Bangladesh > Heritage/Culture
Birds of Bangladesh
Lazminur Alam:
নলখাগড়ার নাড়ার ওপর চমৎকার ভঙ্গিতে বসে ছিল কালো মাথা ও কমলা বুকের সুদর্শন পাখিটি। রোদের আলোয় ওর কালো মাথাটি চকচক করছিল। পাখিটাকে কিছুটা ছটফটে স্বভাবের মনে হলো। হঠাৎই লাফ দিয়ে চরের বালুমাটিতে নেমে পড়ল। পোকা মুখে ফিরে এল নলখাগড়ার নাড়ার ওপর। আয়েশ করে খেল পোকাটি। কিছুক্ষণ পর আবারও পোকা ধরতে নিচে নামল। ওর ঠিক দু-তিন ফুট পাশেই অন্য একটি নলখাগড়ার নাড়ার ওপর একই ধরনের আরেকটি পাখি এসে বসল। তবে ওর দেহের রং বেশ মলিন, মাথা-বুকে নেই রঙের চাকচিক্য। তবে সে-ও একই কায়দায় পোকা শিকার করে ক্ষুধা মেটাতে লাগল।
এরা হলো বিরল সাদালেজি শিলাফিদ্দা (White-tailed Stonechat or White-tailed Bushchat)। সুদর্শন পাখিটি পুরুষ আর মলিন পাখিটি স্ত্রী। Muscicapidae গোত্রের এই পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Printicola leucura.
সাদালেজি শিলাফিদ্দা দৈর্ঘ্যে মাত্র ১২-১৪ সেন্টিমিটার। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের মাথা, মুখ ও গলা কালো। পিঠ ও দেহের ওপরটা কালচে-বাদামি। ঘাড়ের সুস্পষ্ট সাদা পট্টি গলার পাশ পর্যন্ত চলে গেছে। বুক গাঢ় কমলা ও পেট ফিকে সাদাটে। ডানার পট্টি, কোমর ও লেজের মাঝের অংশ সাদা। স্ত্রীর মাথা, ঘাড় ও মুখণ্ডল ধূসর-বাদামি। পিঠে ধূসর-বাদামি লম্বা দাগ। গলা সাদা। বুক-পেট-দেহতল ফিকে ও তাতে পীতাভ আভা। ডানার পট্টি সাদা, পালকের ফিকে প্রান্তদেশসহ লেজ ফিকে বাদামি। চোখ, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা ও নখ কালো। লেজের সাদা অংশ ছাড়া পুরুষটি দেখতে অনেকটা পুরুষ পাতি শিলাফিদ্দার (Common Stonechat) মতো, তবে মাথা ও পিঠ বেশি কালো। অন্যদিকে স্ত্রীটিও অনেকটা স্ত্রী পাতি শিলাফিদ্দার মতো তবে দেহের ওপরটা বেশি ধূসর ও নিচটায় কমলার আভা রয়েছে।
সাদালেজি শিলাফিদ্দা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, নেপাল, ভারত ও মিয়ানমারে দেখা মেলে। এ দেশে এরা মূলত পদ্মা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বাস করে। চরাঞ্চলের বড় বড় ঘাস, নলখাগড়া ও ঝোপঝাড়ে বসে থাকে। এরা ঘাস বা নলখাগড়ার ওপর থেকে মাটিতে নেমে কীটপতঙ্গ ধরে খায়।
মার্চ থেকে মে প্রজননকাল। পানির ধারে উঁচু ঘাস, নলখাগড়া বা ঝোপঝাড়ে শেওলা, শিকড়, লোম ও পালক দিয়ে বাটির মতো বাসা বানায়। স্ত্রী তাতে তিনটি ধূসরাভ-নীল ডিম পাড়ে। ডিম ফোটা ও প্রজননসংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য খুব একটা জানা যায় না।
