‘আমার কাঙ্কের কলসি গিয়াছে ভাসি’ অথবা ‘পিতলের কলসি হলে’-এর মতো আরো অনেক জনপ্রিয় সংগীত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, নদী বা পুকুর থেকে পানি আনার কাজে মাটির কলসি অথবা ধাতব কলসির ব্যবহার আবহমানকাল থেকেই। এই সেদিন পর্যন্ত পানি বা অন্য কোনো পানীয় পানের জন্য ব্যবহার হতো মাটি অথবা ধাতু নির্মিত গ্লাস, মগ, বাটি ইত্যাদি। মাটি বা ধাতুর তৈরি কলসি বা পানির পাত্রের ব্যবহার আজকাল আর তেমন চোখে পড়ে না। সময়ের ব্যবধানে সেসব পাত্রের স্থানটি আজ দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকজাত কনটেইনার বা বোতল। পানি এবং অন্যান্য পানীয় দ্রব্য পান, সংরক্ষণ কিংবা বিপণনের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট, উত্পাদকদের চটকদার বিজ্ঞাপনে ‘বিশুদ্ধতার’ ধুম-ধাড়াক্কা প্রচারণা এবং বোতলজাত পানি বহন বা পান করার সুবিধা ইত্যাদি কারণে বর্তমানে প্লাস্টিক কনটেইনার বা বোতল ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একই সঙ্গে খাবার পানি বহন, সংরক্ষণ ও পান করার ক্ষেত্রে প্লাস্টিক নির্মিত এসব বোতল বা কনটেইনার পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। এই পুনর্ব্যবহার আবার দুভাবে হয়ে থাকে যথা— ১. ব্যবহূত প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইক্লিং করে পুনরায় প্লাস্টিকসামগ্রী তৈরি ২. ভোক্তাপর্যায়ে প্লাস্টিক কনটেইনার প্রথমবার ব্যবহারের পর পুনরায় একই কাজে অথবা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা। প্লাস্টিক কনটেইনারের এই বহুল ব্যবহার বা পুনর্ব্যবহার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত, তা নিয়ে কিন্তু রয়েছে নানা প্রশ্ন।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে প্লাস্টিক বোতল বা কনটেইনার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত প্লাস্টিক বোতল বা কনটেইনারে অনেক রাসায়নিক উপাদান বিদ্যমান থাকে, যার অনেকগুলোই স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। উদাহরণস্বরূপ বিসফেনল এ বা বিপিএ, থ্যালেটস, অ্যান্টিমনিট্রাইঅক্সাইড ইত্যাদি নাম উল্লেখযোগ্য।
বিপিএ স্ত্রী প্রজনন হরমোন ‘ইস্ট্রোজেন’-এর অনুকারী (mimics) হওয়ায় একে সাধারণত হরমোন হিসেবেই গণ্য করা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ফলে দেখা গেছে যে, বিপিএ বেশকিছু স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে জড়িত যেমন— ডিম্বাশয়ের ক্রোমোজোম ড্যামেজ, স্পার্ম উত্পাদন হ্রাস, দ্রুত বয়ঃসন্ধি শুরু হওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিবর্তন, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাস্কুলার ডিসঅর্ডার, স্থূলতা ইত্যাদি। এছাড়া বিপিএ স্তন ক্যান্সার, প্রোস্ট্যাট ক্যান্সার, বন্ধ্যত্ব, মেটাবলিক ডিসঅর্ডার ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বলেও কিছু গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। থ্যালেটস সাধারণত প্লাস্টিকের ফ্লেক্সিবিলিটি