আমাদের কি বিখ্যাত ব্যাক্তিদের জীবনী শিক্ষা নেওয়া উচিৎ?

Author Topic: আমাদের কি বিখ্যাত ব্যাক্তিদের জীবনী শিক্ষা নেওয়া উচিৎ?  (Read 1569 times)

Offline Nazia Nishat

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 132
  • Test
    • View Profile
আমরা প্রায়ই বিখ্যাত ব্যাক্তিদের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকি। আমাদের কি পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত নবীদের জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ? এটাই ডঃ ইউসুফ মাহাবুবুল ইসলাম এর প্রশ্ন।

আমরা প্রায়ই মহিলা বা পুরুষ নির্বিশেষে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের জীবনী বা আত্মজীবনী পড়ে থাকি।  কেন পড়ি?  এর এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে।  আমরা তাঁদের ব্যক্তিত্ব থেকে শিক্ষা নিতে পারি, আমরা জানতে পারি তারা কি অবদান রেখেছেন,  কিভাবে তাঁরা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেছেন,  তাঁরা মানুষের সাথে কিরকম আচরণ করেছেন এবং অন্যদের প্রভাবিত করেছেন অথবা তাঁরা কেন বিখ্যাত হয়েছেন।  আমরা কাদের বিষয়ে অধ্যয়ন করবো, এই প্রসঙ্গে বলা যায় কুরআনে যেসব ব্যক্তিদের ব্যাপারে বলা হয়েছে আমরা কি তাঁদের সম্পর্কে শিখবো?
বাইবেলের জেনেসিস ৩৭-৫০ এ ৪০০০ বছর{১} আগে বসবাসকারী নবী ইউসুফ (আঃ) অধিকাংশ কাহিনী বর্ণিত আছে।  ১৮৭১ সালে উইলিয়াম ব্রুস তার বই  The story of Joseph and his brethren: its moral and spiritual lessons. এ গুরুত্ব সহকারে লিখেছিলেন যে-
“নবী ইউসুফ (আঃ) এর  কাহিনী বাইবেল অথবা অন্যান্য বই থেকে পাওয়া সবচেয়ে সুন্দর ও নির্দেশনামূলক কাহিনী।  ওল্ড টেস্টামেন্টে যেসব চরিত্রের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে  নবী ইউসুফ (আঃ) এর চরিত্রকে সর্বাপেক্ষা নিখুঁত বলা হয়েছে,...মুসা (আঃ) ছিলেন নম্র, দাউদ (আঃ) ছিলেন উদার, সোলাইমান (আঃ) ছিলেন জ্ঞানী, কিন্তু প্রত্যেকের কিছু ত্রুটি ছিল যা তাঁদের গুণাবলীর দীপ্তিকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছিলো।  ইউসুফ (আঃ) এর এইসব ভাল গুণাবলী ছিল, কিন্তু কেউ তাঁকে দোষী প্রমাণ করতে পারেনি।  আমরা অবশেষে এটা বলবনা যে, তিনি ত্রুটিমুক্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি  অধিকাংশ মানুষের থেকে কম ত্রুটিযুক্ত ছিলেন।......”{১}
পবিত্র কুরআনেও নবী ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।  যদিও কুরআনে যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে তাতে কিছুটা পার্থক্য আছে,তবে কুরআনেও এর নির্দেশনামূলক মান নিশ্চিত করা আছে,
“প্রকৃতপক্ষেই ইউসুফ এবং তার ভাইরা সত্য অনুসন্ধানকারীদের জন্য চিহ্ন বা নিদর্শন স্বরূপ।” [১২:৭]
