পড়ার বিষয় যখন পছন্দের বিষয় নয়

Author Topic: পড়ার বিষয় যখন পছন্দের বিষয় নয়  (Read 1042 times)

Offline obayed

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 549
  • Assistant Director, HRDI, DIU
    • View Profile
    • hrdi.ac
মা-বাবার পছন্দে কিংবা নিজের ভালো লাগা থেকেই হয়তো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিষয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। একটা সময় হঠাৎ মনে হতে শুরু করল, ‘এই বিষয়টা ঠিক আমার জন্য নয়।’ ব্যস, তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো—মন বসে না পড়ার টেবিলে! কী করবেন তখন?

পদার্থবিজ্ঞানের স্কেল দিয়ে মাপা সম্ভব একজন মানুষের উচ্চতা কতটুকু কিংবা বাটখারা দিয়ে মাপা যায় একজন মানুষের ওজন কত। কিন্তু যে মানুষকে ঠিক মাপা যায় না, ঠিক ওজন করা যায় না; যে মানুষ একজন বড়, মহান, মহিমান্বিত মানুষ হয়ে ওঠেন, সেটি হয়ে ওঠে তাঁর চিন্তার জন্য, তাঁর সৃজনশীলতার জন্য। সভ্যতার ইতিহাস তাই চিন্তার ইতিহাস, সৃজনশীলতার ইতিহাস। মানুষ তার চিন্তার সমান বড়; দার্শনিক দেকার্তের সেই প্রবাদপ্রতিম উক্তি: ‘আই থিংক, দেয়ারফোর আই অ্যাম’—আমি চিন্তা করতে পারি, সে জন্যই আমি আছি। মানুষ চিন্তা করতে পারে—সেটিই হলো তার অস্তিত্বের প্রমাণ; কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কোনো বিষয়ে পড়লেই মানুষ যে তার মধ্যে আটকে থাকবে, এমন কোনো কথা নয়। মানুষ এক অনন্ত সম্ভাবনাময় সৃষ্টি।

যেমন ধরো, তুমি কোন পরিবারে জন্ম নেবে সেটি তুমি নিজে ঠিক করতে পারো না—এটা একটা ‘চান্স’, কোনো ‘চয়েস’ নেই এখানে। কিন্তু জন্মের পর বাবা-মাসহ সবার পরিচর্যা-সাহচর্যে ঠিকই নিজেকে তুমি মানিয়ে নাও এবং নিজের পরিবার ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারো না। কোন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, কোন শিক্ষকের ক্লাস করবে বা করবে না, ভবিষ্যতে কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে এবং সেখানে তোমার সহকর্মী কে বা কারা হবে—এমন অনেক বিষয়েই তোমার পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে তুমি পারবে না; তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে? জীবন সময়ের মতোই অস্থির, চঞ্চল! আর সেখানেই তো জীবনের সৌন্দর্য! দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘আ লাইফ আনএক্সামিনড ইজ নট ওয়ার্থ লিভিং’; যে জীবনে চঞ্চলতা নেই, চপলতা নেই, অনিশ্চয়তা নেই, ঝুঁকি নেই আর তা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ নেই, সে জীবন তো নিরানন্দ, নিদারুণ নিরাসক্তির বিষয়! ঠিক তেমনি পূর্ব-পছন্দের বিষয় না হলেও যে বিষয়ে ভর্তি হয়েছ, সেই বিষয়টিকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলে, সেটিকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করলে সেখানেই সফল হওয়া সম্ভব।

এটা ঠিক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় কোন বিষয়ে পড়ব এ নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এই ‘যুদ্ধের’ অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অনেকের মধ্যেই জন্ম নেয় হতাশা; শিক্ষার্থীর পছন্দ আর অভিভাবকের পছন্দ প্রায়ই এক হয় না। আর যদিও-বা সেটি এক সুতোয় বাঁধা সম্ভব হয়ে যায়, তারপরও হতাশ হওয়ার আতঙ্ক থেকে শিক্ষার্থীর আর নিষ্কৃতি সহজে মেলে না: পছন্দের বিষয়ে সুযোগ না পাওয়া শিক্ষার্থীরা প্রায়ই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নিজেদের মেধার অপচয় করে, জীবনীশক্তির ক্ষয় করে। কিন্তু পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পারাটাই কি জীবনের সমাপ্তি? মোটেই নয়; বরং একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে জীবনটাকে নতুন করে শুরু করা দরকার; একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে মানুষের মনের চাহিদা আর বাস্তবিক জগতের প্রয়োজন সব সময় এক ও অভিন্ন হয় না। পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পারলেই যে জীবন থেকে ‘প্যাশন’ বাদ হয়ে গেল, তার কোনো মানে নেই বরং এরা পরস্পর সমান্তরাল হয়েও চলতে পারে। আমরা হুমায়ূন আহমেদের মতো নন্দিত লেখককে পেয়েছি, যিনি পড়াশোনা করেছেন রসায়নে-বাংলা ভাষা বা সাহিত্যে নয়। তিনি ‘প্রফেশনেও’ সফল ছিলেন—শিক্ষক হিসেবে, আবার প্যাশনেও সফল ছিলেন—লেখক হিসেবে।

আবার ধরো, তোমার পছন্দের বিষয় সব সময় একরকম থাকে না, সময়ের প্রেক্ষাপটে দরকারিও থাকে না; মানুষ সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনের ধারায় চলমান একটি বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব; সময়ের প্রয়োজনে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ও পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারাটাই তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই ভাষা ও সাহিত্য বা সংগীতে পড়ে ব্যাংক বা বিমা অথবা অন্য কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আবার অনেকেই ফলিতবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পড়াশোনা করে চাকরির পাশাপাশি মনের চাহিদা মেটাতে সংগীত বা সাহিত্যের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কাজেই মনের চাহিদা বা পছন্দই যে সব সময় মূল পেশা হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। বিশ্বসেরা প্রযুক্তিবিদ মাইক্রোসফটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, আবারও পড়ার সুযোগ পেলে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, শক্তি বা জীববিজ্ঞান—এসবের কোনো একটি বিষয় পড়তেন। কেননা তাঁর মতে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষের জন্য যা দরকার, তা সরবরাহ করতে এই তিনটি বিষয়ে গভীর অনুধ্যান এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল করে দেখো, ওই তিনটির কোনো বিষয় না পড়েই বিল গেটস কত বড় সফল মানুষ—পৃথিবীর এক নম্বর ধনী মানুষ। অর্থাৎ ‘প্যাশন’ আর ‘প্রফেশন’-এর মধ্যে সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক হলেও ক্যারিয়ার ও জীবনে সফল হওয়া সম্ভব। আর বিল গেটস কেবল ধনী নন, তিনি এক হৃদয়বান মানুষ—পুরো পৃথিবীকে দারিদ্র্যমুক্ত, রোগমুক্ত আর মানবিক করে গড়ে তুলতে তিনি যে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে আগামী অনেক বছর তা এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে। মনে রেখো, মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, প্রকৃতি পরিবর্তনশীল; মানুষের পছন্দ-অপছন্দ বদলায়, মানুষের মন বদলায়—এটিই মানুষের ধর্ম। এ জন্য নতুনকে, ব্যতিক্রমকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা ও পূর্বপ্রস্তুতি থাকতেই হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: robaet.ferdous@gmail.com