লাভের বাণিজ্য, নাকি লোভের বাণিজ্য!

Author Topic: লাভের বাণিজ্য, নাকি লোভের বাণিজ্য!  (Read 964 times)

Offline Maruf Reza Byron

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 62
  • Test
    • View Profile
"বাণিজ্যতে যাবো আমি সিন্দাবাদের মতো" - ছেলেবেলায় পড়া এরকম একটা ছড়া থেকেই কিনা জানি না নিজের ভেতরে ব্যবসার প্রতি একটা আগ্রহ শুরু হয়েছিলো জীবনের প্রথম দিকেই। আমার মেজো ভাই খুব উৎসাহী ছিলেন ব্যবসার প্রতি। মনে আছে, ছোটবেলায়, আমি তখন ক্লাস ওয়ান বা টুয়ে পড়ি আর মেজো ভাই ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ে, ওর সাথে দোকান দোকান খেলতাম আমরা। ও বাজার থেকে আমাদের আগ্রহের অনেক পণ্য যেমন চকোলেট-বিস্কিট-কলা ইত্যাদি কিনে নিয়ে এসে বাসার সামনে দোকান সাজিয়ে বিক্রী করতো। আর আমরা, ছোটরা, অতি আগ্রহের সাথে অবাক হয়ে ওর দোকানের চারপাশে ভিড় করে থাকতাম। সন্ধ্যা বেলায় ও যখন আমাদেরকে বলতো যে ওর কত টাকা লাভ হয়েছে আমরা অবাক হয়ে শুনতাম। তখনও ব্যবসা-লাভ-ক্ষতি-কেনা-বেচা - এই বিষয়গুলো ঠিকমতো বুঝতাম না। কিন্তু মেজো ভায়ের সেই ক্ষুদ্রতম উদ্যোগ ব্যবসা সম্পর্কে আমার মনে এক স্থায়ী ইতিবাচক দাগ কেটে যায়। একটু বড় হয়ে যখন মা বললো কমার্সে পড়তে তখন বেশ খুশী হয়েছিলাম মনে মনে। আমার চেয়ে অনেক 'খারাপ' ছাত্ররাও যখন সায়েন্সে পড়ে ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন আমি আগ্রহ নিয়েই কমার্সে পড়া শুরু করি। তারপর নারদ আর পদ্মায় অনেক জল বয়ে যায়।
 
স্কুল জীবন শেষে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় ধীরে ধীরে ব্যবসার প্রতি আমার ইতিবাচক মনোভাব পাল্টাতে থাকে। বিভিন্ন কোম্পানির কথা ও কাজের মধ্যে অমিলগুলো আমার মনে দ্বিধার জন্ম দেয়। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশিরভাগ কোম্পানিই মানুষকে ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করছে। নকল পণ্যকে আসল পণ্য বলে বিক্রী করা, ওজনে কম দেয়া, অযৌক্তিকভাবে দাম বেশি রাখা, ভেজাল-পচা পণ্য বিক্রী করা ইত্যাদি খবর দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে পড়তে পড়তে সেই কলেজ লাইফেই ব্যবসার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব জন্ম নেয়। তাদের এইসব কর্মকাণ্ড দেখে মনে হতে থাকে যে ব্যবসা মানেই ধোকাবাজি আর ব্যবসায়ী মানেই খারাপ মানুষ। আফসোস হতে থাকে ক্যানো কমার্সে পড়তে আসলাম!
 
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে পড়তে এসে কিছুদিনের মধ্যেই আমার সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান হয়। ততদিনে ব্যবসার আরও কদর্য রূপ আমার চোখে ধরা পড়ে। আমি বুঝতে পারি খুবই অল্প কিছু মানুষ শুধু নিজেদের মুনাফা অর্জনের স্বার্থে সমাজের সব শুভচিন্তাকে উপেক্ষা করে, পরিবেশ দূষণ করে, সভ্য সমাজের সব রকমের আইন-কানুন, রীতি-নীতিকে বৃ্দ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, শিশু-নারীসহ সর্বস্তরের সকল পেশার মানুষকে মর্যাদাহীন করে এমন এক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলণ করে যেখানে মুনাফাই হচ্ছে একমাত্র ঈশ্বর। আর সবই নগণ্য, তুচ্ছ, গোলাম মাত্র। সময়ের বিবর্তনে ব্যবসার প্রতি আমার নেতিবাচক মনোভাব খুব নিরবে ঘৃণায় পরিণত হয়। নিজের মূল্যবোধের সাথে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই নৈতিক দ্বন্দ্ব ভীষণ যন্ত্রনার সৃষ্টি করে আমার মনে। আমি পরিত্রাণের পথ খুঁজতে থাকি। পালাতে চাই, পারি না।
 
পড়াশোনা শেষে জীবনের প্রয়োজনে এক সময় শিক্ষকতা শুরু করি। দেখতে দেখতে কেটে যায় চৌদ্দ বছর। কিন্তু আজও আমি উত্তর খুঁজে বেড়াই। আজও কোন ক্লাসে পড়ানোর সময় ভেতরে ভেতরে কুণ্ঠিত হয়ে পড়ি। আজও বিভিন্ন কোম্পানির বল্গাহীন লোভী কর্মকাণ্ড প্রতিদিন টিভিতে-পত্রিকায়-ম্যাগাজিনে-বিলবোর্ডে-ইন্টারনেটে দেখে পড়ে শুনে অসুস্থ বোধ করি। ভাবতে থাকি এর শেষ কোথায়?
 
লাভের বাণিজ্য ধীরে ধীরে আমাদের লোভের বাণিজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যবসা করলে লাভ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লাগামহীন লাভের পিছে ছুটে চলা তো মানুষকে লোভী প্রাণীতে পরিণত করে। তাহলে কি আমরা মানুষ-প্রকৃ্তি-সমাজ সব ভুলে শুধুই অন্তহীন লোভের পিছে ছুটে চলবো? এটাই কি অন্টারপ্রিনিওরশীপ স্পিরিট? এর জন্যই কি দেশে এতো এতো আইন-কানুন! এজন্যই কি আমাদের এতো এতো পড়াশোনা, এতো এতো গবেষণা-পিএইচডি-প্রমোশন তৎপরতা?... আমি তা মনে করি না। যে ব্যবসা বা যে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড আমাদের লোভী প্রাণীতে রূপান্তর করছে প্রতিনিয়ত তাকে আমি ব্যবসা বলে মনে করি না। যে ব্যবসা বা যে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড দেশ-জাতি-ধর্ম-মানবিকতা-সমাজ-সভ্যতা-মানুষ-প্রকৃ্তি'র তোয়াক্কা করে না তাকে আমি সমর্থন করি না। এদের বিরুদ্ধে কথা বলা আমাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব...।