জনপদটি বেশ শান্ত। সড়কে গাড়ি-অটোরিকশার উপস্থিতি তুলনামূলক কম। জায়গাটির নাম বেরাইদ। রাজধানীর বারিধারা নতুন বাজার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে এই শহরতলি। ৬০ হাজার মানুষের এই ইউনিয়ন সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বালু নদ-তীরবর্তী এ জনপদের ভূঁইয়াপাড়ায় একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। নাম ‘ভূঁইয়াপাড়া জামে মসজিদ’। মসজিদটির বয়স নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত। কারও দাবি এর বয়স ২০০ বছর, কেউ বলেন ৪০০। তবে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, মসজিদটি সুলতানি আমলে নির্মিত। ঢাকার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরেরও সে রকম মত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রকাশনা) মোহাম্মদ আতাউর রহমান গত শনিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসজিদটির কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। শিলালিপি পেলে মসজিদটি প্রতিষ্ঠার তারিখ, প্রতিষ্ঠাতার নাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মিলত। তবে গঠনশ্রেণি দেখে মনে হয়, এটি সুলতানি আমলের একটি প্রাচীন স্থাপনা। প্রসঙ্গত, বাংলায় সুলতানি আমল দ্বাদশ শতকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ১৫৩৮ সালে।
মোহাম্মদ আতাউর রহমান তাঁর একাধিকবার বেরাইদ এলাকা পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এখানকার কিছু প্রাচীন ভবনের ইটের গাঁথুনি দেখে মনে হয়, এখানে মুসলিম প্রশাসনের কার্যক্রম ছিল।
বেরাইদ মুসলিম হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক ছিলেন আবদুস সালাম। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের আগ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তিনি। খ্যাতিমান অভিনেতা আবুল হায়াতের শ্বশুর আবদুস সালাম ছিলেন এই জনপদের এক আলোকিত মানুষ। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ভূঁইয়াপাড়া জামে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে বংশপরম্পরায় এখানকার বাসিন্দা ও সাংবাদিক এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৮৫ সালে তিনি আবদুস সালামের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। আবদুস সালাম তাঁকে বলেন, তিনি ধারণা করেন, মসজিদটি আলাউদ্দিন হোসেন শাহর (১৪৯৫-১৫১৯) আমলে তৈরি। তাঁর মতে, মসজিদটির নির্মাণশৈলীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় অবস্থিত বাবা সালেহ মসজিদ (১৫০৫) ও সোনারগাঁওর গোয়ালদি শাহি মসজিদের (১৫১৯) মিল আছে।
বেরাইদের মানুষেরা জানালেন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গোটা মসজিদটি ভেঙে নতুন মসজিদ নির্মাণের কথা ওঠে। কিন্তু ঐতিহাসিক স্থাপনার গুরুত্ব বিবেচনায় অনেকেই দ্বিমত করেন। তখন আদি অংশটি অক্ষুণ্ন রেখে মসজিদটি পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করা হয়।বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের আদি অংশটুকু সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা দিয়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে।
বেরাইদ গণপাঠাগারের প্রকাশিত (২০১৫-এর ১ জানুয়ারি) পুস্তিকা থেকে জানা যায়, এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির উচ্চতা ১৭ ফুট ৬ ইঞ্চি। আদি গৃহের ভেতরকার আয়তন ১৬ ফুট বাই ১৬ ফুট। এর মেঝে ছিল লাল রঙের। পরবর্তী সময়ে তিন ইঞ্চি পুরু মোজাইক করা হয়। আদি অবস্থার ভেতরে তিন সারিতে একসঙ্গে ৩৩ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারতেন।
ওই পুস্তিকা থেকে আরও জানা যায়, মসজিদের পূর্ব দিকের মূল দেয়াল ভেঙে প্রথম সম্প্রসারণ করা হয় ১৯০৬ সালে। পুব দিকের দেয়ালে মসজিদে প্রবেশের একটিমাত্র দরজা ছিল। প্রথম পর্যায়ে পুব দিকে ১৬ ফুট বাই ১৬ ফুট বাড়ানো হয়। পরে ৫২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৪ ফুট প্রস্থের টিনের ছাউনির বারান্দা নির্মাণ করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৮২ সালে মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণের আদি দেয়াল ভেঙে উভয় দিকে বাড়ানো হয়। পাকা করা হয় পূর্ব দিকের টিনের ছাউনির বারান্দা। আদি দেয়ালের নিচে প্রাচীন আমলের ‘কড়ি’ পাওয়া যায়। চতুর্থ পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে পূর্ব দিকের বারান্দা দোতলা করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের কেবলা দেয়াল ও গম্বুজ অক্ষত আছে। কেবলার দেয়ালে রয়েছে মেহরাব। বর্তমানে মসজিদের পশ্চিম দিক ছাড়া অন্য তিন দিকের আদি দেয়াল অবশিষ্ট নেই।
মসজিদটির মোতওয়াল্লি হাজি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া জানান, দূর-দূরান্ত থেকে প্রায়ই মানুষ আসে মসজিদটি দেখতে।