'শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা' নিতে আমলারাও যাচ্ছেন বিদেশে

Author Topic: 'শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা' নিতে আমলারাও যাচ্ছেন বিদেশে  (Read 551 times)

Offline Shah Alam Kabir Pramanik

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 542
  • Test
    • View Profile
'শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা' নিতে আমলারাও যাচ্ছেন বিদেশে
শিক্ষক-শিক্ষাবিদরা সুযোগ পান না
সাবি্বর নেওয়াজ
শিক্ষা খাতের বড় চারটি প্রকল্পের টাকায় মন্ত্রণালয় আর কর্মকর্তাদের মাঝে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক পড়েছে। ক্লাসরুমে শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যও যাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের বড় আমলা ও শিক্ষা কর্মকর্তারা। একাধিক সফরের তালিকা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে ক্লাসরুম শিক্ষক আর শিক্ষাবিদদের স্থান হয়েছে খুব কমই। তাদের কোটায় বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ করছেন আমলারা। সরকারের শিক্ষা সফরের নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কর্মকর্তারা এ ভ্রমণ লুফে নিচ্ছেন। শুধু আমলা নন, ক্ষমতার দাপটে দু'জন মন্ত্রীর এপিএস, ইউজিসির চেয়ারম্যানের পিএস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও এসব সফরে অনায়াসে অংশ নিচ্ছেন। নীতিমালা অনুযায়ী এসব
সফরে তাদের যাওয়ার কথা নয়। সফরের অর্জিত অভিজ্ঞতা তারা কীভাবে কাজে লাগাবেন তাও কেউ জানে না। ফলে এসব সফরের সার্বিক ফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষা খাতের চারটি প্রকল্প হলো_ উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ), মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন প্রকল্প (সেসিপ), শিক্ষামান উন্নয়ন প্রকল্প (টিকিউআই) এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প (সেকায়েপ)। জানা গেছে, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, রেজিস্ট্রারসহ জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা বিদেশে ভ্রমণের জন্য আবেদন করেও সেখানে সুযোগ পাচ্ছেন না। উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ) ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্মকর্তা ও ট্যুরে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ইউজিসি সূত্র বলছে, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ) ২০০৯ সালে প্রথম লটের আওতায় উন্নত দেশে ৬টি ট্যুরের সিডিউল করা হয়। এর মধ্যে ৫টি ট্যুর ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। বাকি ট্যুর আগামী মাসে হওয়ার কথা রয়েছে। এই ট্যুরে ইউজিসির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর যাবে। অনুষ্ঠিত ৫টি ট্যুর যেসব কর্মকর্তা করে এসেছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আমলা। শুধু আমলা নন, জীবনে কোনোদিন শিক্ষাসংক্রান্ত কাজ করেননি এমন ব্যক্তিও আছেন। হেকেপ প্রকল্পে কোনো ধরনের সম্পৃক্তা নেই এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। ট্যুর শেষ করে এক মাস পরই অবসর গ্রহণ করেছেন এমন ব্যক্তিও আছেন। ছিলেন দু'জন মন্ত্রীর এপিএস, ইউজিসি চেয়ারম্যানের পিএস। যাদের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই।
হেকেপ সূত্র জানায়, এক্সচেঞ্জ ও স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় মোট ৬টি ট্যুর নির্ধারণ হয়। এর মধ্যে দুটি ট্যুর হয়েছিল ২০১২ সালে। সেখানে ইউজিসির সাবেক সদস্য আতফুল হাই শিবলী এবং অন্যটির নেতৃত্বে দেন কোয়ালিটি এসিওরেন্স ইউনিটের প্রধান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ। দুটি ট্যুরই ছিল ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে। বাকি ৩টি ট্যুর হয়েছে চলতি বছরে। প্রতি দলে ছিলেন ১২ জন করে সদস্য। এর মধ্যে প্রথম গ্রুপ ইতালি ও আমেরিকা ট্যুর করেছে গত ২৩ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত। এর নেতৃত্ব দেন ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মোহাব্বত খান। এই ট্যুরের ১২ জনের মধ্যে ৬ জনই উচ্চশিক্ষা এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় গ্রুপে ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে ট্যুর হয় ১৫ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত। এর নেতৃত্বে ছিলেন শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান। এই সফরে ৭ জনই ছিলেন শিক্ষার বাইরের লোকজন। তৃতীয় গ্রুপ আমেরিকা ও কানাডা ট্যুর করে ২০ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত। এই ট্যুরের নেতৃত্বে ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব সফিকুল আলম। সেখানে ৫ জনই ছিলেন আমলা। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে এই প্রোগ্রামের শেষ ট্যুরটি অনুষ্ঠিত হবে। যার আওতায় নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রোলিয়া ও সিঙ্গাপুর যাবেন তারা।
