স্বাস্থ্য বিষয়ক এমন অনেক ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে যা যুগের পর যুগ প্রচলিত...... এসকল ভ্রান্ত ধারনা গর্ভবতী মায়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর.....
নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হল গর্ভাবস্থা...... শিশুর জীবন কিভাবে গড়ে উঠবে তা অনেকটাই নির্ভর করে এসময়ের ধ্যান-ধারনা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির উপর......ভাবা হয়ে থাকে, অশিক্ষিত লোকেরাই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়.......কিন্তু বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাও নানান ভুল ধারনার শিকার হয়..... কুসংস্কার মুক্ত হতে হলে প্রথমত মা ও পরিবারের সদস্যদের সঠিক তথ্য জানতে হবে.......এ ব্যাপারে চিকিৎসক এর পরামর্শ গ্রহন করা অধিক উপযুক্ত.....
বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কারঃ
কখনো ধর্মীয়, কখনো পারিবারিক প্রথার কারনে কিছু মানুষ খুব প্রাচীন এবং অকেজো ধ্যান-ধারনা আঁকড়ে ধরে থাকেন..... তাদের কাছে এসবের মূল্য অনেক বেশি....তারা এসব প্রথা গুলোকে এমনভাবে গেঁড়ে বসে আছেন যে গর্ভবতী মা বা শিশুর জন্য ক্ষতিকর জেনেও এসব মেনে চলার উপর বেশি জোর দেন........ফলে মা ও শিশুর মৃত্যুর কারনও হতে পারে....... আবার কিছু কুসংস্কার আছে এমন যা ক্ষতিকর না হলেও নিতান্তই হাস্যকর এবং অযৌক্তিক....
★গর্ভাবস্থায় খাবার নিয়ে কুসংস্কারঃ
গর্ভকালীন সময়ে ভুল ধারনাবশত মায়েরা কম খাবার গ্রহন করে। এতে নাকি বাচ্চার জন্মগ্রহনে সুবিধা হয়, জন্মদানে কষ্ট কম হয়। ফলে দেখা যায়, মায়ের শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়, বাচ্চার ওজন কম হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়, শিশু বার বার অসুস্থ হয়ে পড়ে। গর্ভবতী অবস্থায় খাবারের পরিমান খুব বেশি বাড়ানোর প্রয়োজন নাই, তবে পুষ্টিকর খাদ্য যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, শাক-সব্জি ইত্যাদি রাখা দরকার।
আনারস খেলে গর্ভপাত হয়, নারিকেল গ্রহন করলে বাচ্চা অন্ধ হয় অথবা হাসের ডিম খেলে শ্বাসকষ্ট হয় ইত্যাদি খাদ্য সংক্রান্ত ভুল ধারনা রয়েছে। অনেকে গরম খাবার গ্রহনে বিরত থাকতে বলেন। বিশেষ করে হিন্দু মায়েরা এসময় মাছ-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
সন্তান প্রসবের পর কোন কোন এলাকায় মাকে শুধু শুকনো খাবার অল্প পরিমানে দেওয়া হয়। কোথাও একটু ঘি-ভাত বা কালজিরা-ভাত দেওয়া হয়। অনেকে মনে করেন, সবজি, মাছ-মাংস খেলে বাচ্চার পেট কামড়াবে। আরও মনে করা হয় পানি ও তরল খাবার বেশি খেলে শরীরের রস টানবে না।
★ কিছু কুসংস্কার যা গর্ভবতী মায়ের জন্য ক্ষতিকরঃ
#খাসির মাংস বা অন্য যে কোন খাবার খাওয়ার সাথে বাচ্চার শরীরে লোম বেশি হওয়ার সম্পর্ক নেই। খাসির মাংস আমিষের ভাল উৎস। অনেকের গরুর মাংসে এলারজি থাকে তারা খাসির মাংস খান। ভুল ধারনার কারনে মা ও শিশু উভয়েই পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন।
#সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। এতে থাকে খুব উপকারি ওমেগা- ৩ ফ্যাটি এসিড যা বাচ্চার মস্তিষ্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ।