Lazminur Alam:
ছোট্ট-সুন্দর পাখিটির নাম হলদেলেজি ফুলঝুরি। পেটের তলা থেকে শুরু করে লেজের তলাটা এদের টকটকে হলুদ। ঋতুভেদে এই হলুদের সঙ্গে হালকা কমলা রঙের আভা দেখা যায়। গলা, বুক ও শরীরের দুপাশজুড়ে লম্বালম্বি রেখা টানা; রং কালচে-বাদামি। মাথা ও পিঠ জলপাই-বাদামি, ডানা ও খাটো লেজের উপরিভাগ কালচে-বাদামি। আগার দিকটা সামান্য বাঁকানো ছোট ঠোঁটটির রং কালচে। পা ও আঙুল কালচে-সবুজ।
এরা মূলত টিলা ও পাহাড়ি বনের পাখি। সমতলের জাতভাইদের (অন্যান্য ফুলঝুরি) মতোই স্বভাব-চরিত্র। খাদ্যসহ বাসার ধরন-গড়ন একই রকম। বসন্ত-বর্ষায় গাছের ডালে থলের মতো বাসা বানায় এরা নরম তন্তুজাতীয় উপকরণ দিয়ে। যেমন মাকড়সার জাল-মস-ঘাস-তুলা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে দু-তিনটি।
মূল খাদ্য এদের নানান রকম ফল। পাকা আতা, বিলেতি গাব, সাগরকলা ইত্যাদি বড় ফল খেতে খেতে এরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঠোকরায়, ফল নড়ে, ব্যাপারটি ভৌতিক বলেই মনে হয় তখন।
উড়লেই ডাকে, বাসা বাঁধার সময়ও ডাকে। কণ্ঠস্বর ধাতব ‘ডিজিপ ডিজিপ’ ধরনের। এরা এবং এদের জাতভাই অন্যান্য ফুলঝুরি হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট পাখি। এদের খাদ্যতালিকায় আরও আছে পোকামাকড়সহ বিভিন্ন ফুলের মধুরেণু। এরা দুলে দুলে ওড়ে।
ইংরেজি নাম Yellow-vented Flowerpecker। বৈজ্ঞানিক নাম Dicaeum chrysorrheum। দৈর্ঘ্য ৯-১০ সেন্টিমিটার।
Lazminur Alam:
মোংলা থেকে যাত্রা করে পশুর নদ পেরিয়ে কুঙ্গা নদী। কুঙ্গা নদী তিনকোনা দ্বীপের কাছে যেখানে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে কোকিলমণির দিকে গেছে, সেই পয়েন্ট দিয়ে কিছুটা ভেতরে ঢুকতেই মরা পশুর নদ, খেজুরবাড়ি খাল, কাগাবগা খাল ও জাফা গাঙের মোহনা। পরপর দুই রাত চমৎকার এই মোহনায় আমাদের লঞ্চ নোঙর করল। এমন সুন্দর জায়গা সুন্দরবন ছাড়া আর কোথাও আছে কি না, জানা নেই। দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মোহনা থেকে বের হয়ে মরা পশুর নদ দিয়ে কিছুক্ষণ এগিয়ে একটি খালের সামনে লঞ্চ নোঙর করল। লঞ্চ থেকে আমরা ছয়জন ডিিঙতে উঠে বাঁ দিকের একটি সরু খালে ঢুকলাম। সুন্দর এই খালের নাম ক্ষেতখেরা।
খালে ঢোকার মুখেই নানা ধরনের মাছরাঙা দেখলাম। এ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম থোরমোচা মাছরাঙার দেখাও মিলল এখানে। এরা ইংরেজিতে Brown-winged Kingfisher নামে পরিচিত। Alcedinidae পরিবারের মাছরাঙাটির বৈজ্ঞানিক নাম pelargopsis amauroptera.
ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে থোরমোচা ৩৬ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৭.৬ সেমি ও ওজন ১৬২ গ্রাম (পুরুষ)। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা, ঘাড়, গলা, বুক, পেট ও লেজের তলা কমলা-বাদামি। পিঠ ও কোমর নীল। ডানা ও কাঁধ-ঢাকনি কালচে-বাদামি, তবে ডানার কিনারার পালকগুলো গাঢ় বাদামি। চোখ বাদামি ও চোখের পাতা ইটের মতো লাল। পা ও পায়ের পাতা লাল। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহে কমলার আধিক্য বেশি। ডানার পালক-ঢাকনি ও কাঁধ-ঢাকনির কিনারা ফিকে। দেহতল কালো, ঘাড়ে কালো ডোরা রয়েছে।
থোরমোচা সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি হলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় লোনাজলের বন ও সুন্দরবন ছাড়া দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু দিনে দিনে সুন্দরবন বিপন্ন হওয়ার কারণে এদের আবাস এলাকা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। আর সে কারণেই সম্প্রতি এদের IUCN বাংলাদেশ সংকটাপন্ন (Vunerable) বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সুন্দরবন এবং মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল পর্যন্ত এদের দেখা পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে বিশ্বে এরা প্রায়-বিপদগ্রস্ত (Near Threatened) বলে বিবেচিত।
পানির সামান্য ওপর দিয়ে দ্রুত উড়ে চলে। সচরাচর নদী-খালপাড়ের গাছের নিচু ডালে বসে পানিতে মাছ খোঁজে ও মাছ দেখলে দ্রুত পানিতে ঝাঁপ দিয়ে শিকার করে। মূল খাদ্য ছোট মাছ হলেও কাঁকড়া ও জলজ পোকমাকড় খেতে পারে।
এরা মার্চ-এপ্রিলে প্রজনন করে। এ সময় নদী-খালের খাড়া পাড়ে ৩০-৪০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ১০ সেন্টিমিটার চওড়া সুড়ঙ্গ তৈরি করে বাসা বানায় এবং তাতে চারটি গোলাকার সাদা ডিম পাড়ে। এরা ৫-৬ বছর বাঁচে।
Lazminur Alam:
এই বিরল পাখিটি হলো আমাদের আবাসিক বুনো কবুতর ধুমকল। ইংরেজি নাম Green Imperial Pigeon বা Northern Green Imperial Pigeon। Columbidae গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Ducula aenea।
ধুমকল বড় আকারের বুনো কবুতর। ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৪৩-৪৭ সেমি ও ওজন ৫০০ গ্রাম। পিঠ, ডানা ও লেজের উপরিভাগ ধাতব সবুজ। মাথা, ঘাড় ও দেহের নিচটা মেটে-ধূসর। লেজের তলা খয়েরি-লাল। নীলচে ঠোঁট ও গাঢ় লাল চোখ। পা ও পায়ের পাতা গোলাপি লাল থেকে প্রবাল লাল। নখ কালচে-ধূসর। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।
ধুমকল সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়-টিলাময় চিরসবুজ বনের পাখি। সচরাচর একাকী, জোড়ায় বা চার-পাঁচটির ছোট দলে দেখা যায়। তবে অনেক সময় ৫০-৬০টির বড় দলেও বিচরণ করতে পারে। গাছের পাতার ছাউনির নিচে এমনভাবে বসে থাকে, যেন সহজে চোখে পড়ে না। বিভিন্ন ধরনের বট, পাকুড় ও এ-জাতীয় ছোট ছোট পাকা ফল খেতে পছন্দ করে। এরা গাছে গাছেই বিচরণ করে। তবে পানি পান করতে ও লবণযুক্ত মাটি খেতে মাঝেমধ্যে মাটিতে নামে। অত্যন্ত দ্রুত ও সোজাসুজি উড়তে পারে।
