Entertainment & Discussions > Story, Article & Poetry

আদালতপাড়ার দুর্ভোগ দূর করবে কে?

(1/1)

kekbabu:
আদালতপাড়ার দুর্ভোগ দূর করবে কে?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২২ ডিসেম্বর, ২০১৭; কালের কণ্ঠ (পৃষ্ঠা: ১৪)
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, এই লেখার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই আদালতকে অবমাননা করা নয় কিংবা আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট করা নয়। বরং দেশের আদালত অঙ্গনে বাহ্যিকভাবে যেসব সমস্যা বিরাজমান, তা তুলে ধরা, যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে আদালতের কার্যক্রম গতিশীল করে এবং সঠিক সময়ে জনগণের ন্যায়বিচারের পথ সুগম করে। যা হোক, আমরা সবাই জানি যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের তিনটি বিভাগ রয়েছে। যথা—আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সরকারের তিনটি বিভাগই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের কাজ পারস্পরিক নির্ভরশীল ও একে অপরের পরিপূরক। আইনসভার আইন ও বিচার বিভাগের আদেশগুলো নির্বাহী বিভাগ বাস্তবায়ন করে। বিচার বিভাগ আইনসভা প্রণীত আইন অনুসারে আদেশ দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের আদালত অঙ্গনগুলো বাহ্যিকভাবে নানা সমস্যায় জর্জরিত, যা বিচার বিভাগের কাজের গতিশীলতা চরমভাবে হ্রাস করে। দেশের আদালত অঙ্গনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, বিচারক সংকট, এজলাস সংকট, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, জরাজীর্ণ ভবন, বিশ্রামাগার ও টয়লেটের অভাবসহ নানা সমস্যা। আর এসব সমস্যা মাথায় নিয়েই চলছে দেশের আদালত। দেশের আদালতপাড়ায় বহু ধরনের সমস্যা বিদ্যমান থাকার কারণে বিচারপ্রার্থীদের প্রতিনিয়ত পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, শিকার হতে হচ্ছে চরম বিড়ম্বনার। অনেক সময় দেখা যায়, বিচারকদের একই এজলাস পালাক্রমে ব্যবহার করতে হয়। যেমন দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে কোনো আদালত সকাল পৌনে ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে। আবার ওই একই এজলাস দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ব্যবহৃত হয় অন্য আদালত হিসেবে। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও একই এজলাস পালাক্রমে অনেক সময় ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষয়টি এমন যে একজন বিচারক এজলাস ছেড়ে দিলে তবেই আরেকজন বিচারক ওই এজলাসে বিচারকাজ পরিচালনা করেন। একই এজলাস দিনে দুইবার দুই আদালতের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অনেক মানুষকেই বিচারপ্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারণ এজলাস সংকটের কারণে বিচারকরা তাঁদের পুরোটা সময় বিচারকাজ করতে পারছেন না। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিচারকদের এজলাস ত্যাগ করতে হয় মামলা নিষ্পত্তি করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। গুরুত্বপূর্ণ মামলা রেখেই বিচারকদের এজলাস ত্যাগ করার ফলে বিচারপ্রার্থীরা সঠিক সময়ে বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তা ছাড়া বিচারপ্রার্থীদের অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ সময়ের অপচয় বা লয় (ধ্বংস) তো রয়েছেই। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ১৭১টি আদালতে এজলাস নেই, যা দুঃখজনক বিষয়। আর এসব সমস্যা মোকাবেলা করেই সংশ্লিষ্ট বিচারককে মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে মাসিক প্রতিবেদন পাঠাতে হচ্ছে।

অনেক আদালতে চেয়ার-টেবিল সংকটের কারণে মামলার কার্যক্রম চলার সময় বিচারপ্রার্থীসহ আইনজীবীদেরও আদালতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময় ধরে। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী কিংবা অসুস্থ কোনো ব্যক্তি হন, তাহলে তাঁদের সমস্যার অন্ত থাকে না। আবার বৃষ্টির দিনে দেশের অনেক আদালতপাড়ায় বিচারক, বিচারপ্রার্থী জনগণ, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। কারণ বিভিন্ন আদালতে যাওয়ার রাস্তায় পানি ও কাদা জমে থাকা। সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষাকালে বা বৃষ্টির দিনে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া দেশের অনেক আদালত ভবন জরাজীর্ণ ও টিনশেডের। বৃষ্টির দিনে বা বর্ষাকালে এসব জরাজীর্ণ ভবনের ছাদের পানি চুইয়ে কিংবা টিনের ফুটো দিয়ে পানি নিচে (আদালতের মধ্যে) পড়ার কারণে আদালত মুলতবি করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তা ছাড়া এ অবস্থার ফলে আদালতে সংরক্ষিত ফাইলপত্র বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, দেশের অনেক আদালতে নেই কোনো বিশ্রামাগার, নেই কোনো ট্রায়াল রুম, আবার অনেক আদালতে এপিপিদের জন্য আলাদা চেম্বার এবং আদালতে আসা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্য নেই কোনো কক্ষ বা জায়গা। এসব সমস্যার ফলে আদালতের বিচার কার্যক্রম শুরুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিচারপ্রার্থীদের বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় অসুস্থ ব্যক্তি ও ব্রেস্ট ফিডিং করা মায়েদের। আদালতে বিশ্রামাগার না থাকার কারণে বিচারপ্রার্থী অসুস্থ ব্যক্তিদেরও দুর্ভোগের সীমা থাকে না। আবার আদালতের সামনে সাক্ষীদের ভালোভাবে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ট্রায়াল রুমের প্রয়োজন থাকলেও দেশের অনেক আদালতেই তা নেই। ফলে অনেক সময় আদালতের সামনে ভালো সাক্ষ্য না হওয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, অনেক আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) জন্য বসার আলাদা চেম্বার থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এপিপিদের বসার জন্য আলাদা কোনো চেম্বার নেই, যা এপিপিদের জন্য নিঃসন্দেহে মানসিক কষ্টের বিষয়।