#জোড়া কলা খেলে জোড়া বাচ্চা হয়! কথাটি নিতান্তই হাস্যকর।
গর্ভাবস্থায় শিশু তার মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি নেয়। এসময় মায়ের চাহিদা বাড়ে। পুষ্টির অভাবে শিশুর মস্তিষ্ক ঠিকমত গঠন হয়না। ফলে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হয় না। বলা হয়ে থাকে, অন্য সময় মা যে পরিমান খান গর্ভকালীন তার চেয়ে প্রতি বেলায় এক মুঠো খাবার বেশি খেতে হবে। সন্তান প্রসবের পরও অতিরিক্ত খাবার খেতে হয়। প্রয়োজন পড়ে অতিরিক্ত পানি ও তরল পানের। তা না হলে শিশু মায়ের বুকের পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ পাবে না।
★নজরঃ
কিছু পুরাতন ধ্যান-ধারনা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মাঝে একটি অনুভব কাজ করে যে, ‘নজর’ লেগে বাচ্চা ও মায়ের ক্ষতি হয়! তাই মাকে অনেক সময় তার গর্ভবতী হওয়ার খবরটি চেপে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু, গর্ভাবস্থা চেপে যাওয়ার মত বিষয় না। বরং এটি মায়ের জন্য অত্যন্ত আনন্দের খবর যা সে সবার সাথে ভাগ করতে চায়। ভুল ধারনার শিকার হয়ে মা এবং গর্ভে অবস্থানকারী শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
★চাঁদ-সূর্যের অবস্থানঃ
চন্দ্র-গ্রহন, সূর্য-গ্রহন, ঠিক মধ্যদুপুর, সন্ধ্যাবেলা ইত্যাদি সময়ে বাইরে যাওয়া যাবে না! এমন কথা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। কিন্তু একথাটির কতটুকু ভিত্তি আছে তা বিবেচনা যোগ্য। গ্রহনের সময় খাওয়া যাবে না, কাজ করা যাবে না এমন প্রথা একেবারেই ঠিক নয়। সূর্যগ্রহন যদি কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হয় এবং এ অবস্থায় গর্ভবতী নারীর ক্ষুধা পায় তখন কি করবেন? প্রথার দোহাই দিয়ে এসব অনুচিত।
★বাচ্চার লিঙ্গঃ
বাবার শরীর থেকে আসা শুক্রাণুর মাধ্যমে নির্ধারিত হয় বাচ্চা ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে। আমাদের দেশে মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে মাকে দোষারোপ করা হয়। আমরা এটা বুঝতে চাইনা যে, বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণে মায়ের কোন হাত নেই। এটি আমাদের দেশের একটি প্রচলিত এবং ক্ষতিকর কুসংস্কার।
★ব্যায়ামঃ
শরীরকে যথেষ্ট সক্রিয় না রাখলে মা ও শিশু উভয়েই ক্ষতির সম্মুখিন হয়। গর্ভাবস্থায় শরীর সুস্থ রাখতে হালকা ব্যায়াম জরুরি। এতে শিশুর শরীরও ভাল থাকে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে হাল্কা থেকে মাঝারি ব্যায়াম করা ভাল। অনেক পরিবার আছে যারা এসময়ে ব্যায়ামের কথা শুনলেই নাকচ করে দেয়।
এসব ছাড়াও আরও আছে যেমনঃ কোন সমস্যা হলে তাকে তাবিজ-কবচ পড়ানো, ঝড়-ফুঁক করানো ইত্যাদি.......
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মা এবং শিশুর ক্ষতি হয় এমন কিছুই করা যাবে না....... কোন রকম আশঙ্খা দেখা দিলেই ডাক্তারের কাছে নেওয়া দরকার.......কুসংস্কার দূর করতে শিক্ষা, প্রচার মাধ্যম ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে পরিবারের মা-বাবা, দাদি-নানি সহ অন্যান্যদের সচেতন করতে হবে....
একমাত্র সচেতনতাই পারে কুসংস্কার গুলোকে দূর করে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে......