প্রাসঙ্গিক কথাঃ সান জু ও “দি আর্ট অফ্ ওয়ার”

Author Topic: প্রাসঙ্গিক কথাঃ সান জু ও “দি আর্ট অফ্ ওয়ার”  (Read 1250 times)

Offline Maruf Reza Byron

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 62
  • Test
    • View Profile
২০০২ সাল। আমি তখন ঢাকা কমার্স কলেজের মার্কেটিং বিভাগে শিক্ষকতা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ প্রকাশিত DU Journal of Marketing-র Vol. No. 05, 2002 সংখ্যা হাতে নিয়ে উল্টাতে উল্টাতে একঘেঁয়ে তথাকথিত ‘গবেষণা নিবন্ধ’ দেখতে দেখতে চোখ আটকে যায় একটা লেখায় “Sun Tzu’s The Art of War and Its Implications in Marketing”। নামটার মধ্যেই একটা অন্যরকম আকর্ষণ ছিলো। লেখক A. S. M.  Shahidul Haque, Marketing Manager, Padma Textiles Mills Ltd.। এক মনে পড়তে শুরু করি লেখাটা। পুরোটা একটানে পড়ে স্বস্তি অনুভব করি। প্রমোশন-প্রত্যাশী সুবিধাবাজ শিক্ষকদের মেধাহীন “Clerical Research Work”-র ভীড়ে এক ঝলক সতেজ হাওয়া হয়ে আসে লেখাটা। চিন্তার নতুন জানালা খুলে দেয়। ভাবতে থাকি সান জু ও তার বই “দি আর্ট অফ্ ওয়ার” নিয়ে।
 
নিয়মিত আড্ডার বন্ধু সাংবাদিক, অনুবাদক এস. এ মামুনের সাথে একদিন কথাচ্ছলে শেয়ার করি সান জু’র বইয়ের কথা। মামুন উৎসাহ দেখায়। জানায় যে সেও বইটার খোঁজে আছে এবং হাতে পেলে অনুবাদ করার ইচ্ছা রাখে। মামুনের আগ্রহ আমাকেও অনুপ্রাণিত করে। শুরু হয় স্বপ্নের জাল বোনা।
 
এরপর কেটে যায় অনেকটা সময়। জীবনের জঙ্গমতা অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। মন থেকে দূরে সরে যায় সান জু ভাবনা।
 
প্রায় সাত বছর পর ২০০৯ সালে নতুন কর্মক্ষেত্র হিসেবে আমি যোগদান করি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। আমাকে বলা হয় “মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি” কোর্সটি বিবিএ শিক্ষার্থীদের পড়াতে। বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে আসেন সান জু  ও আমার লুপ্তপ্রায় স্বপ্ন।
 
ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে সিনিয়র সহকর্মীদের “রাডার চোখের” আড়ালে শুরু করি “দি আর্ট অফ্ ওয়ার” বইটি পড়ানো। মূলতঃ শিক্ষার্থীদের বিপুল উৎসাহই আমার স্বপ্নের পালে বাতাস দিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের উস্কে দেই চ্যালেঞ্জ নিতে, বইটির বাংলা অনুবাদ করতে। কিন্তু কাজ আর হয় না। দুই একজন যে উৎসাহ দেখায় না, তা নয়। কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার বছর পুরোনো একটা কাঠখোট্টা বই অনুবাদ করার জন্য তা যথেষ্ট বলে মনে হয় না। এভাবে বছর চলে যায় একের পর এক। কিন্তু অনুবাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। এরই মধ্যে ২০১২ সালের সামার সেমিস্টারের আমার একদল ছাত্রী, সংখ্যায় সাত, তাদের আগ্রহের কথা জানায়। যথারীতি আমিও তাদের উৎসাহিত করি। কিন্তু সত্যি বলতে আমি নিজে খুব একটা আশা করি নি। কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে ক্লাস-পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্ট-প্রেজেন্টেশনের চাপ সামলে প্রায় চার মাসের নিরলস পরিশ্রম শেষে তারা ঠিকই একে একে শেষ করে ফেলে বইটির তের অধ্যায়ের অনুবাদের কাজ। আমি একাধারে বিষ্মিত হই, গর্বও অনুভব করি। আমার নিরাশার সন্ধ্যা নতুন ভোরের দেখা পায়।
 
