থেকেই সুদ আরোপ শুরু হয়। অথচ ব্যবসার প্রাথমিক পর্যায়ে লোকসান হওয়া স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সুদ বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়ায়। তদুপরি ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য বড়জোর তিন বা ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যায়। তার পর ঋণ পরিশোধ করতে হয়। অথচ বাড়ন্ত শিশুর খাদ্যচাহিদার মতো ব্যবসারও তখন প্রয়োজন অতিরিক্ত অর্থ।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল শুধু অর্থ নয়, তারও অধিক কিছু জোগায়। ভেঞ্চার ক্যাপিটালের (বিনিয়োজিত কোম্পানিতে) বিনিয়োগ ঋণের মতো নিরাপদ নয়। ঋণের ক্ষেত্রে জামানত থাকে। জামিনদার থাকে। আইনের সুরক্ষা থাকে। ঋণীকে একগাদা আইনি কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিতে হয়। পক্ষান্তরে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োজিত কোম্পানির লাভ-লোকসানের ভাগীদার। ওই কোম্পানির লোকসান মানে তার লোকসান। তাই ভেঞ্চার ক্যাপিটালের পার্টনাররা বিনিয়োজিত কোম্পানিতে অনেক বেশি জড়িত হন। সেজন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিনিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম।
ভেঞ্চার ক্যাপিটালের সাফল্য
যুক্তরাষ্ট্র ভেঞ্চার ক্যাপিটালের সূতিকাগার। সিলিকন ভ্যালির ডটকম বিপ্লবের পেছনে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের অবদান অনস্বীকার্য। আমেরিকা উদ্যোক্তার জাতি। ভেঞ্চার ক্যাপিটালের তাই সেখানে রমরমা অবস্থা। ভেঞ্চার ক্যাপিটালের কারণেই আমেরিকা এত উদ্যোক্তার মুখ দেখতে পেয়েছে। মাইক্রোসফট, স্টারবাক্স, অ্যাপল, ইন্টেল, ফেসবুক, গুগল, ই-বে, অ্যামাজন— এ রকম অনেক জগদ্বিখ্যাত কোম্পানির বেড়ে ওঠার পেছনে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের সহায়তা রয়েছে।
২০১৩ সালে আইটি খাতে ২ হাজার ৩৬০টি কোম্পানিতে ২ হাজার ৭৮৪ ডিলে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে; যার মধ্যে নতুন কোম্পানি ১ হাজার ৯টি, যাতে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। মোট বিনিয়োগের ৩৭ শতাংশ সফটওয়্যার, ১৫ শতাংশ বায়োটেকনোলজি ও ১০ শতাংশ মিডিয়া এন্টারটেইনমেন্টে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এগুলো নতুন ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ। ভারতে ২০১১ সালে ৫৩১টি ডিলে ১৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ও ২০১২ সালে ৫৫১টি ডিলে ১০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। তার মধ্যে আইটি ও আইটি উদ্ভূত সেবা খাতে ২০১১ সালে ২৭ ও ২০১২ সালে ৪০ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
শেয়ারবাজারে প্রভাব
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োজিত কোম্পানি থেকে আইপিওর (উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে) মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করে (লক-ইন পিরিয়ড শেষে) বের হতে পারে। তার মাধ্যমে ভালো মুনাফা অর্জনের সুযোগ মেলে। তাই বিনিয়োগ নয়, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের আসল সাফ্যলের মাপকাঠি এক্সিট।
আইপিওতে আসার জন্য নতুন কোম্পানি সৃজনে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ভূমিকা ওপরের সারণিতে প্রতিভাত। অবশ্য ভেঞ্চার অর্থায়িত কোম্পানির একটি ক্ষুদ্র অংশ আইপিওতে আসে। একটা বড় অংশ মার্জার অ্যাকুইজিশন (২০১৩ঃ ৮০২), ট্রেড বিক্রির মাধ্যমে এক্সিট করে থাকে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
বাংলাদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের জন্য নীতিমালা এখনো প্রণয়ন করা হয়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল’-এর উল্লেখ আছে। কিন্তু বিস্তারিত নীতিমালা বা বিধিবিধান নেই। সরকার ২০০০-০১ সালের বাজেটে ইইএফ (ইকুইটি এন্ট্রাপ্রেনিউর ফান্ড) চালু করেছে, যা ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ভাবধারায় গঠিত। গ্রামীণ ফান্ড ১৯৯৪ সালে ভেঞ্চার ক্যাপিটল চালু করে ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ১০টি কোম্পানিতে প্রায় ১৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে (সূত্র ওয়েবসাইট)। ২০০২ সালের পর পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগের আর কোনো তথ্য নেই। তবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের জরুরি যে বৈশিষ্ট্য, এক্সিট, সেটির উল্লেখ নেই। এছাড়া ভিআইপিবি ২০০৮ সালে, সিফ (স্মল এন্টারপ্রাইজ অ্যাসিস্ট্যান্স ফান্ড) ২০১০ সালে ও বিডি ভেঞ্চার ২০১২ সালে কার্যক্রম শুরু করেছে।
বাধা ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডের জন্য কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৮ সালে ‘ক্ষুদ্র ব্যবসা বিনিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ব্যবসা শুরু করেছে। ভারতে ১৯৯৬ ও পাকিস্তানে ২০০১ সালে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল আইন প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশে আইন না থাকায় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড উত্তোলন করা সম্ভব নয়। বিদেশী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) ফান্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আইনের অভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারছে না। বিদেশী ভিসি ফান্ড বাংলাদেশে এলে শুধু অর্থ নয়, সঙ্গে জ্ঞানও আনবে। বাংলাদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটালে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি নেই। বিদেশী ভিসি ফার্ম সে অভাব দূর করতে পারে। ভিসি ফার্মের বিনিয়োগকৃত কোম্পানি ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলে বর্তমানে দ্বৈত করের মুখোমুখি হতে হয়। ভিসি আইন না থাকায় কর অব্যাহতি চাওয়ার আইনি ভিত্তিও তৈরি হয়নি। তদুপরি ভিসি ফার্মগুলো চরিত্রগতভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ভিসি আইন প্রণয়ন হলে তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্যে প্রবেশাধিকার) পেতে পারে, যা তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি দ্রুত বর্ধনশীল ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিধায় ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হয়,প্রয়োজনীয় আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিলে বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সৃষ্টি হবে অর্থায়নের নতুন এক যুগের।