কিডনি রোগ প্রতিরোধ ও করণীয়
মুন্নু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ডা. মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহ পাটোয়ারী
প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০-১২ লাখ ছাঁকনি রয়েছে। এই ছাকনি প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে। পরিশোধিত রক্তের মধ্য থেকে তিন লিটার বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। কোনো কারণবশত যদি এ ধরনের ফিল্টার বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন কিডনি রোগ হতে পারে।
কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন পরিমাপ করা হয়। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১.৪ মিলিগ্রাম এবং মহিলার শরীরে ১.৩ মিলিগ্রাম বা তার চেয়ে কম থাকাকে স্বাভাবিক ধরা হয়।
কিডনি নিজস্ব কোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে অথবা অন্য কোনো রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যে কারণেই আক্রান্ত হোক না কেন এতে যদি কিডনির কার্যকারিতা তিন মাস বা ততোধিক সময় পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য ক্রনিক কিডনি ডিজিজ অনেকাংশে দায়ী। কিডনি রোগ ছাড়াও যদি কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় তাহলেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। যেমন- ক্রনিক গ্লোমেরুলাস নেফ্রাইটিস কিডনির ফিল্টারকে আক্রমণ করে ক্রমান্বয়ে কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলতে পারে। ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপ কিডনি রোগ না হওয়া সত্ত্বেও কিডনির ফিল্টার বা ছাঁকনি ধ্বংস করতে পারে। কারও যদি জন্মগতভাবে কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে অথবা কিডনির আকার ছোট বা বেশি বড় থাকে তাহলেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।
কিডনি রোগ কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব
বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার রোগীর কিডনি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে মারা যান। কারণ হিসেবে নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপই দায়ী। নেফ্রাইটিসের কারণ হিসেবে ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন, ভাইরাল হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ ও ভেজালের কারণেও নেফ্রাইটিস হতে পারে। বাংলাদেশে বহুলোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। কয়েক বছর আগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে শতকরা ১৮ ভাগের মতো মানুষ কোনো না কোনো ধরনের কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত।
কিডনি রোগ থেকে জটিলতা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীদের কোনো উপসর্গ হয় না। যখন উপসর্গ দেখা দেয়, তখন কিডনির কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশের মতো লোপ পায়। এ কারণে চিকিৎসা করে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে যদি কিডনি রোগ নিরূপণ করা যেত, তাহলে আংশিক বা পরিপূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হতো।
রোগ সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার
যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কিনা তা দেখা ও ডায়াবেটিস আছে কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যদি কারও ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অথবা ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন, তাকে বছরে অন্তত একবার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন ও মাইক্রো অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। উচ্চরক্তচাপের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
কিডনি রোগের উপসর্গ সম্বন্ধে সবার ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদিও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দ, রক্তস্বল্পতা, শরীরে পানি জমা, শ্বাসকষ্ট ও প্রস্রাবের পরিমাণের তারতম্য, চর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন কার্যকারিতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে শরীরে হৃদরোগসহ আরও অনেক জটিলতা দেখা দেয়।
কিডনি অকেজো রোগীর চিকিৎসা
কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন প্রয়োজন হয়। বর্তমান বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী ৫ থেকে ১৫ বছর ও সফল কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন। নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে তিনবার চার ঘণ্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা বোঝায়।
প্রতিরোধের উপায়
এসিই-ইনহেবিটরস ও এআরবি জাতীয় উচ্চরক্তচাপের ওষুধ কিডনি রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা মাইক্রোঅ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া, চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চললে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষ চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেলে, ধূমপান না করলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হৃদরোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। collected.