বুড়িগঙ্গা: ঢাকার জন্মদাত্রী নদীর ইতিহাস থেকে বর্তমান করুণ উপাখ্যান

Author Topic: বুড়িগঙ্গা: ঢাকার জন্মদাত্রী নদীর ইতিহাস থেকে বর্তমান করুণ উপাখ্যান  (Read 2489 times)

Offline 710001113

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 493
    • View Profile
By Shah MD. Minhajul Abedin
Like what you read ? Say it !
Like

গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারতের বুক চিরে বয়ে চলা এক নদীর নাম গঙ্গা। ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের সীমানা ভাগ হওয়ার অনেক আগেই, গঙ্গা নদীর একটি শাখা পূর্ব বাংলার শস্য-শ্যামল প্রকৃতির বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে শেষ ঠিকানা করে নিয়েছিলো। নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) বইয়ে বুড়িগঙ্গার ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন, “পদ্মার প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিশানা সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না। ফান ডেন ব্রোকের (১৬৬০) নকশায় দেখা যাইতেছে পদ্মার প্রশস্ততর প্রবাহের গতি ফরিদপুর-বাখরাগঞ্জের ভিতর দিয়া দক্ষিণ শাহবাজপুরের দিকে। কিন্তু ঐ নকশাতে আরেকটি প্রাচীন পথেরও ইঙ্গিত আছে। এই পথটি রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ার পাশ দিয়ে চলনবিলের ভিতর দিয়া ধলেশ্বরীর খাত দিয়ে ঢাকার পাশ ঘেঁষে মেঘনা খাঁড়িতে গিয়ে সমুদ্রে মিশিত। ঢাকার পাশের নদীটিকে যে বুড়িগঙ্গা বলা হয়, তাহা এই কারণেই। ঐ বুড়িগঙ্গাই প্রাচীন পদ্মা-গঙ্গার খাত।”

Frederick William Alexander কর্তৃক ১৮৬১ সালে আঁকা বুড়িগঙ্গার ছবি; Source: collections.vam.ac.uk

গঙ্গার এই বুড়িমা গঙ্গা থেকে আলাদা হয়ে গেছে অনেক আগেই। গঙ্গোত্রী হিমবাহের সাথে লেনদেন চুকে গেলেও নামের সাথে গঙ্গা শব্দটি শ’খানেক বছর ধরে জুড়ে রেখেছে এই নদী। মাঝে এই নদী দেখেছে কত পরিবর্তন। মোঘল সুবাদারেরা অনেকেই এই নদীর প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলেন। বুড়িগঙ্গার তীরেই গড়ে উঠতে থাকে জমজমাট ঢাকা নগরী। নদীর তীরে ঘেঁষে গড়ে উঠা এই জনপদকে আরেকটু রাঙ্গিয়ে দিতে রাতে নদীর তীরে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন মোঘল সুবাদার মুকাররম খাঁ। বর্ষাকালে এই নদীতীরের জনপদকে জলমগ্ন ভেনিস নগরীর সাথে গুলিয়ে ফেলতেন অনেক ইউরোপিয়ান বণিক। এমনকি গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেও বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানি ঢাকার সেই আদি জনপদকে বিনামূল্যেই ভেনিস দেখার ব্যবস্থা করে দিতো। ঢাকার নদীতীরের স্থানের নামের সাথেও জড়িয়ে আছে নদীর ইতিহাস। নদীর অদূরে এখন যেখানে ‘নারিন্দা’, ঢাকার ইতিহাসে আদিকালে সেই এলাকার নাম ছিলো ‘নারায়ণদিয়া’ বা ‘নারায়ণদি’। প্রচলিত ঢাকাইয়া বাংলায় দ্বীপের অপভ্রংশ দাঁড়ায় ‘দিয়া’ বা ‘দি’। বর্ষাকালে এই এলাকা জলমগ্ন দ্বীপের মতো দেখাতো বলে লোকে হয়তো কোনো এককালে এই এলাকার নামই দিয়ে দিলো ‘নারায়ণের দ্বীপ’ বা ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত দীপ’।