এরই মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কর্মকর্তা বন্ধুপ্রতিম কিবরিয়া ভাইয়ের সৌজন্যে হাতে এসে পৌঁছায় “আর্ট অফ্ ওয়ার”-এর Griffith-র ইংরেজী অনুবাদ। ইন্টারনেট ঘেঁটে একে একে যোগাড় করি ইংরেজি অনুবাদের পিডিএফ কপি, অডিও, ও ভিডিও ক্লিপসহ নানা প্রাসঙ্গিক আলোচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  এমআইএস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সুদূর চীন থেকে উপহারস্বরূপ  এনে দেন চায়নিজ ভাষায় প্রকাশিত “দি আর্ট অফ ওয়ার” বইটির চীনা সংস্করণ। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করি পেঙ্গুইন প্রকাশিত বইটির ইংরেজী কাব্যরূপ এবং মিডিয়া কর্পোরেশন প্রকাশিত এ। Michelson রচিত “The Art of War for Managers” শীর্ষক অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ বইটি। আমি আমার প্রায় এক যুগের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ি। শুরু হয় অনুবাদ সম্পাদনার কাজ।
 
ঢাকা কমার্স কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আমার প্রাক্তন সহকর্মী সুহৃদ শামিম আহসানের প্রায় তিন মাসের নিরলস পরিশ্রমের ফলে অনুবাদ সম্পাদনার প্রাথমিক পর্ব শেষ হয়। শিক্ষার্থীদের করা অনুবাদ কিছুটা দুর্বল থাকায় শামিম ভাই বলতে গেলে প্রায় পুরো বইটাই নতুন করে অনুবাদ করে ফেলেন। এরপর শুরু হয় সম্পাদনার দ্বিতীয় পর্বের কাজ। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন সহকর্মী অনুজপ্রতিম মনিরুজ্জামান সরকারের সাথে আমার দুর্দান্ত টিম ওয়ার্কের ফলে প্রায় দুই মাসের মধ্যে শেষ হয় সম্পাদনার দ্বিতীয় পর্বও। এরপর কম্পিউটার কম্পোজ, প্রুফ রিডিং, ও আনুষঙ্গিক কাঁটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে পার হয় আরও প্রায় দুই মাস। অবশেষে প্রায় দেড় বছরের পরিশ্রম শেষে বই আকারে হাতে আসে সান জু’র “দি আর্ট অফ্ ওয়ার” বইটির বাংলা অনুবাদের চূড়ান্ত খসড়া।
 
এখন প্রশ্ন হলো কেন আমরা, সেন্টার ফর মার্কেটিং সায়েন্স (সিএমএস), এই বইটার বাংলা অনুবাদ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলাম। এর তাৎপর্যই বা কি? এই প্রশ্নের উত্তর বোঝার জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে আড়াই হাজার বছর আগের প্রাচীন চীনে। সেই সময়ের চীনের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্যের ... প্রধান সেনাপতি সান জু (কেউ কেউ বলেন সুন জু) তাঁর সম্রাটের আদেশে যুদ্ধজয়ের কৌশল সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ও অভিজ্ঞতার আলোকে রচনা করেন “দি আর্ট অফ্ ওয়ার” বইটি। আকারে ছোট এই বইটা সেই বিবেচনায় “The Oldest Book on Strategy” হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথম পর্যায়ে বাঁশের বাতা দিয়ে বিশেষভাবে তৈরী Bamboo Book হিসেবে সংরক্ষিত হয় অমূল্য এই বইটি। প্রাচ্যের জ্ঞানসম্পদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই বই যুদ্ধ কৌশলের মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত বহুল সমাদৃত। বিশ্বের প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনীর প্রত্যেক কর্মকর্তার জন্য অবশ্য পাঠ্য এই বই।
 
শুধু তাই নয়, প্রতিটি বহুজাতিক কোম্পানীর প্রতিযোগিতা কৌশল (Competitor Strategy) প্রণয়নে এই বইয়ের শিক্ষাকে পাথেয় হিসেবে অনুসরণ করা হয়। বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের যে কোন শিক্ষার্থী ব্যবসায়ের যে প্রাথমিক কৌশলগুলো শিখে নিজের হাত পাকায় তার প্রায় প্রতিটা কৌশল যেমন SWOT Analysis, Fast  Mover’s Advantage, Segmentation-Targeting-Positioning (STP), Cost-Benefit Analysis, Environmental Analysis, Back-up Plan রাখা  ইত্যাদির ধারণা মূলতঃ এই বই থেকেই নেয়া। আজকের পৃথিবীতে প্রায় প্রতিটি সফল কোম্পানির নির্বাহীদের জন্য এক অবশ্যপাঠ্য বই সান জু’র “দি আর্ট অফ্ ওয়ার”।
 