দেশের অনেক আদালতেই নেই পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক যানবাহন। প্রয়োজনীয়সংখ্যক যানবাহন না থাকায় অনেক সময় বিচারকদের একই গাড়িতে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে আদালতে যাওয়া-আসা করতে হয়, যা একই সঙ্গে যেমন শারীরিক ও মানসিক কষ্টের বিষয়। যানবাহন সংকটের কারণে অনেক সময় অনেক বিচারক নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। কারণ আদালতের কাজকর্ম শেষ করে অনেক বিচারক আদালতপাড়া থেকে জেলা শহরে থাকেন আর কোনো বিচারককে যদি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করতে হয়, তাহলে অবশ্যই তিনি নিরাপত্তাহীনতা বোধ করবেন। কারণ তাঁর দেওয়া মামলার রায়ে সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা তিনি হামলার শিকার হতে পারেন। যানবাহন সংকটের পাশাপাশি বিচারকদের আবাসন সমস্যার বিষয়টিও বেশ প্রকট। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বিচারকদের বাসস্থান নির্মাণের আদেশ দিলেও এখনো সব বিচারকের বাসস্থান নিশ্চিত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জেলায় কর্মরত সব বিচারকের জন্য যদি একই স্থানে বসবাসের লক্ষ্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তাঁদের নিরাপত্তা ও যাতায়াত উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা হবে। 

‘সময় অত্যন্ত মূল্যবান’—এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, ‘অজ্ঞাত কারণে’ অনেক আদালত নির্ধারিত সময়ে বসে না। একজন আইনজীবীর প্রতিদিন বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু আদালত সঠিক সময়ে না বসার কারণে আইনজীবীরা সঠিক সময়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনা করতে সক্ষম হন না। ফলে আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থীদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়। আবার মামলাজট নিরসনের উপায় হিসেবে আদালতে সাক্ষী হাজির করতে দেশের বেশির ভাগ আদালতে এখন পর্যন্ত চালু হয়নি ই-ডেস্ক। আইন-আদালত সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন যে ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সাক্ষীদের যথাসময়ে আদালতে হাজির না করা। আর সাক্ষীদের হাজির করার বিষয়ে আদালত পুলিশের ওপর নির্ভরশীল। পুলিশ সাক্ষী হাজির না করলে আদালতের শুনানির তারিখ পেছানো হয় এবং শুরু হয় মামলার দীর্ঘসূত্রতা। এই সমস্যা সমাধানকল্পে আদালতগুলোতে ই-ডেস্ক চালু করা, ই-ডেস্ক থেকে আদালতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নির্ধারিত তারিখের আগে সাক্ষীর সঙ্গে যোগাযোগপূর্বক আদালতে সাক্ষীর হাজির হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইন সংশোধনপূর্বক এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন পুলিশ আদালতে চার্জশিট দেওয়ার সময় সাক্ষীর মোবাইল-টেলিফোন নম্বরসহ পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা উল্লেখ করতে বাধ্য হয়।     

অভিযোগ পাওয়া যায়, আদালতের বেশির ভাগ পিয়ন, পেশকার, জারিকারক ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই ঠিকমতো করতে চান না, যেন এটি একটি অলিখিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক সময় বিচারপ্রার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, পিয়ন-পেশকারদের কাছে বিচারপ্রার্থীরা মামলাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য নিতে গেলে বা কোনো সহযোগিতা চাইতে গেলে তাঁরা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করতে চান না। ফলে বাধ্য হয়েই ঘুষ দিতে হয়। এসব পিয়ন, পেশকার ও জারিকারকের জমিজমা, বাড়ি, সম্পদ ও টাকা-পয়সার সঠিকভাবে হিসাব নিলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলবে বলেই আশা করা যায়। এ সমস্যা ছাড়াও আদালত অঙ্গনে রয়েছে টাউট-দালালদের দৌরাত্ম্য; আইনজীবী না হয়েও কালো কোট, টাই ও গাউন পরিধান করে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা বিচারপ্রার্থী সহজ-সরল ব্যক্তিদের নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে ‘মক্কেল সংগ্রহ’ করা; মানসম্মত খাবারের হোটেলের অভাব, প্রয়োজনীয়সংখ্যক ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেটের অভাব; বার ও বেঞ্চের দূরত্ব বিদ্যমান থাকা; বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) উদ্যোগ কম থাকা ইত্যাদি।

বিচার বিভাগের কাজকে গতিশীল করাসহ সঠিক সময়ে জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে দেশের আদালত অঙ্গনে বিরাজমান সমস্যাগুলো শনাক্ত করে তা দূর করার কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার তথা আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। এ কথা সবার মনে রাখতে হবে যে আদালতই হচ্ছে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল; শেষ আশা-ভরসার জায়গা। তাই আদালত অঙ্গনে নানা ধরনের সমস্যা বিদ্যমান রেখে সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2017/12/22/580272

Navigation

[0] Message Index

Go to full version