বুড়িগঙ্গার স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে সময়ও পেরিয়ে যেতে থাকে। সেই সময়ের ক্ষুধার্ত গর্ভে নদীর তীরে গড়ে উঠা বহু অট্টালিকাকে নিজের পেটে টেনে নেয়। মিল ব্যারাকের পুলিশ ট্রেনিং স্কুল চলে গেছে রাজারবাগে। এরও অনেক আগে ক্ষুরধার স্রোতে মিল ব্যারাকের কাছের আলমগঞ্জের ‘পাঠান কোট’ বা ‘পাঠান দুর্গে’র মতো অনেক সুরম্য কারুকাজওয়ালা অট্টালিকার আর দুর্গ হারিয়ে গেছে। ১৯৮৪ সালে মিল ব্যারাকের পূর্বাংশে স্থাপন করা হয়েছে ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুল।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের ঢাকা; Source: British Library

মোঘল আমল থেকেই নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঢাকা শহরের উন্নয়ন করা হয়েছিলো। কিন্তু সেই আমলের খরস্রোতা বুড়িগঙ্গার তীরে স্থায়ী বসতি স্থাপন করা ছিলো বেশ মুশকিল। তাই ঢাকার কমিশনার চার্লস থমাস বাকল্যান্ড বুড়িগঙ্গার তীরে বাধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। ১৮৬৪ সালের সেই সময়টাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নদীর তীরে যে বাড়িঘরগুলো আছে তাদের সামনের দিক অনেকখানি বাধাই করে দেওয়া হবে। এতে নদীর পাড় দেখতে অনেকটা স্ট্যান্ডের মতো দেখাবে। কেমন দেখাবে তার চেয়ে বড় কথা ছিলো এই বাধ কাজ করবে কিনা। বাঁধের শুরু হওয়ার পর দেখা গেলো নদীর পাড় পুরোপুরি বাধিয়ে দিলে শহরের লেভেল নদী থেকে বেশ উঁচুতে থাকবে। প্রথম বছর বাঁধ হাটিহাটি পা করে নর্থব্রুক হল ঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ঢাকার বেশ কিছু লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়- সরকারিভাবে পুরো বাঁধ নির্মাণের খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় ঢাকার ধনী ব্যক্তিরা বাঁধ নির্মাণে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেন।

বাঁধের পূর্ব অংশটুকু তৈরি হয়েছিলো রূপলাল আর রঘুনাথ সাহার যৌথ উদ্যোগে, পশ্চিমের অংশের কাজে সহায়তা করেছিলেন নবাব আবদুল গণি, বাদবাকি মাঝের অংশটুকু নির্মিত হয়েছিলো সরকারি খরচে। এভাবেই তৈরি হতে থাকে ‘বাকল্যান্ড বাঁধ’। পরে বিভিন্ন সময় প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাঁধের পরিধি বাড়তে থাকে।

ছবিতে ১৮৮০ সালে বাকল্যান্ড বাঁধের অংশবিশেষ; Source: en.banglapedia.org

তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঁধের যে অংশগুলো নির্মিত হয়েছিলো, সেগুলো কেউই কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেনি। তবে বাঁধের মালিকানা হস্তান্তর না করলে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়ে কর্তৃপক্ষের কাঁধেই। সময়ে সময়ে বুড়িগঙ্গা তার গতিপথ বদলেছে। বাকল্যান্ড বাঁধের ফ্রেমে বাঁধা যায়নি এই নদীকে। ১৮৬৪ সালে যে বুড়িগঙ্গা বয়ে যেত লালবাগ কেল্লা, রায়েরবাজার আর পিলখানা ঘাটের ধার ঘেঁষে, সময়ের সাথে সেই বুড়িগঙ্গা সরে যেতে থাকে দক্ষিণে। উত্তরে জমতে থাকা পলি জন্ম দিতে থাকে শহরের আরেকটি অংশকে।