মার্চ থেকে জুন প্রজননকাল। স্ত্রী সচরাচর একটি ও ক্বচিৎ দুটি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৫-১৯ দিনে। প্রায় ছয়-সাত বছর বাঁচে। দিনে দিনে আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ার কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
Lazminur Alam:
গ্রামবাংলার চেয়ে শহরে দেখা যায় বেশি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে দেখা মেলে হাজারে হাজার। ঊর্ধ্বাকাশে ওদের নানান রকম মনোমুগ্ধকর ডিসপ্লে যেন জঙ্গিবিমানের ডগফাইট। একজন প্রেমিকাকে ঘিরে দুই বা ততোধিক প্রেমিক পুরুষ যখন পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় মাতে বা ঝাঁক বেঁধে অনেক উঁচুতে উঠে দলবদ্ধভাবে ছন্দময় বৃত্তাকার ঘূর্ণনদৃশ্য দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। মূল খাদ্যস্থল এদের ময়লার ভাগাড় ও সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং এলাকা। ঢাকার পূর্বাঞ্চলের কাজলার বিশাল ডাম্পিং এলাকায় কয়েক হাজার পাখি জড়ো হয় রোজ। খাদ্যের তালিকায় আরও আছে মাছ, ব্যাঙ, অঞ্জন, কাঁকড়া, ইঁদুর, তেলাপোকা, ছোট পাখি ইত্যাদি। সুযোগ পেলে হাঁস-মুরগির ছানাও খায়। খাড়া ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে যেমন শূন্য থেকে মাটির দিকে নামতে পারে তিরবেগে, উঠতেও পারে তেমনি। দুর্দান্ত ডাইভার, দক্ষ শিকারি ও প্রখর দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন এসব শিকারি পাখি ঢাকা শহরে রোজই ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায়।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় উঁচু উঁচু অনেকগুলো লাইটিং টাওয়ার আছে, ওর ভেতরের যেকোনো দু-তিনটি টাওয়ারের মাথায় প্রতি মৌসুমেই বাসা করে এই পাখিরা। কিন্তু ডিম পেড়ে যেমন স্বস্তি নেই, তেমনি ছানারা বড় না হওয়া পর্যন্ত বাবা ও মা পাখির যেকোনোটিকে কড়া পাহারায় থাকতে হয়। কেননা, পাতিকাকেরা সেই বাসা বাঁধা শুরু করার আগ থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে ঝাঁক বেঁধে পেছনে লাগে এদের। উত্ত্যক্ত করে, বাসার উপকরণ সুযোগ পেলেই ফেলে দেয়। এমনকি ভুবন চিলেরা যাতে বাসা বাঁধতে না পারে, সে জন্য নিজেরাই একটা নকল বাসা বানায়। ডিমে তা দিচ্ছে? ছানা ফুটেছে? পাতিকাকেরা কত রকমভাবে যে জ্বালিয়ে মারে ওদের! ত্যক্তবিরক্ত হয়ে এই পাখিরা যখন ধাওয়া করে কাকেদের, তখন কাকেরা ছিটকে যায় ভয়ে।
পাখিটির নাম ভুবন চিল। মেঘচিল নামেও পরিচিত। বাসা করে টাওয়ার, উঁচু গাছের মগডালে ও অন্যান্য যুৎসই স্থানে। খোদ মতিঝিলের আকাশে ভুবন চিলদের ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যায়—কাঁচা ডালপালা-পাতা ঠোঁটে-পায়ে ধরে উড়ে চলে যখন বাসা বাঁধতে।
ভুবন চিলের ইংরেজি নাম Black Kite। বৈজ্ঞানিক নাম Milvus migrans। দৈর্ঘ্য ৬১ সেন্টিমিটার, ওজন ৬৩০-৯৪০ গ্রাম। একনজরে দেখতে কালচে-বাদামি পাখি, খয়েরির আভা থাকে। চোখে যেন কাজল লেপ্টানো। কালচে ঠোঁট। হলুদ পা। লেজের আকার ইলিশ মাছের লেজের মতো। বাসা করে হেমন্ত থেকে শীতের মধ্যে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটে ছানা হয় ২৯ থেকে ৩৩ দিনে।
Navigation
[0] Message Index
[#] Next page
[*] Previous page
Go to full version