বা নমনীয়তা বাড়ানোর কাজ করে। কিছু প্লাস্টিক যেমন— পলিভিনাইল ক্লোরাইডে (পিভিসি) থ্যালেটস যোগ করার বিষয়টি এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিপিএর মতো থ্যালেটসেরও হরমোন অনুকারী প্রভাব আছে, যার কারণে এরাও হরমোনের স্বাভাবিক ও প্রাত্যহিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। বিপিএ ও থ্যালেটস উভয়েই গর্ভাবস্থায় অমরার মাধ্যমে ভ্রূণ ও মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে নবজাতকের শরীরে প্রবেশ করে তাদের ক্ষতি করতে সক্ষম। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, থ্যালেটস বিপিএর তুলনায় মানবদেহের জন্য খানিকটা কম ক্ষতিকর।
তাই বলে সব ধরনের প্লাস্টিক কনটেইনারে ক্ষতিকারক বিপিএ ও থ্যালেটস আছে, এমনটি কিন্তু নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ভোক্তা কী করে বুঝবেন তিনি যে প্লাস্টিক বোতল বা কনটেইনার ব্যবহার করছেন, তাতে বিপিএ কিংবা থ্যালেটস আছে কিনা? কোনো প্লাস্টিক কনটেইনার বা বোতলে বিপিএ কিংবা থ্যালেটস আছে কিনা, তা নির্ভর করে ওই কনটেইনার তৈরিতে ব্যবহূত প্লাস্টিকের ধরন বা টাইপের ওপর। বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক এবং তা দিয়ে তৈরি কনটেইনারের প্রচলিত টাইপগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করা হচ্ছে—
টাইপ ১. পলিইথিলিন টেরেফথ্যালেট বা পেট প্লাস্টিক
পেট প্লাস্টিক সাধারণত ডিসপোজেবল পানির বোতল তৈরিতে ব্যবহার হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রকারের জুস, সফট ড্রিংকস, মাখন, সালাদ ড্রেসিং, ভেজিটেবল অয়েল, মাউথ ওয়াশ, কসমেটিকস ইত্যাদির জন্য ব্যবহার্য বোতল বা কনটেইনার তৈরিতে পেট প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। পেট প্লাস্টিক ওজনে পাতলা, স্বচ্ছ ও মসৃণ হয়। সম্পূর্ণরূপে তরল ও বায়ুনিরোধী হওয়ার কারণে পেট প্লাস্টিক পানি এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য প্যাকেজিংয়ে ভীষণ রকমের জনপ্রিয়। বায়ুনিরোধী হওয়ায় পেট প্লাস্টিক অক্সিজেন অনুপ্রবেশে বাধা দেয়। এতে পেট বোতলের অভ্যন্তরে পানীয় বা তরল সহজে নষ্ট হয় না। টাইপ ১ প্লাস্টিক বোতলে ক্ষতিকারক বিপিএ বা থ্যালেটস না থাকলেও এগুলোর প্রস্তুতে অ্যান্টিমনি ট্রাইঅক্সাইড ব্যবহার হয়। অ্যান্টিমনি মানবদেহে সম্ভাব্য কার্সিনোজেন (ক্যান্সার উত্পাদনকারী) হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘ সময় ধরে পানীয়ের সংস্পর্শে থাকলে কনটেইনার থেকে অ্যান্টিমনি নিঃসরণ হয়। যত দীর্ঘ সময় ধরে পানীয় কনটেইনারের সংস্পর্শে থাকে, অ্যান্টিমনি নিঃসরণের সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় তাপ প্রয়োগেও পেট বোতল থেকে বিষাক্ত অ্যান্টিমনি নিঃসৃত হয়। তাই এসব পেট বোতল উচ্চ তাপমাত্রা থেকে দূরে রাখা অত্যাবশ্যক। উল্লেখ্য, টাইপ ১ বা পেট প্লাস্টিক কেবল ‘একবার ব্যবহারের নিমিত্তে’ (one time use only) প্রস্তুত করা হয়। ‘একবার ব্যবহারের’ ক্ষেত্রে পেট বোতল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
