প্রায় ১৪ - ১৫ বছর আগের কথা। আমাদের নিজেদের বাসায় তখন ৩ - ৪ বছর হয়েছে। জুন মাসে বর্ষার সময় খেয়াল করলাম বাসার ছাদে অনেক ময়লা আর শেওলা পড়ে গেছে। বুঝলাম বাসার কাজের লোকের পক্ষে এইটা পরিস্কার করা সম্ভব নয়। গেলাম উত্তরার আজমপুরে। অনেক দিন থেকেই দেখেছি সেখানে শ্রমজীবী মানুষের ভীর থাকে। সাধারণ ভাষায় এদেরকে কামলা বলা হয়। তখন আমাদের এরিয়াতে অনেক বিল্ডিঙয়ের কন্সট্রাকশন মহাসমারোহে চলতেছে। তাই সকালে সেখানে অনেক বেশি ভীর হয় এই শ্রেণীর কর্মজীবী মানুষের। এরা সকালে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে বাস থেকে নেমে এইখানে কাজের অপেক্ষা করে। আবার দিন শেষে কাজ করে বাসে বাড়ি ফিরে যায়। এদের মধ্য দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম দেখলাম ভিন্ন এক জগত। সবার এক উৎসুক দৃষ্টি আমাকে ফলো করে চলেছিল। যাই হোক ভীরের বাইরে থেকে দুইজনকে নিয়ে আসলাম। ছাদ দেখিয়ে দিলাম।
দুই জন কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে কাজ করতে লাগল। এর মধ্যে শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। তাতেও তাদের কোন বিরাম নাই। সেই বৃষ্টির মাঝেই পরিস্কার করে চলল তারা। একবার বললাম বৃষ্টি থামলে কাজ শুরু করতে। জ্বর টর হতে পারে। শুনলো না। এক নাগাড়ে দোতালার ছাদ থেকে শেওলা পরিস্কার করে নীচে নামাতে লাগলো। কয়েকবার বললাম সাবধানে কাজ করতে - পিছলিয়ে যেন পড়ে না যায়। পরিশেষে বুঝলাম এই কথা গুলো তাদের অভিজ্ঞতার ডিকশনারিতে নাই।
তখন এই শ্রেণীর একজন শ্রমজীবী মানুষকে সারা দিন কাজ করালে ৮০ টাকা দিতে হত। এর বাইরে আর কিছু না। নাই কোন দুপুরের খাবার দেয়ার বা তার অর্থ দেয়ার ব্যাপার।
আমাদের সমাজে এইশ্রেনীর মানুষদের জীবন কত ভিন্ন। এদেরকে কেউ বসতে বলে না। গেটেই এদের স্থান। এর ভীতরে এদের কোন প্রবেশাধিকার নাই। আমরা আমাদের সমাজের সমশ্রেনীর মানুষদের হায় হেলো বলি - আপ্যায়ন করি। কিন্তু এদের প্রতি আমাদের অনেক ভিন্ন আচরন থাকে। আমাদের সমাজে তারা এলিয়েন। এদের সনতানদের কে কেউ আদর করে ডাকে না। বা চকলেট লজেন্স সাধে না। কোন ক্লাসে পড়ে বা কোন স্কুলে যায় তা প্রশ্ন করা অবান্তর বলে মনে হয় আমাদের কাছে। এরা যখন আমাদের পাশে আসে তখন কি সুস্পস্ট ভাবে পার্থক্যটা চোখে পড়ে।
অথচ পথে ঘাটে বিপদে পড়লে আর কেউ এগিয়ে না আসলেও এরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমরা নিজেরা ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার করতে করতে ভাবি এর পরে কি খাব। এদের বেলায় আমাদের মনে হয় দুই বেলা খেতে পারলেই এদের জন্য অনেক। জন্মদিন, নিউ ইয়ার, নববর্ষে কেক কাটি, বিভিন্ন রঙয়ের জামা পড়ি। পরের বিশেষ দিনে সেই গুলো বাতিল করে দেই। আর এদের খালি গায়ে থাকাই আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়। পরিশেষে মনে হচ্ছে - শিক্ষা সেইটা না - যা আমাদের ইনকাম বাড়িয়ে দেয়। শিক্ষা সেইটাই যেইটা আমাদের জীবনে কষ্ট করতে শেখায়।
(আমার ফেসবুক পোস্ট থেকে।)