এস এম মুকুল, বিশেষ প্রতিবেদক, জনতার নিউজ২৪ ডটকম: মেধার লালন ছাড়া মেধার বিকাশ সম্ভব নয়। কেননা মানুষের সৃষ্টির সবকিছুর মূলে রয়েছে মেধা। মেধাসম্পদ বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি বলার কারণ হলো, অন্য সম্পদের মতো মেধাসম্পদেরও মালিকানা আছে। একে বিক্রয়, হস্তান্তর ও দান করা যায়। বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে মেধাসম্পদ হিসেবে স্বীকৃত বিষয়গুলো দুই ধরনের_ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি ও কপিরাইট। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টির অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো সাধারণত আবিষ্কারের প্যাটেন্ট, ট্রেডমার্কস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। আর কপিরাইটে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো প্রধানত সাহিত্যকর্ম। যেমন উপন্যাস, কবিতা, নাটক বা অন্য কোনো লিখিত বই। এ ছাড়া চলচ্চিত্র, গানও এর অন্তর্ভুক্ত। একই সঙ্গে শৈল্পিক কোনো কাজ, যেমন_ অঙ্কন, চিত্রকলা, ছবি, স্থাপত্য নকশাও রয়েছে। বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা চলচ্চিত্রকে হাইলাইট করে এ বছরের থিম করেছে :মুভিজ- অ্যা গ্লোবাল প্যাশন।
মেধা লালনের মাধ্যমেও দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। পৃথিবীর সীমিত সম্পদ হলেও মেধাসম্পদের সম্ভাবনা ও প্রয়োগ ক্ষেত্র অসীম। এজন্য নতুন প্রজন্ম তথা তরুণদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী কাজের স্পৃহা জাগিয়ে তোলা এবং মেধাসম্পদ লালন ও চর্চার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। অামাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে হলে মেধার সঠিক লালন করতে হবে।
২৬ এপ্রিল ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন-এর অনুপ্রেরণায় বিশ্বের ১৯৪টি দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস উদযাপিত হয়। কোনো জাতি সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকর্মে যতটা উন্নত, জ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও ততটাই সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। শিল্পোন্নত বিশ্বের উন্নয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিল্পের বিকাশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মেধাসম্পদ সৃজন, আত্মীকরণ, সংরক্ষণ, লালন ও তার যথাযথ ব্যবহারে ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে মেধার সংকট লক্ষণীয়। অথচ আমরা মেধাহীন জাতি নই। মূল সমস্যা মেধা বিকাশে সুযোগের অভাব। বিগত কয়েক বছরে দেশের শিক্ষার হারের অভাবনীয় বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু শিক্ষার সেই হারের সঙ্গে মেধার বিকাশ, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটেনি।
আমাদের দেশে এ মেধাসম্পদের গুরুত্ব তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। আমরা শুধু বইয়ের কপিরাইট নিবন্ধনের কথাই শুনি। যদিও সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর। আর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে কপিরাইট অফিস। রয়েছে প্রতিটির জন্য আলাদা আইন। এসব আইন কতটা কার্যকর, তা দেখা দরকার। অথচ অন্যরা কিন্তু এগুলোতে অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্যাটেন্ট নিবন্ধনের কাজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়। আমাদের দেশে সেটা ম্যানুয়ালি হলেও সম্প্রতি তা স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে। এতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টির অন্তর্গত বিষয়গুলো সহজে নিবন্ধন করা যাবে। এই প্যাটেন্ট নিবন্ধন জরুরি।
দেশে ১০টি শিক্ষা বোর্ড থেকে বছরে গড়ে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। মাত্র ৭০-৮০ হাজার শিক্ষার্থী নিজেদের মেধা, অভিভাবকের অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির জোরে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। বছরে ১২-১৩ লাখ তরুণ থাকে দিকনির্দেশনাহীন। তাদের মেধা বিকাশের ব্যর্থতায় আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিটি স্তরে তরুণদের জীবনে হতাশা, রাগ, ক্ষোভ, অসন্তোষ, অবিশ্বাস ও অস্থিরতার মতো নেতিবাচক আবেগ-অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা হতাশা দূর করে কর্মসংস্থানভিত্তিক ডিপ্লোমা শিক্ষা চালুর পদক্ষেপ হোক বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের অঙ্গীকার।
উন্নত দেশগুলো অভিবাসীদের জন্য অভিবাসন নিয়ম সহজ করে মেধাবীদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। জার্মানি দক্ষ জনশক্তির জন্য ভিসার নিয়ম সহজ করে দিচ্ছে। ফ্রান্সে পড়তে যাওয়া ছাত্রদের কাজের সময় ৭ থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। মেধাবী ছাত্রদের জন্য অনেক বিষয় সম্পূর্ণ ইংরেজিতে করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ব্রিটেন মেধাবী অভিবাসীদের জন্য কাজের অনুমতি তথা ওয়ার্ক পারমিট দিচ্ছে। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘদিন চিন্তাভাবনা করে এমন একটি নম্বর পদ্ধতি বের করেছে যাতে শুধু দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তিই অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যেটির প্রথম ধাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা থেকে শুরু করে পরবর্তী কাজের সুযোগ এবং পরিশেষে স্থায়ী অভিবাসনের সুযোগ দিচ্ছে। বাইরের মেধাবী জনশক্তি আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উচ্চাকাক্সক্ষী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সিঙ্গাপুর।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা মেধাবী জনশক্তি খুঁজে বের করার জন্য উপযুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারছে না কোনো মেধাবীকে বাইরে থেকে দেশে নিয়ে আসতে। ফলে শুধু ‘বেন-ড্রেন’ হচ্ছে, যা একমুখী। শুধু রফতানি কিন্তু কোনো আমদানি নেই। ফলে আমদানি-রফতানি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মেধাসম্পদ আহরণ, লালন ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা অবশ্যই দরকার। দেশপ্রেমী রাজনীতি ও মেধার দক্ষতা আর সততার সংযোগ না হলে একটি দেশের উন্নয়ন গতিধারা এগিয়ে নেয়া সম্ভব না।
আমাদের মেধাসম্পদ আমাদেরই রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। মেধার মূল্যায়ন, মেধাবী মানুষের মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। আমাদের মধ্যে প্রতিভাবান মানুষের অভাব নেই। অনেককে হয়তো আমরা আবিষ্কার করতে পারছি না। যাদের আমরা পাচ্ছি তাদের হয়তো প্রত্যেককে সেভাবে সৃজনশীল কর্মে উৎসাহিত করতে পারছি না। আবার অনেকের সৃষ্টিকর্মেরও তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না। কিংবা গুরুত্ব দিলেও তার যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছি না। এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।