টাইপ ২. হাই-ডেনসিটি পলিইথিলিন
পলিইথিলিন সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত প্লাস্টিক। হাই-ডেনসিটি পলিইথিলিন পেট্রোলিয়াম থেকে তৈরি এক প্রকারের তাপসহ প্লাস্টিক। মিল্ক কনটেইনার, ডিটারজেন্ট বোতল, ফ্রিজার ব্যাগ, খেলনাসামগ্রী, নানা রকমের প্লাস্টিক মুদি ব্যাগ ইত্যাদি তৈরিতে টাইপ ২ প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। হাই-ডেনসিটি পলিইথিলিনগুলো তুলনামূলকভাবে শক্ত, অস্বছ ও ‘তাপসহ’ প্রকৃতির। এতে ক্ষতিকর বিপিএ অথবা থ্যালেটস কোনোটিই থাকে না। এ প্রকারের প্লাস্টিক ব্যবহারে তেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে বলে জানা যায়নি। যদিও কোনো কোনো গবেষণায় দেখানো হয়েছে, দীর্ঘসময় সূর্যালোকে রাখলে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে টাইপ ২ প্লাস্টিক থেকে ননাইলফেনল নিঃসৃত হয়। টাইপ ১-এর তুলনায় টাইপ ২ কনটেইনার খাদ্য ও পানীয়ের জন্য অধিকতর নিরাপদ মনে করা হয়।
টাইপ ৩. পলিভিনাইল ক্লোরাইড
টাইপ ৩ প্লাস্টিক কনটেইনারগুলো ফ্রুট জুস, রান্নার তেল ইত্যাদির জন্য ব্যবহার করা হয়। পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) এক প্রকারের ‘তাপসহ’ পলিমার। প্লাস্টিসাইজ করা না-করার ওপর ভিত্তি করে টাইপ ৩ প্লাস্টিক নমনীয় ও অনমনীয় এ দুই প্রকারের হয়। সাধারণত পিভিসিকে নমনীয় করার জন্য থ্যালেটস ব্যবহার করা হয়, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। প্লাস্টিসাইজড পিভিসি পাইপ ও সাইডিংগুলোয়ও থ্যালেটস রয়েছে। পিভিসিতে অনেক বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যেমন— বিপিএ, থ্যালেটস, লেড, ডাইঅক্সিন, মারকারি ও ক্যাডমিয়াম। পিভির পুরো জীবনচক্র যথা— উত্পাদন, ব্যবহার ও ডিসপোজাল মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশদূষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যার কারণে পিভিসির ব্যবহার অনেকাংশে কমে গেছে। তবে মূল্যসাশ্রয়ী ও বহুমুখী ব্যবহার উপযোগিতার কারণে ভোক্তাপণ্যের বেলায় পিভিসি এখনো অনেক সমাদৃত। বিষাক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশদূষণের কারণে পিভিসি প্লাস্টিকের ব্যবহার বর্জনীয়।
টাইপ ৪. লো-ডেনসিটি পলিইথিলিন
টাইপ ৪ প্লাস্টিক পেট্রোলিয়াম দিয়ে তৈরি এক প্রকারের ‘তাপসহ’ পলিমার, যা স্বচ্ছ অথবা অস্বচ্ছ উভয় প্রকারের হতে পারে। লো-ডেনসিটি পলিইথিলিন নমনীয় ও অনমনীয় কিন্তু ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়ে থাকে। হিমায়িত খাদ্যদ্রব্য প্যাকেজিং এবং জুস ও মিল্ক কার্টনস প্রস্তুতিতে এসব প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। কনটেইনার বা বোতলে রাখা তরলের সংস্পর্শে এগুলোর কোনো ক্ষয় হয় না। টাইপ ৪ প্লাস্টিক কনটেইনারগুলোয় মানবদেহের কোনো প্রকার ক্ষতিকারক উপাদান না থাকায় খাদ্য ও পানীয় সামগ্রীর জন্য এগুলোর ব্যবহার নিরাপদ।
টাইপ ৫. পলিপ্রপাইলিন
