ইসলামের বিধিবিধান ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে নির্ধারণ করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা। এ কারণেই ভ্রমণকালে মানুষের পরিশ্রম ও কষ্টের কথা বিবেচনা করে নামাজ কসর (সংক্ষিপ্ত) ও রোজা ভাঙার (পরে আদায় করার শর্তে) সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
আসলে ভ্রমণের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে বিঘ্ন ঘটে এবং এ বিপত্তির বিষয়টি মানুষ মেনেও নিয়েছে। অর্থাৎ মানুষ জানে, সফরে গেলে তার প্রতিদিনের খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম ইত্যাদির রুটিনে বিঘ্ন ঘটবে। অবশ্য এখন সফরের কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়েছে। তারপরও ঘরের পরিবেশ আর সফরের পরিবেশ এক হয় না।
নিজের দেশে নিজের ঘর কখনও অন্য দেশ বা অন্যের ঘরের সমান হয় না। নিজের বাসস্থানে মানুষ যে আরাম-আয়েশে থাকে সফরে গেলে তা আর থাকে না এবং মানুষ এক ধরণের অস্থিরতার মধ্যে থাকে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই আধুনিক যুগেও সফরের সমস্যাবলী আগের মতোই বিদ্যমান।
এ ছাড়া, এখনও বহু শহর ও গ্রাম আছে- যেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা খুবই কম এবং সেখানে সফরে গেলে মানুষকে অনেক কষ্টে সময় কাটাতে হয়। তাই কসরের নামাজ এখনও অনেকের জন্য বড় ধরণের ছাড় বলেই গণ্য হয়। কাজেই কসরের নামাজ ও রোজা ভাঙার মতো ইসলামের নির্দেশাবলী সার্বিকভাবে মেনে চলতে বলা হয়েছে।
কোনো সফরে যদি কোনো রকম কষ্ট নাও হয়- তাহলেও এ সার্বিক নির্দেশ অমান্য করা যাবে না। অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে সফরে গেলে কসরের নামাজ পড়তেই হবে এবং রোজা রাখা যাবে না।
অবশ্য নামাজ-রোজা সম্পর্কে আল্লাহর এ নির্দেশের পেছনে অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে, যার সঙ্গে হয়ত সফরের কষ্টের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা সে কারণ জানি না বলে আল্লাহর নির্দেশে পরিবর্তন আনার অধিকার আমাদের নেই।
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, কোনো ব্যক্তি তার অবস্থানস্থল থেকে ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরে সফরের নিয়তে বের হয়ে তার এলাকা পেরিয়ে গেলেই শরিয়তের দৃষ্টিতে সে মুসাফির হয়ে যায়।
ভ্রমাণ বা সফরের নিয়তে বের হয়ে নিজ এলাকা পেরুলে সফরের বিধান শুরু হয়। শহরের ক্ষেত্রে ওই শহরের করপোরেশনের নির্ধারিত সীমানা থেকে সফরের সীমা নির্ধারিত হবে। অনুরূপ সফর থেকে ফিরে আসার ক্ষেত্রেও নিজ এলাকার সীমানায় প্রবেশের সঙ্গেই তার সফরের বিধান শেষ হয়ে যাবে।
আকাশ পথে সফরের ক্ষেত্রেও দূরত্বের হিসাব স্থলভাগে সফরের দূরত্বের পরিমাপে হবে, অর্থাৎ স্থলভাগের ৭৮ কিলোমিটার পরিমাণ দূরত্বের সফর হলে আকাশপথে মুসাফির হবে।
অনুরূপ পার্বত্য এলাকায় সফরের ক্ষেত্রেও সমতলে চলার হিসেবেই হবে, অর্থাৎ পাহাড়ের উঁচু-নীচু ঢালুসহ দূরত্বের হিসাব হবে।