১৮৮৫ সালে বুড়িগঙ্গার তীর অনেকটা এরকমই ছিলো; Source: The British Library

মোঘল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার সন্তান ঢাকার বয়স ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। বাকল্যান্ড বাঁধের তীরে গড়ে উঠা এই শহরের উন্নয়নের জঞ্জাল এই নদীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে। চামড়া শিল্পে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া রপ্তানিতে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই চামড়া শিল্পের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে অশোধিত বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়।

বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য; Source: Allison Joyce/Getty Images

সাম্প্রতিক এক হিসেবানুযায়ী পাঁচ শতাধিক ট্যানারীর ৪.৭৫ মিলিয়ন লিটার বিষাক্ত বর্জ্য এসে বুড়িগঙ্গাতে এসে পড়ছে। ট্যানারি থেকে বাদ যাওয়া চামড়ার অংশ থেকে শুরু করে বিষাক্ত সব ভারী ধাতুর শেষ ঠিকানা এই বুড়িগঙ্গা। অনেক কম মূল্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্ববাজারে নিজেদের স্থান ধরতে গিয়ে আমরা বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তুলেছি ট্যানারি, যার অপরিশোধিত বর্জ্যের প্রতিটি ফোঁটা এই নদীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের গ্রিন ক্রস আর ব্ল্যাকস্মিথ ইন্সটিটিউট এর দেওয়া তথ্য অনুসারে হাজারীবাগ এবং আশপাশের এলাকায় পৃথিবীর দূষিত স্থানগুলোর মাঝে পঞ্চম।

হাজারীবাগ এলাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত স্থানগুলোর একটি; Source: Allison Joyce/Getty Images

এই নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা হয়ে ওঠে অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক নগরী। পণ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহন, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সবই বাড়তে থাকে। জলযান আর গৃহস্থালি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২১,৬০০ ঘন মিটার কঠিন বর্জ্যের ঠাই হয় বুড়িগঙ্গায়।

শুধু কি তা-ই? ট্যানারি, জলযান আর গৃহস্থালি বর্জ্য! নদীর তীর জুড়ে গড়ে উঠেছে ছোট বড় পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ, রঙ আর বিষাক্ত দ্রব্যাদি এই নদীকে কোনো জলজ প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী করে দিয়েছে।

বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে রঙ; Source: thethirdpole.net

বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে যেখানে হেঁটে যাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে, সেখানে কি আদৌ কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব? সদরঘাট সহ বিভিন্ন এলাকার পানির নমুনা সংগ্রহ করে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে, বেড়ে গেছে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ। শুধু দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নয়, পানির বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের যত ধরনের সূচক আছে সব ধরনের সূচকেই বুড়িগঙ্গার পানি জলজ প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী। এই পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ আর ভারী ধাতুর অভয়ারণ্যের মধ্যে কোনো জলজ প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থেকে আসলেই কঠিন। মাছ তো দূরে থাক, সাধারণ অন্য কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না এই নদীতে।তবে শহর থেকে যত দূরে যাওয়া যায় এই নদীতে দূষণের মাত্রা ততই কম। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে দূষণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কমে আসে।

বুড়িগঙ্গার দূষিত পানির বর্তমান অবস্থা; Source: assets.irinnews.org

যে নদীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে ঢাকা শহর, সেই নদী যদি মরে যায় তাহলে ঢাকা কি বেঁচে থাকবে? নদীর তীর জুড়ে গড়ে উঠা সকল শিল্প কারখানাকে অবিলম্বে তাদের বর্জ্যকে পরিশোধন করে নদীতে ফেলতে বাধ্য করতে না পারলে এই নদীকে বাঁচিয়ে তোলা খুবই কঠিন। পলিথিনের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়া এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে তুলতে দরকার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের জমা হওয়া বর্জ্য অপসারণ করতে হলে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। নদীর তীর জুড়ে বসবাস করা কিংবা নদীর উপর অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষকে দূষণের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। অন্যথায় প্রতিদিন একটু একটু করে এই নদীর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে আর এই মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবে ঢাকার মানুষ।

Feature Image: collections.vam.ac.uk