পলিপ্রপাইলিন এক প্রকারের প্লাস্টিক পলিমার, যা সাধারণত শক্ত ও আধা স্বচ্ছ, মজবুত, উচ্চ তাপসহ এবং জলীয় বাষ্পনিরোধী। এগুলো পলিইথিলিনের চেয়ে অধিক শক্ত ও তাপসহ। পলিপ্রপাইলিন সাধারণত দই, ওষুধ, পানীয়, কেচাপ ইত্যাদি প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহার হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, পলিপ্রপাইলিন প্লাস্টিক থেকে খাদ্য বা পানীয়ে কোনো ক্ষতিকর উপাদান নিঃসৃত হয় না। অধিকাংশ পলিপ্রপাইলিন প্লাস্টিক মাইক্রোওয়েভযোগ্য এবং ডিশ ওয়াশার দিয়ে ওয়াশ করলেও এগুলোর কোনো ক্ষতি হয় না। টাইপ ৪ প্লাস্টিকের মতোই পলিপ্রপাইলিন কনটেইনারে কোনো প্রকার ক্ষতিকারক উপাদান না থাকায় খাদ্য ও পানীয়সামগ্রীর জন্য এগুলোর ব্যবহার মানবদেহের জন্য নিরাপদ বলে মনে করা হয়।
টাইপ ৬. পলিস্টাইরিন
পলিস্টাইরিন এক প্রকারের পেট্রোলিয়াম বেজড প্লাস্টিক। পলিস্টাইরিন প্রস্তুতিতে ‘বেনজিন’ ব্যবহার করা হয়, যা মানবদেহের জন্য কার্সিনোজেন হিসেবে পরিচিত। প্যাকেজিং সামগ্রী ও ইনসুলেশন তৈরিতে পলিস্টাইরিন বহুল ব্যবহার হয়। স্টাইরিন স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় এক্সপোজারের ফলে অল্প পরিমাণ স্টাইরিনও নিউরোটক্সিক, হেমাটোলজিক্যাল, সাইটোজেনেটিক ও কার্সিনোজেনিক ইফেক্ট দিয়ে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) স্টাইরিনকে মানবদেহের সম্ভাব্য কার্সিনোজেন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পলিস্টাইরিন কনটেইনার থেকে ‘স্টাইরিন’ খাদ্যদ্রব্যে নিঃসৃত হয়। রক্ষিত খাদ্যদ্রব্য গরম ও তৈলাক্ত হলে স্টাইরিন নিঃসরণ ত্বরান্বিত হয়।
টাইপ ৭. পলিকার্বনেট
উল্লিখিত টাইপ ব্যতীত অন্য সব প্লাস্টিককে টাইপ ৭ প্লাস্টিক হিসেবে লেবেল করা হয়। সাধারণত টাইপ ৭ প্লাস্টিক বলতে পলিকার্বনেটকে বোঝানো হয়। পলিকার্বনেট কনটেইনার বিপিএ দিয়ে তৈরি। তাই এগুলোর মধ্যে যেসব পানীয় বা খাদ্যদ্রব্য রাখা হয়, তাতে কনটেইনার থেকে বিপিএ নিঃসৃত হয়। একাধিক গবেষণায় বিপিএর স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রমাণিত হওয়ায় টাইপ ৭ বা পলিকার্বনেট প্লাস্টিক ব্যবহার সম্প্রতি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পলিকার্বনেট মূলত ভোক্তাসামগ্রী প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহার হয়। বেবি বোতল, ৩ ও ৫ গ্যালন বোতল (পুনর্ব্যবহারযোগ্য) ইত্যাদিতে টাইপ ৭ প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে টাইপ ৭ বা পলিকার্বনেট প্লাস্টিক ব্যবহার অনিরাপদ।
প্লাস্টিক বোতল পুনর্ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি
