শিক্ষায় ভ্যাট: কে দেবে, কেন দেবে?

Author Topic: শিক্ষায় ভ্যাট: কে দেবে, কেন দেবে?  (Read 927 times)

Offline safiullah

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 129
    • View Profile
শিক্ষায় ভ্যাট: কে দেবে, কেন দেবে?
রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রম বৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়: (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫তম অনুচ্ছেদ
একটি গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষা নাগরিকের সুযোগ নয়, অধিকার। যেমন তার অধিকার আছে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসাসেবা পাওয়ার। কিন্তু আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো সেই অধিকার রক্ষায় কখনোই আন্তরিক ছিল বলে মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের যতই গণবান্ধব ও শিক্ষাবান্ধব বলে দাবি করুন না কেন, তাদের কথা, কাজ ও আচরণে তার বিপরীত চিত্রই তুলে ধরে।
গত সপ্তাহে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নির্ধারিত ব্যাংকে তাঁর সন্তানের টিউশন ফি দিতে গিয়ে দেখেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া পে স্লিপে যে অঙ্ক লেখা আছে, তার চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত পে স্লিপে ভ্যাট নামে একটি সিল মারা আছে। কিন্তু তিনি পে স্লিপে নির্ধারিত টাকাই নিয়ে এসেছেন। ফলে ভদ্রলোক সেদিন টিউশন ফি না দিয়েই চলে যান। বাকি টাকা জোগাড় করে আসবেন। ধরুন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিস্টারের টিউশন ফি ৫০ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে তাঁকে আরও ৩ হাজার ৭৫০ টাকা বেশি দিতে হবে।
সেটি কজন অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব হবে? আমাদের মন্ত্রী বাহাদুরদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু বড়লোকের সন্তানেরাই পড়েন। আসলে তাঁদের সেই ধারণা ভুল।
বুধ ও বৃহস্পতিবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী রাজপথে বিক্ষোভ করছিলেন, তাঁেদর অধিকাংশই বিত্তবান ঘরের সন্তান নন। এঁদের পোশাক-আশাক সাধারণ। চেহারা পোড়খাওয়া। এক ছাত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘আন্দোলন করে যদি আমরা মরেও যাই, দুঃখ থাকবে না। আমাদের সতীর্থরা ভ্যাট ছাড়াই পড়ার সুযোগ পাবে।’ আরেক ছাত্রের হাতে ধরা পোস্টারে লেখা ছিল: ‘কিল মি, নো ভ্যাট।’ এসব রাজনৈতিক মঞ্চে শেখানো কথা নয়। অন্তর থেকে আসা। আরেকটি বিষয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করলেও বাড়াবাড়ি করেননি। গাড়িতে আগুন দেননি বা ভাঙচুর করেননি। বুধবার পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে বাড়াবাড়ি না করলে আন্দোলনটি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণই থাকত বলে ধারণা করি।
কিন্তু এই বেসরকারি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে ঢাকা শহর অনেকটা নিশ্চল হয়ে পড়ল, মানুষ সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়ল—তার দায় কে নেবে? আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, না সরকার? সরকারের একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণেই এই পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। অতএব, এর দায়ও তাদের নিতে হবে।
অতি সম্প্রতি শিক্ষাঙ্গনে যেসব অঘটন ঘটেছে, তার মূলেও কাজ করছে সরকারের ভুল নীতি ও সিদ্ধান্ত। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মাঠে নামলেন বেতনবৈষম্য নিরসন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে। সেই আন্দোলন এখনো চলছে। এরপর গত বুধ ও বৃহস্পতিবারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেন তাঁদের ওপর আরোপিত সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) প্রত্যাহারের দাবিতে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে কেউ আলোচনার প্রয়োজন বোধ করলেন না। মন্ত্রী মহোদয় সাফ জানিয়ে দিলেন যে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে না। তবে সেই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে।
সরকারের এই বক্তব্যই বা কতটা যুক্তিসংগত? বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাট আরোপ কি অপরিহার্য ছিল? এই খাত থেকে সরকার যে পরিমাণ অর্থ পাবে বলে আশা করছে, সেটি কি অন্য কোনো খাত থেকে আদায় করা যেত না? কিংবা ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার বাজেটে অনুৎপাদনশীল খাতের বরাদ্দ কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ভর্তুকি কমিয়ে হলেও সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে পারত। ইতিমধ্যে ভ্যাটের বিরুদ্ধে একাধিক রিট হয়েছে এবং উচ্চ আদালত রুলও জারি করেছেন।
এনবিআর বলেছে, ভ্যাটের কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বাড়বে না, কারণ এটি শোধ করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের এই যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন প্রথমে বলেছিলেন, এনবিআর যেভাবেই ব্যাখ্যা দিক, এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের ওপরই বর্তাবে। এনবিআরের যুক্তি হলো, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেবার বিনিময়ে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে; শিক্ষার্থীদের ওপর নয়। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে শেখ কবির হোসেন আগের অবস্থান থেকে সরে এনবিআরের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। এর পেছনের রহস্যটা কী?
এখানে শুভংকরের ফাঁকিটা হলো, সেবার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বর্তমানে যে অর্থ আদায় করা হচ্ছে, ভ্যাট আরোপের পর সেই অর্থ বাদ দিয়ে তারা সেবা দেবে। অর্থাৎ এখন যদি শিক্ষার্থীদের পেছনে তারা ১০০ টাকা ব্যয় করে থাকে, তখন সাড়ে ৭ টাকা কম ব্যয় করবে। আর শিক্ষার্থীরা আগের মতো সেবা পেতে চাইলে তাঁদের সেই সাড়ে ৭ শতাংশ অর্থ বেশি দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট নামে না হলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই অতিরিক্ত টিউশন ফি নেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি যে এর বেশি নেওয়া যাবে না। শেষ বিচারে ক্ষতি হবে শিক্ষার্থীদেরই।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, শিক্ষায় ভ্যাট একটি অযৌক্তিক ও অমানবিক সিদ্ধান্ত। শিক্ষা হচ্ছে সামাজিক সেবা। একে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। তবে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টিউশন ফি না নিতে পারে, সে জন্য একটি সিলিং বেঁধে দেওয়ার পক্ষপাতী। তিনিও মনে করেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়াশোনা করছেন, তাঁরা সবাই বড়লোকের সন্তান নন। অনেক সাধারণ মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য হন। অনেকে টিউশনি কিংবা খণ্ডকালীন চাকরি করেও পড়াশোনা করছেন। অনেক অভিভাবক জমিজমা বিক্রি করে কিংবা ধারকর্জ করে সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এই আশায় যে পাস করার পর একটি চাকরি পাবেন।
সরকার অবশ্য বলতে পারে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনেক কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স আছে, তাঁরা সেখানে গিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু সেসব কলেজে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, চাকরির বাজারে তার কোনো চাহিদা নেই। তাহলে কেন পড়বেন? এ ছাড়া এসব কলেজের চার বছরে অনার্স শেষ করতে সাত বছর ও এক বছরের মাস্টার্স শেষ করতে দুই বছর লেগে যায়।
ভ্যাট আরোপ করা হয় সাধারণত পণ্যের ওপর। ভোক্তা কোনো পণ্য ভোগ বা গ্রহণ করলে নির্দিষ্ট হারে তাঁকে ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু শিক্ষা তো পণ্য নয়; ভবিষ্যতের বিনিয়োগ। সামাজিক সেবা। দ্বিতীয় কথা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে পড়াশোনা করেন, তাঁদের ওপর ভ্যাট না ধরে, যাঁরা বেশি অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা নিচ্ছেন, তাঁদের ওপর ভ্যাট চাপিয়ে দেওয়ার যুক্তি কী?
২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই ভ্যাট আরোপ করা হলেও এটি স্পষ্ট ছিল না যে কে ভ্যাট পরিশোধ করবেন। অর্থমন্ত্রী বাজেট পাসের সময় বলেছিলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এ ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবাদ করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তাদের সঙ্গে আলোচনা করারও প্রয়োজন বোধ করেনি। সব ক্ষেত্রেই সরকার মনে করে, যা করেছি, ঠিক করেছি, যারা সমালোচনা করছে, তারা হয় বিএনপি–জামায়াতের দোসর অথবা ষড়যন্ত্রকারী।
সরকার ভালো করেই জানে যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের উৎস শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। তাই তাদের বাড়তি ব্যয় নির্বাহ করতে হেল শিক্ষার্থীদের ওপরই চাপ বাড়বে। আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুনাফা করতে পারবে না। বর্ধিত আয় শিক্ষার উন্নয়নেই ব্যয় করতে হবে। কিন্তু ভ্যাট দিতে হলে তাদের সেই শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমও কমে যাবে।
বরং সরকার এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ না করে, উচ্চশিক্ষার নামে যারা প্রতারণা ও সনদ ব্যবসা করছে, যদি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিত, তাহলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী উপকৃত হতো। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায়ও শৃঙ্খলা ফিরে আসত। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। কিন্তু দুধ দেওয়া গরুকে না খাইয়ে মারার নীতি কোনো দেশের জন্যই ভালো হতে পারে না।
গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিটি কেন শান্তিপূর্ণ থাকতে পারল না? রাতের অন্ধকারে রাজপথে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের ওপর একদল দুর্বৃত্ত লাঠিসেঁাটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এরা কারা? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না? এভাবে আর যাই হোক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
সবশেষে আমাদের প্রত্যাশা, সরকার পুরো বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
source:http://www.prothom-alo.com/opinion/article


Offline AbdurRahim

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 159
  • Test
    • View Profile
Very nice