কুরআনে সম্পূর্ণ সূরা ১২ একান্তভাবে ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছে এবং তাঁর নামেই নামকরন করা হয়েছে , এতেই বুঝা যায় সৃষ্টিকর্তা ইউসুফ (আঃ) এর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে কত গুরুত্ব দিয়েছেন। এই গল্পটি ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে।  ইউসুফ (আঃ) এর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর ধৈর্য্য ও চরিত্রের পরিচয় এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি ছিলেন ছোট ও সৎ ভাই ,তিনি ছিলেন বড় সৎ ভাইদের ঘৃণার পাত্র, এবং বাবার আদরের ছেলে,যাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো কূপের ভিতর, যাকে দাস হিসেবে বিক্রয় করা হয়েছিলো, যিনি দাসত্ব করেছিলেন,তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিলো এবং অবশেষে তাঁর হাতে মিশরের শাসন কাজ তুলে দেওয়া হয়।  তাঁর জীবনের কষ্ট থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় যে- তিনি কি ভূমিকা পালন করেছেন এবং সবশেষে আল্লাহ্‌র হাতেই সকল ক্ষমতা নিহিত, তিনি রক্ষাকর্তা এবং পুরষ্কারদাতা।
সৎ ভাইরা ইউসুফ (আঃ) কে কূপের তলদেশে ফেলে রাখার একটা চক্রান্ত করলো।  কূপ থেকে পানি উঠানোর সময় এক ক্রীতদাস ব্যবসায়ী তাঁকে আবিষ্কার করলো।  ব্যবসায়ী ইউসুফ (আঃ)কে খুঁজে পাওয়ার পর সৎ ভাইরা তাঁকে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করে দিলো!  তারা তাদের বাবার সাথে প্রতারণা করার জন্য ইউসুফ (আঃ) এর জামায় ছাগলের রক্ত মেখে নিল এবং বাড়িতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলল যে, নেকড়ে ইউসুফকে খেয়ে ফেলেছে,
    “তারপর তারা রাতের প্রথম প্রহরে কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে আসলো।”[১২.১৬]
১২.১৭“তারা বললঃ বাবা, আমরা একে অন্যের সাথে  দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম এবং ইউসুফকে মালপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। অতঃপর তাকে নেকড়ে  খেয়ে ফেলে। কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী।”
এখানে আমরা দেখতে পাই যে ইউসুফ (আঃ) এর  প্রতি ঘৃণা থেকে ভাইরা তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে এবং তাঁদের বাবার জন্য একটি মনগড়া গল্প তৈরি করে। এই যুগেও কি  সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারে এই একই ধরণের ঘটনা ঘটে থাকে? আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে সমানভাবে সৃষ্টি করেছেন।  আমরা সবাই যেন একে অপরের  ভাইএর মতো।  প্রত্যেক সৃষ্ট মানুষের সমান অধিকার আছে নিজের জীবন এবং আল্লাহ্‌র দেয়া নেয়ামত উপভোগ করার।  এভাবে কাউকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে আমরা সৃষ্টিকর্তার দেয়া বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতি অবিশ্বাস প্রদর্শন করছি। যখন আমরা অযথাই অন্য এক ভাইএর জীবন কেড়ে নেই তখন সৃষ্টিকর্তার কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিৎ।