প্লাস্টিক পানির বোতল পুনর্ব্যবহারে উদ্বেগের অন্যতম দুটি কারণ— ব্যাকটেরিয়ার সম্ভাব্য দূষণ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণ। পুনর্ব্যবহারকালে হাত ও মুখের মাধ্যমে প্লাস্টিক বোতল উচ্চমাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে আসে এবং আর্দ্রতার কারণে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। ‘কানাডিয়ান জার্নাল অব পাবলিক হেলথ’-এ প্রকাশিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালিত এক গবেষণার ফলে এমনটিই দেখানো হয়েছে। পানির বোতল পুনর্ব্যবহার করে এমন শিক্ষার্থীদের ৬৪ জনের পানিতে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। পুনর্ব্যবহারকল্পে প্লাস্টিক বোতল উষ্ণ সাবান পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে নেয়া হয়। এ ধৌত প্রক্রিয়া, ঝাঁকুনি, ব্যবহূত ক্লিনিং ডিটারজেন্ট ইত্যাদির কারণে বোতল থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান নিঃসৃত হয়, যা অনেক সময় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। প্লাস্টিক বোতলে পানি রেখে বারবার ফ্রিজিংয়ের ফলেও বোতল থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক নিঃসরণ হতে পারে। এছাড়া একই বোতল দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করলে পেট বোতল বা বিপিএ আছে, এমন প্লাস্টিক থেকে বোতলজাত পানিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান অবমুক্ত হয়। এসব কারণে সার্বিক বিবেচনায় প্লাস্টিক বোতল ‘পুনর্ব্যবহার’ না করাই বাঞ্ছনীয়।
কোনো প্লাস্টিক কনটেইনারে ক্ষতিকারক বিপিএ বা থ্যালেটস আছে কিনা তা নির্ভর করে ওই প্লাস্টিকের টাইপের ওপর। প্লাস্টিক কনটেইনারের গায়ে ত্রিকোণাকৃতির ‘রিসাইক্লিং কোড প্রতীক’ থাকে, যার অভ্যন্তরে একটি নম্বর দেয়া থাকে, যা ওই প্লাস্টিকের টাইপ নির্দেশক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীকটি থাকে প্রডাক্টের তলায় (bottom)। এ ‘রিসাইক্লিং কোড’ নম্বর দেখে ব্যবহূত প্লাস্টিকটি কোন টাইপের, তা জানা যায়। সাধারণ বিবেচনায় বলা যায়— ২, ৪ ও ৫ নং প্লাস্টিকগুলো তুলনামূলকভাবে অধিকতর নিরাপদ। এছাড়া উল্লিখিত আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আপনি যে টাইপের প্লাস্টিকই ব্যবহার করুন না কেন, উচ্চ তাপমাত্রা (মাইক্রোওয়েভ) ও শক্তিশালী ডিটারজেন্ট এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে পেট বোতলের বেলায় পুনর্ব্যবহার এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়। শেষ কথা, যেহেতু এটি কখনো নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, আপনি যে প্লাস্টিক কনটেইনার বা বোতল ব্যবহার করছেন, তা থেকে ক্ষতিকারক কোনো কেমিক্যালস বা উপাদান অবমুক্ত হবে না, সেহেতু সম্ভব হলে প্লাস্টিক কনটেইনার বা বোতল সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলাই অধিকতর নিরাপদ। এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে কাঁচ, সিরামিক, মরিচারোধক ইস্পাত, সিলিকন অথবা বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। যদি নিতান্তই পানি বহনের কাজে বড় প্লাস্টিক কনটেইনার ব্যবহার করতে হয়, তবে বাড়ি এসে তা থেকে পানি দ্রুত অন্য কোনো নিরাপদ পাত্রে স্থানান্তর করা উচিত বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
Source: লেখক: অধ্যাপক ও প্রধান, ফার্মেসি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়