ঝালকাঠির শীতলপাটির কদর দেশজুড়ে
ঝালকাঠি প্রতিনিধি স্পেশাল
আপডেট: ১০:১৭:০৭ AM, বুধবার, মে ২৪, ২০১৭
Cubex Tech
দেশজুড়ে সমাদৃত ঝালকাঠির শীতলপাটি। এখানকার চিকন বেতির শীতল পাটির চাহিদাও প্রচুর। পাটি শিল্প বাংলাদেশের লোকাচারে জীবন ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উপাদান। অতিথিদের সামনে ভালোমানের শীতল পাটি বিছিয়ে নিজেদের আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলেন তারা।
জানা গেছে, জেলার রাজাপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামে ৯০ বছরের বৃদ্ধ থেকে ৮-১০ বছরের শিশুরাও ব্যস্ত এ নিপুণ কারুকাজে। জেলায় তিনশ’এর বেশি পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পুরাতন ঐতিহ্যের কারু হাতে গড়া শীতল পাটির জন্য রাজাপুরের দুটি গ্রামকে ‘শীতল পাটির’ গ্রাম নামেও আখ্যা দেয়া হয়েছে।
পাইত্রা বা মোর্তা নামে এক ধরণের বর্ষজীবী উদ্ভিদের কাণ্ড থেকে এ বেতি তৈরি করা হয়। পরিপক্ব পাটি গাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে পাটির বেতি তোলা হয়। এরপর ভাতের মাড় ও পানি মিশিয়ে বেতি সেদ্ধ করা হয়। ফলে বেতি হয়ে ওঠে মসৃণ ও সাদাটে। বেতির উপরের খোলস থেকে শীতল পাটি, পরের অংশ তুলে বুকার পাটি এবং অবশিষ্ট অংশ ছোটার (চিকন দড়ি) তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।
রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি ও ডহরশংকর গ্রামেই রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। এরা সবাই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরাতন ঐতিহ্যের কারুহাতে গড়া শীতল পাটির জন্য গ্রাম দুটিকে ‘শীতল পাটির’ গ্রাম নামে ডাকা হয়। গ্রামের শত শত হেক্টর জমি জুড়ে নজরকাড়া পাটি গাছের বাগান।
গ্রামগুলোতে শীতলপাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়। পাটির বুনন পদ্ধতি প্রধানত দুই ধরনের। প্রথমত, পাটির জমিনে ‘জো’ তুলে তাতে রঙিন বেতি দিয়ে নকশা তোলা হয়। দ্বিতীয়ত, পাটির জমিন তৈরি হলে তার চারদিকে অন্য রঙের বেতি দিয়ে মুড়ে দিয়ে।
এলাকাবাসী জানান, শৈল্পিক উপস্থাপনায় এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দক্ষ ও সুনিপুণ একজন পাটিয়াল নারীর কদর রয়েছে সর্বত্র। একটি পাটি বুনতে ৩/৪ জনের দুই-তিনদিন সময় লাগে। যা বিক্রি করে ৫শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয়। মহাজনরা প্রতি পাটিতে একশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা লাভ করেন।
পাটি শিল্পীরা জানায়, পাইত্রা চাষ ও কেনার জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়। এ জন্য শিল্পীরা মহাজন ও এনজিওদের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের জীবন যাত্রার মানের উন্নতি হচ্ছে না। শীতলপাটি শিল্পীর জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় পুঁজির জন্য শিল্পীরা দাদন ব্যবসায়ী, সুদখোর মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন। তাছাড়া বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও এখন পর্যন্ত শীতলপাটি রফতানিযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি পায়নি।
পাটি শিল্পি মঞ্জুরানী বলেন, আমাদের তৈরি শীতলপাটি দেশজুড়ে সমাদৃত। দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা কিংবা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। শুধু মাত্র শীতলপাটি বিক্রি করেই সংসারের খরচ এবং ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাই। তবে শীত এবং বর্ষার সময় আর্থিক সংকটে ভুগতে হয় আমাদের। সরকার যদি বিনা সুদে ঋণ প্রদান করতো, তাহলে বেশি পরিমানে পাইত্রা ক্রয় করে শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হতো।
৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মৌসুমি (পাটিকর) জানায়, আমাদের পরিবারের সকলেই পাটি বুনতে পারে। বাবা-মাকে সহযোগিতা করার জন্য পড়া-লেখার পাশাপাশি পাটি তৈরি করি। এতে বাবা মাও আমার প্রতি খুশি।
স্থানীয় পাটি শিল্পী সমিতির সভাপতি বলাই চন্দ্র পাটিকর বলেন, গরমে একটু প্রশান্তির জন্য যুগযুগ ধরে দেশের মানুষ শীতলপাটি ব্যবহার করে আসছে। পাটি শিল্পীদের সরকারিভাবে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসএমই খাতের আওতায় ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫ জন পাটি শিল্পীদেরকে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। তবে বিনা সুদে ঋণ বিতরণ করলে আমরা উপকৃত হব।
জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক বলেন, ঝালকাঠির শীতলপাটি দেশজুড়ে বিখ্যাত। চাহিদা থাকা সত্বেও পাটি বিপণন ত্রুটি থাকায় বছরের একটা সময় তাদের বসে থাকতে হচ্ছে। আমরা সরকারের অতিদরিদ্র্য কর্ম সৃজন কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র পাটি শিল্পীদের কাজের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। হয়তো এটা অচিরেই সম্ভব হবে।
http://www.allbanglanewspaperlist24.com/newspapers.php?q=alokitobangladesh.com