অনুষ্ঠিত ৫টি ট্যুর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১২ জন করে মোট ৬০ কর্মকর্তা অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন ৩৪ জন। পুরো ট্যুরে মাত্র দু'জন ভিসি, একজন প্রোভিসি ছিলেন। অথচ শিক্ষকদের জন্যই মূলত এই প্রোগ্রাম। এ ছাড়া এ ৫টি ট্যুরে এমন দু'জন কর্মকর্তাও রয়েছেন যারা সফর শেষের কয়েকদিন পরই অবসরে চলে যান। ইউজিসির ১২ কর্মকর্তা ছিলেন, যদের অনেকেই ইউজিসির অভ্যন্তরীণ দাপ্তরিক কাজ করেন। আবার একটি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সফর শেষেই অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যান।
সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ট্যুরে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, হেকেপের এ ট্যুরগুলো মূলত শিক্ষাবিদ এবং উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য। কিন্তু ট্যুরে অংশ নেওয়ার বেশিরভাগ কর্মকর্তাই আমলা। ভ্রমণের তালিকা প্রস্তুতের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে এসব আমলারা সম্পৃক্ত। এ সুযোগে নিজের নাম তালিকায় ঢুকিয়ে দেন। তিনি আরও জানান, গত ২০ থেকে ৪ আগস্ট আমাদের ট্যুর ছিল। ট্যুর চলাকালীন এই ১৪ দিনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত জরুরি ও নীতিনির্ধারণ বিভিন্ন দপ্তরে ডজনের উপরে মিটিং ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ কর্মকর্তা এসব সভায় অংশ নেননি। অনেকেই ট্যুরের পুরো সময় আত্মীয়-স্বজন, কেনাকাটায় শেষ করেছেন। তাদের সঙ্গে প্রথমদিন ও শেষদিন দেখা হয়েছে।
হেকেপের কর্মকর্তারা বলছেন, ট্যুরে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা লিখিত আকারে বিশ্বব্যাংকের কাছে রিপোর্ট করতে হয়। যাতে অন্যদের কাজে লাগে। কিন্তু ট্যুরে অংশ নেওয়া অধিকাংশ আমলা নিজেদের এপিএস দিয়ে কপি পেস্ট করে রিপোর্ট জমা দেন।
এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, সফরের এ তালিকা আমরা করি না। হেকেপ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তালিকা চূড়ান্ত করে। আমরা শুধু ইউজিসির তালিকা প্রদান করি। আপনার এপিএস এই তালিকায় কীভাবে ঢুকল এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা এখানে আসার আগেই এই তালিকা করা হয়েছে।
উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. গৌরাঙ্গ চন্দ্র মোহান্ত এনডিসি বলেন, ভ্রমণে যাওয়া বেশিরভাগ কর্মকর্তাই এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। এর বাইরে যারা রয়েছেন তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে এসেছেন। এটি আমরা বলতে পারব না। কারণ এই তালিকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় করে থাকে।
ইউজিসি সূত্র জানায়, শিক্ষা ভ্রমণে জন্য একটি সংশোধিত নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালায় বলা আছে, একজন কর্মকর্তা এই সফর করে সংশ্লিষ্ট জায়গায় কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবেন সেটি মুখ্য বিবেচ্য হবে। এ ছাড়া কোন শ্রেণীর পদমর্যাদা কর্মকর্তা এসব ট্যুরে জায়গা পাবেন সেটিও বলা আছে।
প্রতিটি ট্যুরেই অর্ধেকের বেশি আমলা অংশ নেন। নীতিমালাটিতে উপসচিব পদমর্যাদার নিচে কেউ এই ট্যুরে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বলা হলেও সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা ইতিমধ্যে ট্যুর করে এসেছেন। আগামীতেও করবেন বলে জানা গেছে। এর আগে এই কর্মকর্তা ফিনল্যান্ড সফর করে এসেছেন।
এ ব্যাপারে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু হেকেপ প্রকল্পে নয়, বেশিরভাগ প্রকল্পে বিদেশে ট্যুর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেতে পারছেন না। এ খাতে আমলাদের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ে। তবে শিক্ষাবিদদের কোটা আমলারা যখন দখল করে নেন তখন আরও খারাপ লাগে। কারণ উন্নত দেশের শিক্ষা পদ্ধতি দেখে একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তা প্রয়োগ করবেন। কিন্তু শিক্ষকরা এটা পাচ্ছেন না। খুবই দুঃখজনক।