Entertainment & Discussions > Travel / Visit / Tour

দামতুয়া জলপ্রপাত

(1/1)

Md. Monir Hossain:


কিছু বিস্ময়ের জন্মই হয় প্রকৃতিতে মুগ্ধতা ছড়াতে। কিছু বিশালতার মধ্যে ক্ষুদ্র হয়েও আনন্দে ভাসতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ। বাংলাদেশের প্রকৃতি পরতে পরতে আড়াল করে লুকিয়ে রেখেছে নিজের সেরা সৌন্দর্যগুলোকে।

এবারের বান্দরবান-যাত্রা ছিল মাত্রই খোঁজ পাওয়া এক ঝরনা দেখার জন্য। এক বন্ধুকে ফোন দিলাম। মুহূর্তেই প্ল্যান করে ফেললাম আরেকটা অভিযানের। জাফর, স্বপন ভাই আর বাপ্পীকে সঙ্গে নিয়ে ঝুমবৃষ্টি মাথায় নিয়ে সোজা রওনা দিলাম মেঘ-পাহাড়ের দেশে। গন্তব্য ‘দামতুয়া জলপ্রপাত’।

বান্দরবানের আলীকদম বাসস্ট্যান্ড থেকে দামতুয়া যাওয়ার জন্য ‘আলীকদম-থানচি’র নতুন রাস্তা ধরে ১৭ কিলোমিটার যেতে হয়। মোটরসাইকেলে এক লহমায় মেঘ ফুঁড়ে উড়ে চললাম বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু এই রাস্তা ধরে। অদ্ভুত এই পাহাড়ি রাস্তা সৌন্দর্যের দিক দিয়ে হার মানিয়ে দেয় বাংলাদেশের আর সব পাহাড়ি রাস্তাকে। একখানে খাড়া নিচে নেমে যেতে হয় তো অন্যখানে চিত হয়ে ওপরের দিকে উঠতে হয়! এই দেখা গেল ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে আবার একটু পরেই মেঘের ভেতর হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে চলছি যেন। একবার মোটা মোটা গাছের সারি তো অন্যবার দূর পাহাড়ে বাড়ি!
এই করতে করতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম ১৭ কিলোমিটার দূরের আদুপাড়ায়। সেখানে রাস্তার পাশের দোকানে ঢুকতেই পাওয়া গেল স্থানীয় গাইড—নাম তার ইংরিং! সে জানাল এখানে দুই পাশে দুই ঝরনা আছে, কোনটাতে যাবেন? একটা নাকি আরেকটার চেয়ে বড়। জানালাম দামতুয়ায় যাব। কথা বলে অন্যদের দিকে তাকানোর আগেই ইংরিং সোজা জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। আমরা হাঁটা দিলাম তার পিছু পিছু।


সেই যে হাঁটা দিলাম, আর তো শেষ হয় না। আধা ঘণ্টা যায়, এক ঘণ্টা যায়—শুধু চড়াই, ওপরে ওঠা! হাঁপাতে হাঁপাতে বারবার ইংরিংকে জিজ্ঞেস করি আর কত দূর—সে নির্বিকারভাবে জানাল আরও এক ঘণ্টা। আমরা হতাশ, ওদের এক ঘণ্টা মানে আমাদের কমসে কম দুই ঘণ্টা! কোথাও এক ফোঁটা পানি নেই, অথচ সকালেই কী বৃষ্টিটাই না হলো!

এ পথের পাহাড়গুলো একটু অন্য রকম, বান্দরবানের অন্য পাহাড়গুলোর মতো ঢাল নেই এখানে, এক্কেবারে খাড়া, পাথুরে শরীর। দেখলেই মনে হয় অতিকায় দানব হাঁ করে আছে! একপাশে জুমের খেত আর একপাশে ঢাল নিয়ে পথ চলতে চলতে হঠাৎ শুনি পানির শব্দ। যাঁরা পাহাড়ে হাঁটেন, তাঁরা জানেন ঝরনার শব্দের চেয়ে মধুর কিছু আর নেই! এই শব্দ গলার ভেতর না ভেজালেও মুহূর্তেই কলিজাটা ভিজিয়ে দেয়, আমাদের হাঁটার গতি বেড়ে গেল বহুগুণ। শব্দ লক্ষ্য করে বাঁ দিকে তাকাতেই দেখা গেল বিস্ময়! একসঙ্গে চার-পাঁচটি পানির ধারা পাশের পাহাড় থেকে হুমহাম করে নেমে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে চেরাপুঞ্জির সেভেন সিস্টার ওয়াটারফলসের খুদে সংস্করণ! ইংরিং তাগাদা দিল, দাদা থেমে থাকলে হবে না, যেতে হবে আরও দূর! ঝরনাগুলোকে মনের ফ্রেমে বন্দী করে আবার পা বাড়ালাম আরও বিশাল কিছু দেখার জন্য।

এবার প্রকৃতি বদলে গেল! এখন একটু পরপরই পানি পাওয়া যাচ্ছে, হঠাৎ দেখি চলতি পথে বিশাল ঝিরি! ইংরিং জানাল এই পানি নিচে গিয়ে একটা ঝরনা হয়েছে। সেটার নাম ‘তুক অ’। অবাক আমরা এ আবার কেমন নাম! পাহাড়ি ভাষার ‘তুক অ’ মানে ‘ব্যাঙ ঝিরি’। কোমরপানি ডিঙিয়ে একেবারে ঝিরির মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আসলেই তাই—এই বিশাল পানি হঠাৎ করেই শূন্যে পড়ছে। নিচে একটা বিশাল পাথরে পড়ে আবার লাফ দিয়ে আরেকটু দূরে গিয়ে পড়ছে, একেবারে নিচে! পুরোই ব্যাঙের মতো! এরপরের গল্পটুকু শুধু হারিয়ে যাওয়ার। ‘কাখইপাড়া’ পার হয়ে আমরা বিশাল এক ঝিরিপথে পড়লাম। বৃষ্টি হওয়ায় সে পানি ফুলেফেঁপে একাকার, ঘোলাটে। এই ঝিরিপথে আধঘণ্টার মতো কোমরপানি পার হয়ে আমরা মুখোমুখি হলাম জঙ্গলের সবচেয়ে কঠিন সত্যের—ইংরিং রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে!

শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা এক ঘামের স্রোত গড়িয়ে পড়ল। এখন বাজে বিকেল সাড়ে চারটা, এখনো দামদুয়ায় পৌঁছাতে পারিনি। এর মধ্যে রাস্তা হারানো মানে জঙ্গলেই থেকে যেতে হবে সারা রাত! আকাশে খুব ভয়ংকরভাবে হুমকি দিচ্ছে মেঘের আসর। নিচে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমরা পাঁচজন পাঁচ কোনায় বসে আছি। ইংরিং একবার জঙ্গলে ঢুকছে, একবার ঝিরিপথে নেমে যাচ্ছে—কী করবে বুঝতে পারছে না। এই থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে যা করা উচিত ঠিক তাই করলাম আমি আর জাফর—সোজা নেমে গেলাম সানের গলাপানির ঝিরিতে, দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে নেই। সামনে না এগোলে কখনো আলোর মুখ দেখা যাবে না। ফলাফল—হাত-পা কেটে, স্যান্ডেল হারিয়ে, মোবাইল ভিজিয়ে অন্ধের মতো হ্যাঁচোড়ে-প্যাঁচোড়ে মুখোমুখি হলাম জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের মুখোমুখির! মেঘের গর্জনকে ছাপিয়ে একটানা বিশাল পানি পড়ার ঝরঝর শব্দ! পাঁচজন একবার করে নিজেদের দিকে তাকালাম, সবার চোখে জয়ের নেশা! এত কষ্ট তাহলে আমাদের সার্থক!

সামনে এগিয়ে যা দেখলাম সেটার জন্য আমরা আসলেই প্রস্তুত ছিলাম না। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মতো বিশাল এলাকা নিয়ে গড়গড়িয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে! বিশাল এক ক্যাসকেইড! এত বড় জলধারা আমি এর আগে বান্দরবানের কোনো পাহাড়ে দেখিনি! কী বিশাল আয়তন, কী গম্ভীর তার গর্জন! তখনো জানতাম না এই জলপ্রপাতটা দামতুয়ার ঠিক ওপরের ঝিরিপথ, এর পুরো পানিই নেমে গেছে দামতুয়ায়। সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেই আমরা নামলাম প্রায় ৮৫ ডিগ্রি খাড়া এক পাহাড় বেয়ে। বলা হয় সুন্দর কিছু পেতে হলে সহ্যের শেষ সীমায় গিয়ে কষ্ট করতে হয়। আমরা কয়েকজন শেষ সীমায় পা দিয়ে পিছলে গড়িয়ে গেলাম। কাদামাটি আর নুড়িপাথরে গড়গড় করে নেমে একে অপরের গায়ে পড়ে, নাকে-মুখে কাদা লাগিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই সব জ্বলুনি, সব কষ্ট বিলীন হয়ে গেল। চোখের সামনে ভয়ংকর গর্জন করে এই গোধূলির শেষ আলোয়ও পুরো আকাশ আলো করে অবিরাম ঝরছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত! বিশাল তার আকার, এক ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা যায় না এমন বিশাল সে! এখানে একসঙ্গে তিনটি ঝরনার পানি এসে পড়ছে, যার মধ্যে দুইটার পানি পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। দামতুয়া মূল পানিটুকু প্রবল আক্রোশে নামছে মাটিতে। সেখানের আশপাশেও দাঁড়ানো যায় না এমন অবস্থা! কান ফাটানো গর্জন আর দৃষ্টি আড়াল করে দেওয়া সাদাটে পানির মাঝে একবার পড়লে খেই হারিয়ে ফেলবে যে কেউই। আমরা হারালাম, ভুলে গেলাম সময়ের হিসাব, ভুলে গেলাম আমাদের ফিরতে সময় লাগবে আরও তিন ঘণ্টা! এত বড় বিশালতার মুখোমুখি এর আগে যে তেমন হইনি!

অন্ধকার হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে যখন ফেরার তাড়া এসে টানতে শুরু করল আমাদের, তখন থেকেই মন খারাপের শুরু! এখানে মাত্র ঘণ্টাখানেকের জন্য যাওয়া মানে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু মুহূর্তের অপচয়, এখানে অল্প কিছু সময়ের জন্য যাওয়া মানে নিজের প্রতি ঘোরতর অন্যায় করা। এখানে আসলে এক রাত থাকতে হবে, পানির ঘুমভাঙানি শব্দে চোখ খুলেই মুখোমুখি হতে হবে সইতে পারা সৌন্দর্যের মুখোমুখি! ফিরে আবার আগে ওপর থেকে আরেকবার দেখলাম এই জলদানবকে। নিজের জন্য না হলেও মনের শখ মেটাতে আরেকবার আসতে হবে এই ঝরনায়, মায়াবী কোনো এক পূর্ণিমা রাতে।

Source :http://www.prothom-alo.com/life-style

Navigation

[0] Message Index

Go to full version