সময় এখন জামদানীর...
বিপাশা মতিন, শিক্ষক, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের মানুষ যদি বাংলাদেশের কোন পন্য নিয়ে গর্ব করে থাকে সেখানে জামদানীর অবস্থান হবে কোন সন্দেহ ছাড়াই, প্রথম। উৎসব ও বিশেষ দিনগুলোতে জামদানীর ব্যবহার হয়ে আসছে আদিকাল হতেই। জামদানি মানে তো কেবল ছয় গজের শাড়িই নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আভিজাত্য।
রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের বাতাসে আছে অন্যরকম জাদু। সেই জাদুর পরশেই তৈরি হয়েছে বিশ্ব মাতানো জামদানি। শীতলক্ষ্যার পানি, আবহাওয়া, জলবায়ুর ও তাঁতির পরম আবেগের ছোঁয়ার অদ্ভুত মিলনই বিস্ময়কর এই কাপড় তৈরির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক আইন ২০১৩ পাশ হওয়ার পর সরকার বাংলাদেশের এর রেজ্জিস্ট্রেশনের সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলেই খোঁজ পেয়েছি। ইতোমধ্যেই, বিজি প্রেসের জার্নালে জামদানীর রেজিস্ট্রেশনের কথা প্রকাশ করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রকাশের ২ মাস অপেক্ষার পর “অনুমোদিত ব্যবহারকারী” হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে, বিসিক, এই রেজিস্ট্রেশন নিবে যদি অন্য কোন পক্ষ হতে কোন প্রকার কোন বিরোধিতা না আসে।
সরকারের এরকম সময়োপযোগী উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানালে অন্যায় হয়ে যাবে।
রেজিস্ট্রেশনের পর, বাংলাদেশ, ভারতের নিকট তাদের জামদানি নিবন্ধন বাতিলের জন্য ভারতীয় ভৌগলিক নির্দেশক আইনের ২৭ ধারা মোতাবেক আবেদন করতে পারবে।
ভারতে আইনি যুদ্ধ বাংলাদেশ যদি কোনো সন্তোষজনক ফলাফল না পায়, বা ভারত যদি জামদানী নিবন্ধন বাতিল না করে তাহলে বাংলাদেশ পরবর্তি ফয়সালার জন্য ডব্লিউটিও এর উরংঢ়ঁঃব ঝবঃঃষবসবহঃ ইড়ফু (উঝই)'র নিকট বিরোধ ফয়সালার আবেদন জানাতে পারবে।
এই পর্যায়ে শুধু সাহস আর দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসাই পারবে জামদানীকে বাংলাদেশের করে ফিরিয়ে আনতে। সরকার পর্যায় তো অবশ্যই, তবে নাগরিক পর্যায়েও আনতে হবে সচেতনতা।
ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে বসে থাকলে হবেনা। যারা জামদানী নিয়ে কাজ করছেন, তাদের উদ্দেশ্যেই বলা, জামদানীর স্বকীয়তা বজায় রাখাও কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষার সামিল। জামদানীর ব্যবহার বাড়াতে হবে আরো বেশি। তবে তাই বলে জামদানীর গুনাগুনের সাথে কোনরকম আপোষ করা যাবেনা। অক্ষুন্ন রাখতে হবে জামদানীর বিশেষ জ্যামিতিক প্যাটার্ন।
রাষ্ট্রীয় সফরে বিভিন্ন অতিথিরা এলে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে যেসব স্মারক শুভেচ্ছা দেওয়া হয় তার মধ্যে জামদানি শাড়ি প্রধান। তবে সেই জামদানী যারা তৈরি করছেন তাদের ছেলে-মেয়েরা এই শিল্পে কাজ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন এমনকি অনেকেই তাদের বাপ-দাদার এই শিল্প বিক্রি করে দিয়ে অন্য ব্যবসায়ে মনোযোগ দিচ্ছেন। ব্যাপারটি এরকম, একদিকে আমরা জামদানীর স্বত্ব নিয়ে কথা বলছি, অন্যদিকে এই জামদানী নিচ্ছিহ্ন করতেও আমাদের অবদান কম না।
সময় এখন তারুন্যের। আর তাই এই দেশের তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে এই ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে। জামদানী নিয়ে গবেষণা, মার্কেটিং, প্রমোশন, ক্রিয়েটিভ ডিজাইন এসবই সম্ভব তরুণদের দিয়ে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে এইসব কর্মকান্ডের শুরু হতে পারে। ‘ইন্ডাস্ট্রি ভিজিট’-এ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন বিসিকের ‘জামদানী পল্লী’ কে বেছে নিচ্ছেন। ঘুরে দেখছেন ‘জামদানী পল্লী’, তাঁতিদের কাজ, জীবন কিংবা জামদানী নিয়ে ব্যবসায়িক মনোভাবের শুরুও হতে পারে এসকল কার্যক্রম। তরূণদের মধ্যে জামদানীর প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে পারলে অনেক কাজই সহজ হয়ে যাবে।
খুব সহজ কথা, প্রচার না করলে প্রসার হবেনা। বিসিকের উদ্যোগে বাংলাদেশে ‘জামদানী মেলা’ আয়োজন ছাড়াও আন্তর্যাতিক পর্যায়ে ‘জামদানী মেলা’ করা যেতে পারে। এতে প্রসার যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে ব্যবসায়িক সুযোগও।
পরিশেষে, সর্বজন সমাদৃত জামদানীর মিইয়ে যাওয়া নাম-ডাক ফিরিয়ে আনতে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। একে অপরকে দোষ দিয়ে নয়, সময় এসেছে একসাথে কাজ করার, সময় এখন তরুণদের।
সময় এখন জামদানীর।
লেখাটি বিসিক জামদানী মেলার ২০১৬-এর বার্ষিক প্রকাশনীতে প্রকাশিত হয়েছে।