১২.১৮ “তারা ইউসুফের জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে নিল।  ইয়াকুব বললেন “এটা হতে পারেনা, বরং তোমরা নিজেদের  মনগড়া গল্প বলছ।  যাইহোক তোমরা যা দাবী করছ তার জন্য আমার ধৈর্য্য ধরাই একমাত্র পথ।  তোমরা যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্য স্থল।””

তাদের বাবা ইয়াকুব তাদের সাজানো গল্প বিশ্বাস করলেননা।  যাইহোক, যেহেতু সব ভাইরা এই গল্পকে সমর্থন করলো তিনি বুঝতে পারলেন না কিভাবে আসল ঘটনা জানতে পারবেন। সুতরাং তিনি ধৈর্য্য ধারণ করলেন এবং আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস রাখলেন।

 “হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই  আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।”[২.১৫৩]
১২.১৯ “তারপর সেখানে এক দল ভ্রমণকারী এল। অতঃপর তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করল। সে কূপের ভিতর বালতি ফেলল। সে বললঃ “কি আনন্দের কথা। এ তো একটি কিশোর!”   তারা তাঁকে পন্যদ্রব্যের মতো গোপন করে ফেলল(যাতে তাঁকে দাস হিসেবে বিক্রয় করা যায়)!  আল্লাহ খুব জানেন যা কিছু তারা করেছিল!”
এক লোক কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে ইউসুফ (আঃ) কে খুঁজে পেলো।  যাইহোক ইউসুফ (আঃ) এর ভাইরা দেখছিল কূপ থেকে কি বের করা হচ্ছে।  যখন তারা দেখল যে ভ্রমণকারী দল ইউসুফ (আঃ) কে নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে, তখন তারা আসলো এবং টাকা দাবী করলো-তারা তাঁকে কে দাস হিসেবে বিক্রি করতে সম্মত হল। ভাই হিসেবে ইউসুফ (আঃ)কে তারা কত সামান্য মূল্য দিলো!
১২.২০ “তারা তাঁকে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করে দিলো এবং তাদের অনুমানে ইউসুফের মূল্য কত সামান্য ছিল!”
ইউসুফ (আঃ) এর ভাইরা ইউসুফের প্রকৃতি বুঝলনা এবং তাঁর বিশ্বাসের শক্তিকেও বুঝলনা।  এখানে আমরা দেখতে পাই যে সৃষ্টিকর্তা ভাইদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হতে দিলেন এবং এভাবে তিনি তাদের প্রকৃতি দেখিয়ে দিলেন।  একই সময়ে তিনি নিশ্চিত করলেন যে ইউসুফ (আঃ) নিরাপদে থাকবেন এবং একদিন  তাঁর ভাইদের  শিক্ষা দিবেন।
১২.২১ “মিসরে যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করল, সে তার স্ত্রীকে বললঃ একে সম্মানের সাথে (আমাদের মাঝে) রাখ। সম্ভবতঃ সে আমাদের কাজে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করে নেব। এমনিভাবে আমি ইউসুফকে এদেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম এবং এ কারণে যেন তাঁকে ঘটনার  ব্যাখ্যা করার  শিক্ষা দেই।(উদাহরণস্বরূপ স্বপ্ন )। আল্লাহ নিজ কাজের উপর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ রাখেন , কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”
এই গল্পে আমরা দেখি যে সৃষ্টিকর্তা ইউসুফ (আঃ) কে রক্ষা করলেন এবং অবশেষে তাঁকে মিশরের শাসনকর্তা বানালেন। অনেক কষ্ট, ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা প্রদর্শনের পর আল্লাহ্‌ তাঁকে রাজক্ষমতা দান করেন।  আল্লাহ্‌ কুরআনের ৯৪ নং সূরায় বলেছেন,

“আমি কি আপনার বক্ষ প্রসারিত করে দেইনি (আপনার হৃদয়ে খুশি দেইনি)? এবং আমি লাঘব করেছি আপনার বোঝা, যা ছিল আপনার জন্যে অতিশয় দুঃসহ। আমি আপনার খ্যাতিকে  সমুচ্চ করেছি। কিন্তু দেখুন কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে; নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। অতএব,  আপনি যখন অবসর পান তখনও পরিশ্রম করুন আপনার পালনকর্তাকে খুশি করার জন্য।” [৯৪:১-৯৪:৮]
আমরা নিজের জীবনের জন্য কি শিক্ষা নিতে পারি? আল্লাহ্‌  ধৈর্য্য ধরার জন্য শুধু পুরষ্কারই দেন না বরং আমাদের মর্যাদাও উন্নত করেন তাদের সামনে যারা সৃষ্টিকর্তাকে মূল্য দেয়না। এত কষ্টের ভিতরেও ইউসুফ (আঃ) সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর বিশ্বাস হারাননি।  বরং তিনি ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সাথে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন এবং তাঁর প্রতি সর্বদা কৃতজ্ঞ ছিলেন । আমাদের জীবনে সৃষ্টিকর্তা কতবার কষ্টকে স্বস্তিতে রূপান্তর করেছেন। যাইহোক আমরা কি কৃতজ্ঞ ছিলাম এবং তাঁকে খুশি করার চেষ্টা করেছি?


----------
{Notes}:
{1} https://archive.org/details/storyjosephandh00brucgoog