অধ্যা. ড. মীজানুর রহমান রচিত “বাজারজাতকরণের সামাজিক সমালোচনা” প্রবন্ধের সমালোচনা

Author Topic: অধ্যা. ড. মীজানুর রহমান রচিত “বাজারজাতকরণের সামাজিক সমালোচনা” প্রবন্ধের সমালোচনা  (Read 1266 times)

Offline Maruf Reza Byron

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 62
  • Test
    • View Profile
[মোঃ নজীবুল্লাহ খান সম্পাদিত ‘বাজারজাতকরণ’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠাঃ ৩-৫]
 
 
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। নামেই যাঁর পরিচয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের নামকরা শিক্ষক। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। অনেক গবেষণা নিবন্ধের রচয়িতা আমাদের মীজান স্যার পিএইচডি হোল্ডার, ফুল প্রফেসর। একই সাথে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকৃ্ত করে আছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় এই অধ্যাপক মার্কেটিং সাব্জেক্টের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে সারা দেশে পরিচিত। ভক্তকূল এবং সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাপ্রত্যাশীদের কাছে তিনি “বাংলাদেশের কটলার” হিসেবে খ্যাত। তো, এহেন বিখ্যাত ডাকসাইটে অধ্যাপকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে মোঃ নজীবুল্লাহ খান সম্পাদিত একেবারেই গড়পড়তামানের মাসিক পত্রিকা ‘বাজারজাতকরণ’ এর সেপ্টেম্বর ২০১৩ সংখ্যায়, পৃষ্ঠাঃ ৩-৫। এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। বিখ্যাত লোকেরা মাঝে মাঝে যদি অখ্যাতদের না দেখেন তাহলে তাঁদের মাহাত্ম বোঝা যাবে কিভাবে!
 
যাহোক। আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য অবশ্য কাউকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করা নয়। বরং বাংলাদেশে “মার্কেটিং থিংকার”দের সম্পর্কে একটা বস্তুনিষ্ঠ পর্যা্লোচনা দাঁড় করানোর উদ্দেশ্য নিয়েই আমার এই প্রচেষ্টা। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মার্কেটিং সাব্জেক্টের যারা ‘গুরু’ হিসেবে পরিচিত তাঁদেরই একজনের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা মূল্যায়নের মাধ্যমে এই দেশের মার্কেটিং চিন্তা-চর্চা্র স্বরূপ অণ্বেষণ করা। বলে রাখা ভালো, মীজান স্যারকে ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। কিন্তু একই সাথে তাঁর চিন্তা-কাজের আমি একজন নির্মোহ সমালোচক। আমি জানি না স্যার আমার এই লেখা কিভাবে নিবেন। যদি আমার লেখা বা লেখার কোন অংশ তাঁকে কষ্ট দিয়ে থাকে সেজন্য আমি আগেভাগেই তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
 
এখন লেখার কথায় আশা যাক। লেখার শিরোনাম থেকেই এর বিষয়বস্তু পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আর তা হলো মার্কেটিং ও সমাজের সম্পর্ক। লেখাটার সম্ভবত আরো কিস্তি আগের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। আমার হাতে শুধু একটা অংশই আছে এবং তা শেষ অংশ। আগের অংশ না থাকার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই আমি আমার মতামত তুলে ধরতে চাই।
 
লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীর মনোযোগসহকারে পড়ে লেখাটা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে আমার যা উপলব্ধি হয়েছে তা হলোঃ এটা স্ববিরোধী বক্তব্যে ঠাসা নিতান্তই দুর্বল অনুবাদনির্ভর গতানুগতিক ক্লাসনোটধর্মী একেবারেই অগভীর দৃষ্টি্ভঙ্গিসম্মৃদ্ধ একদম কাঁচা একটা লেখা যেখানে চিন্তার স্বকীয়তার ছাপ পুরোপুরি অনুপস্থিত। বিশেষত লেখকের দুর্বল ভাষাজ্ঞান আমাকে দারুণভাবে আহত করেছে। লেখাটা নিয়ে আমার সার্বিক মূল্যায়নের পক্ষে কিছু যুক্তি-তর্ক নীচে উল্লেখ করলাম।
 
লেখার একদম শুরুতেই অধ্যাপক মীজান বলেছেন, “বাজারজাতকরণ সমাজে অনেক ক্ষতিকর মাত্রা সংযোজন করছে বলে প্রায়ই অভিযোগ শুনা যায়।” এ কথার মানে কি? এই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে কি আপনার মনে কোন সন্দেহ আছে, স্যার? বাজারজাতকরণ অবশ্যই “সমাজে অনেক ক্ষতিকর মাত্রা সংযোজন করছে” - এই কথা যদি আপনি জোর গলায় না বলেন তাহলে আর কে বলতে পারবে! কিন্ত আপনি যদি বলেন, “অভিযোগ শুনা যায়” তাহলে আপনার বক্তব্য আপনার ভাষাজ্ঞানের মতই অনেক দুর্বল শোনায়, তাই না স্যার?
 
