মুক্তিযোদ্ধা থেকে পপ সম্রাট হয়ে ওঠা গুরু আজম খান

Author Topic: মুক্তিযোদ্ধা থেকে পপ সম্রাট হয়ে ওঠা গুরু আজম খান  (Read 1698 times)

Offline 710001113

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 493
    • View Profile
By Agnishwar Nath
মায়াময় দৃষ্টির প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন না বলা এক একটি কবিতা। কাব্যের হাত ধরে সুরের বর্ণ পরিচয়। বন্দুক ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেক আগেই। পিতৃআজ্ঞা পালন করে দেশকে মুক্ত করতে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অধ্যায়ও কবেই চুকেবুকে গেছে। হাতের ‘গান’ ফেলে দিলেও কণ্ঠের গানতো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। হয়ে গেলেন যোদ্ধা থেকে গানের বোদ্ধা। রণাঙ্গন ছেড়ে একেবারে সঙ্গীতাঙ্গনে। সেই থেকে কোটি মানুষের অন্তরে মিশে যাওয়া এক নাম, আজম খান। যে নাম কখনও মোছার নয়, কারণ তিনি যে গুরু। গুরুদের কখনো আমরা হারাইনি, হারাতে পারি না।

গুরু আজম খানকে শ্রদ্ধা; source: bangladesh24online.com
১৯৬৮ সাল, তখন ছাত্রাবস্থায় আজম খান। খুব সাদামাটা গোছের দেখতে, লিকলিকে দীর্ঘদেহী যুবকটি। লম্বা চুলে সারল্য মাখা চাহনি। কিন্তু চাল-চলনে ব্যক্তিত্বের ছাপ ষোলোআনা। বয়স তখন আঠারো ছুঁই ছুঁই। গান বাজনা নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসেন সব সময়। কখনো মনে হয়নি এই ছেলের বুকেও জ্বলছে পরাধীনতার লেলিহান শিখা।

মঞ্চে আজম খান; source: cartilage-consortium.blogspot.com
যুক্ত হলেন গণশিল্পীগোষ্ঠী ‘ক্রান্তি’র সাথে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগীতের মাধ্যমে নতুন জোয়ার তোলার চেষ্টায় রত হলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরু হলে নিজেকে আর ঘরে বেঁধে রাখতে পারেননি তিনি।
বাড়ি থেকে বিদায় বলে রওনা দেয়া, বন্ধুদের নিয়ে হাঁটা পথে কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে আগরতলা পৌঁছানো, সেখান থেকে মেঘালয়ে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে দু’মাস গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া- সবই যেন একটা ঘোরের মধ্যেই হচ্ছিল।
কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধের সাফল্যের পর তাকে একটা সেকশনের ইন-চার্জ করে ঢাকায় পাঠানো হয় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকায় গেরিলা তাণ্ডবে পুরো পাকিস্তানি বাহিনীর ঘুম উধাও করে দিয়েছিল আজম খানের দল। তার হাত ধরেই এলো ‘অপারেশান তিতাস’। ঢাকা শহরের গ্যাস পাইপলাইন নষ্ট করে দিয়ে বিদেশীদের জানান দেয়া যে এদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, এটাই ছিল এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য। অপারেশনের সময় তার বাম কান আঘাতপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সেসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংঘটিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

আজম খান ও তার ব্যান্ড দল; source: amradhaka.com
কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেও কখনো গানটাকে ভোলেননি তিনি। সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতে সহযোদ্ধাদের কাছে তার গানই ছিল একমাত্র বিনোদন। আজম খানের স্মৃতিকথা উল্লেখ করতে গিয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেন,
“২০শে আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।”

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম; source: pinterest.de
অবশেষে এলো সেই বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সেতুবন্ধন মনের মতো হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ তখনও যেন অপেক্ষা করছিল আরেকটি সংগ্রামের। সেটি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি ও শিল্প সংস্কৃতির শক্তিশালী অবস্থান অর্জনের সংগ্রাম। দিশাহীন পথের গন্তব্য খোঁজার চেষ্টায় পাশে পেলেন ‘আখন্দ’ ভাতৃদ্বয়কে- হ্যাপি আখন্দ এবং লাকী আখন্দ, গড়ে তুললেন ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’। ব্যান্ড স্পন্দনের পর এটি ছিল বাংলা নামে স্বাধীন দেশের দ্বিতীয় ব্যান্ড। গিটারে থাকলেন আজম খানের বন্ধু নিলু আর মনসুর, ড্রামে সাদেক আর নিজে রইলেন প্রধান ভোকাল হিসেবে। ১৯৭২ সালে বিটিভির ডাকে দুটি গান উপস্থাপন করল তাদের ব্যান্ড। একটিতে গাইলেন,
হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে
এতো সুন্দর দুনিয়ায়
কিছুই রবে না গো
হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে।
আরেকটি গান ছিল, ‘চার কালেমা সাক্ষী দেব’। মরমী ধারার এই গান দুটি মানুষের অন্তরের গভীরে নতুন এক আবেগের সঞ্চার ঘটায়, যা আজম খানকে কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে দেয়।