ভ্রমাণকারীর জন্য শরিয়তের বিধি-বিধানে কিছু শিথিলতা রয়েছে, যথা চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো দুই রাকাত আদায় করবে, সফরে রোজা না রেখে পরবর্তী সময়ে কাজা করলেও চলবে। এছাড়া আরও কিছু বিধানে পরিবর্তন রয়েছে।
মুসাফির ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত সফর অবস্থায় চার রাকাত নামাজ পূর্ণ করলে গুনাহ হবে। এ ক্ষেত্রে নামাজ পুনরায় পড়া ওয়াজিব। আর যদি ভুলক্রমে চার রাকাত পূর্ণ করে নেয়, তাহলে যদি সে প্রথম বৈঠক করে থাকে, তাহলে সেজদা সাহু করে নিলে ফরজ নামাজ আদায় হয়ে যাবে, আর যদি প্রথম বৈঠক না করে থাকে তাহলে ফরজ আদায় হবে না, আবারও পড়তে হবে।
মুসাফির ব্যক্তি মুকিম (স্থানীয়) ইমামের পেছনে ইকতিদা করলে সে ইমামের অনুসরণে পূর্ণ নামাজই আদায় করবে।
মুকিম ব্যক্তি মুসাফির ইমামের পেছনে ইকতিদা করলে চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজগুলোতে মুসাফির ইমাম সাহেব দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরানোর পর মুকিম মুক্তাদি দাঁড়িয়ে সুরা পড়া ছাড়া বাকি দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিবে।
সফর অবস্থায় ছুটে যাওয়া নামাজ মুকিম অবস্থায় কাজা করলে ‘কসর’ই (দুই রাকাত) আদায় করবে, আর মুকিম অবস্থার ছুটে যাওয়া নামাজ সফরে কাজা করলে তা পূর্ণ আদায় করবে।
স্থায়ী আবাসস্থল পরিবর্তন করে অন্যস্থানে মূল আবাস গড়লে স্থায়ী বসবাসের জন্য সেখানে না যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে আগের অবস্থানস্থল মৌলিক আবাসন হিসেবে গণ্য হবে না, এমনকি সেখানে তার মালিকানা জায়গা-জমিন থাকলেও নয়, বরং সেখানেও সফরের সীমানা অতিক্রম করে গেলে মুসাফিরই থাকবে।
কোনো জায়গায় ১৫ দিন বা ততধিক অবস্থানের নিয়ত করলে সে সেখানে মুকিম হয়ে যাবে। সেখান থেকে সামানা-পত্রসহ প্রস্থানের আগ পর্যন্ত সেখানে পূর্ণ নামাজ পড়বে এবং মুকিমের বিধান জারি থাকবে।
মহিলারা বিয়ের আগ পর্যন্ত তার বাবার বাড়িতে স্থায়ী আবাস হিসেবে মুকিম থাকবে।
তবে বিয়ের পর যদি স্বামীর বাড়িতে মৌলিকভাবে থাকে এবং বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে, তাহলে স্বামীর বাড়ি তার মৌলিক আবাসন হিসেবে ধর্তব্য হবে এবং বাবার বাড়িতে মুসাফির থাকবে, আর যদি বাবার বাড়িতে মৌলিকভাবে থাকে, তাহলে তা তার মূল অবস্থানস্থল হিসেবেই বাকি থাকবে।
পুরুষগণ তার শ্বশুরবাড়িতে ১৫ দিনের কম থাকার নিয়ত করলে মুসাফিরই থাকবে। হ্যাঁ, কেউ যদি সেখানে স্থায়ী আবাস করে নেয়, তাহলে তা ভিন্ন কথা।
মুসাফির ব্যক্তির জন্য তার চলন্ত অবস্থায় বা তাড়াহুড়া থাকলে ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্যান্য সুন্নতে মোয়াক্কাদা না পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে স্বাভাবিক ও স্থির অবস্থায় সুন্নতে মোয়াক্কাদা পড়তে হবে। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও সুন্নত পড়েছেন, আবার কখনও ছেড়ে দিয়েছেন। অার হানাফি ফকিহরা বলেন, সফরে বিরতিকালে সুন্নত পড়বে আর চলতি অবস্থায় পড়বে না।
http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/463504.html