স্যার, অত্যন্ত লজ্জার সাথে বলতে হচ্ছে আপনার লেখার পরতে পরতে চিন্তার অগভীরতার ছাপ স্পষ্ট। যেমন লেখাটার তিন নম্বর প্যারায় আপনি বলছেন, “বাজারজাতকারীরা নতুন অভাব সৃষ্টির চেয়ে পুরাতন অভাব পূরণের জন্যে বিজ্ঞাপন প্রচার করে বেশি সফল হয়ে থাকে।” কিভাবে বলছেন আপনি এ কথা? কোন গবেষণা করেছেন কি আপনি? অথবা অন্য কারও লেখা থেকে কি পেয়েছেন ধারণাটা? যদি পেয়ে থাকেন তবে সেটা কার লেখা, কোন্ লেখা – তা কিন্তু উল্লেখ করেন নি, স্যার! এটা কি ঠিক হলো? আর ‘সফল’ হওয়া বলতে আপনি আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন তাও কিন্তু পরিষ্কার করেন নি, স্যার!
 
ঠিক পরের প্যারাতেই এরকম ঢালাও মন্তব্য পাওয়া গেল আবার। এবার আপনি বিশ্ব ইতিহাসের সারসংক্ষেপ করে ঘোষণা করেছেন, “যে জাতি যত বেশি বস্তুকেন্দ্রিক হয়েছে তার পিছনে বাজারজাতকরণ ছাড়াও অন্যান্য উপাদান আরো বেশি ভূমিকা রেখেছে।” কোথায় পেলেন আপনার এই তত্ত্ব! অন্য কোন লেখকের লেখার অনুবাদ মনে হচ্ছে। লেখার প্রয়োজনে অন্য কারো লেখার সাহায্য নেয়া খারাপ কিছু না। তবে সেটা স্বীকার করতে না চাওয়া অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির দোষে দুষ্ট হতে বাধ্য। আর আপনার এই কথা দিয়ে কি আপনি বস্তুকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি্র জন্য মার্কেটিং এর দায় কমাতে চাচ্ছেন?
 
আপনার লেখার সবচেয়ে কৌ্তুককর অংশ এর পরেই শুরু। সমাজে “সাংষ্কৃতিক দূষণ” সৃষ্টি্র পেছনে বাজারজাতকরণের ভূমিকা আলোচনা করতে যেয়ে আপনি একাধিকবার বিজ্ঞাপন সম্পর্কে সমালোচনামুখর হয়েছেন। আবার একটু পরে বিজ্ঞাপনকেই “টিভির সবচেয়ে ভাল প্রোগ্রাম” হিসেবে অভিহিত করেছেন। কী হাস্যকর স্ববিরোধীতা!
 
বিজ্ঞাপন প্রসংঙ্গে আপনার স্ববিরোধীতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ঠিক এর পরেই। দ্বিতীয় পৃষ্ঠা্র প্রথম প্যারার শেষে গণমাধ্যমের উপর বিজ্ঞাপণের প্রভাব আলাপ করতে গিয়ে আপনি রায় দিচ্ছেন, “বিজ্ঞাপন থেকে প্রচুর আয় হচ্ছে বলেই গণমাধ্যমগুলো কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করছে, ...”। আবার, এই কথা বলার ঠিক চার লাইন পরেই বিজ্ঞাপনের সমালোচনা করে বলছেন, “গণমাধ্যমগুলোর উপর বিজ্ঞাপন দাতাদের কর্তৃত্ব এত বেশি যে এর দ্বারা মাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।” এটাকে ঠিক কী বলা যাবে, স্যার! চিন্তার দৈনতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা কি বোঝা যাচ্ছে?
 
তো, এই হলো “বাংলাদেশের ফিলিপ কটলার” এর অবস্থা। মনে রাখতে হবে অন্যদের অবস্থা আরো খারাপ, বৈ ভালো নয়। আমরা কোন যুগে বাস করছি তা কি বোঝা যাচ্ছে, পাঠক?
 
বাংলাদেশে মার্কেটিং থিংকারের বড়ই অভাব। ভাসাভাসা আলোচনা, ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরের একাডেমিক কাজে ফাঁকিবাজি করার দারূণ প্রচেষ্টা, বিরক্তিকরভাবে পশ্চিমা চিন্তা-কর্মের দুর্বল অনুকরণ, মেধা-সৃজনশীলতার শূন্যতা, দূর্গন্ধযুক্ত রাজনীতির সাথে লজ্জাহীন সম্পৃক্ততা, মানি-পাওয়ার-পজিশন-প্রমোশনের দুর্বার মোহ – এই সব মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার নামে ধাপ্পাবাজি চলছে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মার্কেটিং বিভাগে। আর এসবের শিকার হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এই অচলাবস্থার অবসান হবে কিভাবে!?
 
 
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩
রাত ৩টা ৫৩ মিনিট