নিজ বাড়িতে আজম খান; source: prothom-alo.com
১৯৭৪-১৯৭৫ সাল, যুদ্ধ পরবর্তী হাহাকার চলছে চারদিকে। না পাওয়ার বেদনা স্বাধীনতার উল্লাসকে অনেক পেছনে ফেলে রেখে এসেছে। এই সময় আজম খান গাইলেন এক হতাশার গান,
রেললাইনের ঐ বস্তিতে
জন্মেছিল একটি ছেলে
মা তার কাঁদে
ছেলেটি মরে গেছে।
হায়রে হায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ
হৈ চৈ পড়ে গেল চারদিক। এ যেন এক নতুন জাগরণ। হাজার মানুষের মনের কথা যেন ফুটে উঠছে তার কণ্ঠে। শুরু হলো বাংলায় পপ গানের বিস্তার। তারই হাত ধরে ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের গানের জগতে আসা। ধীরে ধীরে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে পপ সম্রাট হয়ে উঠলেন সঙ্গীতের মহাগুরু আজম খান।

একই মঞ্চে ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও পিলু মমতাজের সাথে আজম খান; source: sayou.wordpress.com
তার পুরো নাম ছিল মাহবুবুল হক খান। জন্মেছিলেন ঢাকার আজিমপুরে দশ নাম্বার কোয়ার্টারে, ১৯৫০ সালে। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট, মা জোবেদা খাতুন। তার ছিল তিন ভাই ও এক বোন।
পড়ালেখা শুরু হয় ১৯৫৫ সালে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে। ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের জাগরণ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পড়ালেখা আর এগোয়নি তার।

আজম খান; source: ইমতিয়াজ আলম
বিয়ে করেন ১৯৮১ সালে ঢাকার মাদারটেকের সাহেদা বেগমকে। তাদের ঘরে আসে এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। সহধর্মিণী মারা যাবার পর থেকে অনেকটা নিভৃতে অনাড়ম্বর একাকি জীবন যাপন করে গেছেন আজম খান। একটা সময় গান থেকেও অনেক দূরে সরে যান। সুরের বাণিজ্যিকরণে নিজেকে কখনো বিকোতে চাননি তিনি।
১৯৮২ সালে ‘এক যুগ’ নামের এ্যালবাম দিয়ে অডিও জগতে আত্মপ্রকাশ করেন আজম খান। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে মোট ১৭টি একক এ্যালবাম করেন। তার উল্লেখযোগ্য এ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে দিদি মা, বাংলাদেশ, কেউ নাই আমার, অনামিকা, কিছু চাওয়া, নীল নয়না ইত্যাদি।

ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফকির আলমগীরের সাথে আজম খান; source: jaijaidinbd.com
আজম খানের মঞ্চে বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনা, গান গাওয়ার আকর্ষণীয় ভঙ্গি এখনও আমরা ভুলতে পারি না। সঙ্গীত ছাড়াও মিডিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কাজ করেছেন। ১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও ২০০৩ সালে ‘গডফাদার’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞাপন জগতে তিনি পদার্পণ করেন  ২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। পরবর্তিতে বাংলালিংক ও কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনেও কাজ করেন তিনি।

গেরিলা যুদ্ধের পোশাকে আজম খান; source: amradhaka.com
গানের পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলেছেন আজম খান। গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। তার বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনে অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন, যার মধ্যে হলিউড থেকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে ‘বেস্ট পপ সিংগার অ্যাওয়ার্ড’, ‘টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২’, ‘কোকাকোলা গোল্ড বটল’ সহ ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ অন্যতম।

চেনা জগতে আজম খান; source: pchelplinebd.wordpress.com
বলিষ্ঠ মনোবল আর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের এই লোকটির না পাওয়ার ক্ষোভ ছিল অনেক। দেশের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন এই অভিমানী ক্ষণজন্মা বীর। বেশি কিছু চাহিদা ছিল না বলেই হয়তো শ্রোতাদের ভালোবাসাটাকেই বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন দেশের মানুষ সঠিক পথে চলবে, স্বাধীন দেশে স্বাধীন পতাকায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে আটকে পড়লেন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের কবলে। গানের জগতকে শূন্য করে ২০১১ সালের ৫ জুন অসংখ্য গানপাগল ভক্তদের কাঁদিয়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। আর মহাগুরুর স্মরণে তার গাওয়া একটি গান বারবার মনে বাজে অসংখ্য ভক্তের,
হারিয়ে গেছে খুঁজে পাবো না।
এতো দিনের আশা হল নিরাশা।
যদি জানিতাম তবে আর মিছে মরিতাম না।।
ভালোবাসা, শুধু মিছে আশা।
এ জীবনে তারে আর ফিরে পাব না।।