কক্সবাজারের টেকনাফের প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে অবৈধভাবে তৈরি করা ৩৮টি হোটেল এক মাসের মধ্যে ভেঙে ফেলার জন্য মালিকদের সময় বেঁধে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসব হোটেলের মালিকদের কাছে চলতি মাসের ১৯ এপ্রিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী ২০ মের মধ্যে মালিকদের নিজেদের উদ্যোগে ভেঙে ফেলতে হবে হোটেল।
সেন্ট মার্টিনে বর্তমানে ১০৪টি আবাসিক হোটেল-মোটেল ও কটেজ রয়েছে। এর কোনোটিরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। ৩৮টি হোটেল-মোটেলের বাইরে ৬৬টি কটেজ রয়েছে। এর বেশিরভাগই মূলত স্থানীয় লোকজনের বাড়ি। এসব কটেজ ভাঙার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বঙ্গোপসাগরে প্রায় সাত বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের জীববৈচিত্র্য অনন্য। এটি দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সরকার সেন্ট মার্টিনকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) ঘোষণা করে। সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র ও সামুদ্রিক প্রবালের অন্যতম আধার সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কংক্রিটের তৈরি অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ। অথচ গত দুই দশকে দ্বীপের উত্তর অংশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় তৈরি হয়েছে অন্তত ৮০টি হোটেল-মোটেল। দ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব অংশে তৈরি হচ্ছে আরও অসংখ্য ভবন। প্রশাসনিক কাঠামোয় সেন্ট মার্টিন টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের রিসোর্ট ও হোটেল। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলোসেন্ট মার্টিন দ্বীপের রিসোর্ট ও হোটেল। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো
আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আইন অমান্য করেই বছরের পর বছর সেন্ট মার্টিনে শতাধিক হোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে এসব অবৈধ স্থাপনা দ্রুত ভেঙে ফেলা প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশে যেসব হোটেল ভেঙে ফেলার কথা বলা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে ব্লু মেরিন, ফ্যান্টাসি, অবকাশ, লাবিবা বিলাস, সেন্ডশোর, প্রাসাদ প্যারাডাইস, প্রিন্স হেভেন, স্বপ্ন বিলাস, সেভেন স্টার, ব্লু-সি ইস্টার্ন রিসোর্ট, ওশান ব্লু, সি ভিউ, সি-প্রবাল ইত্যাদি।
গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ‘নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্থাপনা নির্মাণ চলছে সেন্ট মার্টিনে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ পাওয়ার কথা জানিয়ে হোটেল অবকাশের স্বত্বাধিকারী শিবলুল আজম কোরাইশী বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পর্যটন বিকাশের জন্য হোটেল গড়ে উঠেছে। দ্বীপে বসবাসরত প্রায় আট হাজার মানুষ দুর্যোগের সময় এসব হোটেল আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। হোটেলগুলো না ভেঙে অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ব্লু-মেরিন হোটেলের স্বত্বাধিকারী জাফর আহমদ পাটোয়ারী বলেন, হোটেল ভেঙে ফেলতে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে চিঠি দিচ্ছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু এখনো হাতে পাননি। পেলে সেন্ট মার্টিন হোটেল অ্যাসোসিয়ানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের ভ্রমণে সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বছরের পাঁচ মাস (নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত) সেখানে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক ভ্রমণে যান। সেন্ট মার্টিনের হোটেল-মোটেল ও কটেজে দিনে প্রায় ২ হাজার পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের আহ্বায়ক এম এ হাসিব বাদল প্রথম আলোকে বলেন, পর্যটন মৌসুম শেষ হওয়ায় ১ এপ্রিল থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বরের শেষের দিকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে আবার জাহাজ চলাচল শুরু হবে। সেখানকার ৩৮টি হোটেল ভাঙা হলে পর্যটকের আবাসন-সংকট দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, সেন্ট মার্টিনের ৩৮টি হোটেল ভেঙে ফেলতে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সেন্ট মার্টিনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। উচ্ছেদ না করলে আদালত অবমাননা হবে।
সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা আবদুল আমিন বলেন, দ্বীপের শতাধিক হোটেলের মধ্যে মাত্র নয়টির মালিক স্থানীয়রা। বাকি হোটেলের মালিকানা বাইরের লোকজনের। বছরের পাঁচ মাস হোটেলে জমজমাট ব্যবসা হলেও দ্বীপের মানুষ লাভবান হচ্ছে না। হোটেলে বাইরের লোকজন চাকরি করেন। কম শিক্ষিত হওয়ায় দ্বীপের লোকজনকে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অবৈধ হোটেল ভেঙে না ফেলে দ্বীপের গরিব লোকজনকে সেখানে পুনর্বাসন করার দাবি জানান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞার কারণে দ্বীপের আট হাজার বাসিন্দা সাত বছর ধরে ঘরবাড়ি তৈরি করতে পারছে না। কিন্তু নানা কৌশলে বাইরের লোকজন দ্বীপে হোটেল-মোটেল ঠিকই তৈরি করে চলেছেন বলে জানান সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই দ্বীপে সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা আছে। আছে উচ্চ আদালতের বিধিনিষেধও। কিন্তু এখানে কোনোটিই মানা হচ্ছে না।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে কক্সবাজারের পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। কক্সবাজার ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল বলেন, সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের আগমন দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে হোটেল-মোটেল তৈরির হিড়িক পড়েছে। এতে দ্বীপটি ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিনকে রক্ষা করতে হলে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলও সীমিত করার দাবি জানান তিনি।
আগামী ২০ মের মধ্যে কোনো মালিক তাঁর হোটেল না ভাঙলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম। তিনি বলেন, পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করার জন্য এর আগেও হোটেলের মালিকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। অধিকাংশ হোটেলের মালিক নোটিশের জবাব দেননি। তিনি বলেন, ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া ৩৮টি হোটেল ও মোটেলের মধ্যে একতলা ১৮টি, দোতলা ১৭টি ও তিনতলা ৩টি।
হোটেল ছাড়াও ৬৬টি কটেজ রয়েছে সেন্ট মার্টিনে। এসব কটেজের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানতে চাইলে সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, ৬৬টি কটেজের মধ্যে ৪৫টি স্থানীয় লোকজনের বাড়ি। শীত মৌসুমে এসব বাড়ির কয়েকটি কক্ষ পর্যটকদের ভাড়া দিয়ে তাঁরা কিছু টাকা আয় করেন। কটেজ উচ্ছেদ করলে অসংখ্য লোক গৃহহীন হয়ে পড়বে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আর যেসব কটেজ সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশে তৈরি ও ব্যবহার করা হচ্ছে সেসব কটেজ ভেঙে ফেলা হবে।