শুধু সেনাবাহিনী বা বহুজাতিক কোম্পানী নয়, সান জু’র “দি আর্ট অফ্ ওয়ার” বইয়ের কৌশলসমূহের প্রয়োগ সাফল্য বয়ে নিয়ে এসেছে অন্য কর্মক্ষেত্রগুলোতেও। ১৯৯৪ সালে লুই ফেলিপ স্কলারির অসামান্য কোচিংয়ে প্রায় ২৪ বছর পর ফুটবল বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে ব্রাজিল ফুটবল দল। নিজের অনন্য কোচিং সাফল্যের রহস্য উম্মোচন করে স্কলারি পুরো কৃতিত্ব দেন সান জু’কে। ফুটবল মাঠে “দি আর্ট অফ্ ওয়ার” বইয়ের কৌশলসমূহের সফল প্রয়োগের মাধ্যমেই যে তার তারুণ্যনির্ভর দল বিশ্বকাপ শিরোপা পুণরুদ্ধার করে সেটা নিশ্চিত করেন তিনি। একইভাবে ২০০৩ সালে ক্রিকেটে বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলও ঘোষণা করে যে সান জু’র যুদ্ধজয়ের কৌশলের সফল প্রয়োগের মাধ্যমেই এসেছে তাদের এই সাফল্য।
 
প্রায় চল্লিশটি ভাষায় অনুদিত এই অসামান্য বইটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যপাঠ্য হলেও নিতান্তই দুর্ভাগ্যবশতঃ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি ভীষণভাবে উপেক্ষিত। মূলতঃ পাশ্চাত্যজ্ঞানে মোহাচ্ছন্ন সৃজনশীল চিন্তায় অক্ষম আমাদের শিক্ষকমন্ডলীর মূলধারার জ্ঞানসীমার বাইরেই থেকে গেছে সমগ্র পাশ্চাত্যকে মুগ্ধ করে রাখা প্রাচ্যের এই অমূল্য জ্ঞানসম্পদটি। তবে আমাদের দেশের কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের সৃজনশীল অংশ ঠিকই এই মূল্যবান বইয়ের শিক্ষাকে তাদের মতো করে প্রয়োগ করে চলেছেন সফলভাবে।
 
চিরায়ত শাস্ত্র হিসেবে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের Strategic Marketing, Strategic Management, Corporate Strategy, Business Policy and Strategy কোর্সগুলোতে এই বইটার অপরিসীম গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সান জু’র “Win Without War” (www)-র অসাধারণ ধারণা বর্তমান hyper competitive market-র যুগে কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতাকৌশল নিরুপণে অনন্য ভূমিকা রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।
 
বাংলাদেশের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রত্যেক শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্পোরেট নির্বাহী এবং সেনাকর্মকর্তার জন্য অবশ্যপাঠ্য বই হিসেবে “দি আর্ট অফ্ ওয়ার” বইটির বাংলা অনুবাদ বাংলা ভাষার সামগ্রিক জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। বিশ্বনাগরিক হিসেবে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে চিরায়ত শাস্ত্রের সাথে পরিচয় করানো, তাদেরকে ইতিহাসমুখী করে তুলে ঐতিহ্যের নির্যাস গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে তোলা এবং তার শিক্ষাকে বর্তমান সমাজ বাস্তবায়তায় প্রয়োগ করতে সচেষ্ট করার তাগিদ থেকেই সেন্টার ফর মার্কেটিং সায়েন্স (সিএমএস) এই অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমাদের এই প্রচেষ্টা কোন রকম বাণিজ্যিক উদ্দেশে পরিচালিত নয়। বরং মাতৃভাষায় মৌলিক জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করা এবং বৈশ্বিক জ্ঞানসম্পদের সাথে নিজ ভাষার সম্পর্ক স্থাপন করার প্রতি সেন্টার ফর মার্কেটিং সায়েন্সের অঙ্গীকারের প্রতিফলন হিসেবেই আমরা এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সেন্টার ফর মার্কেটিং সায়েন্স (সিএমএস) স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী-গবেষকদের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে চায়। আমাদের এই প্রকাশনা সেই আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।