রাতের আকাশে তাকিয়ে থাকার সময় তারকাময় দৃশ্যের সাথে দেখতে অনেকটা তারারই মতো উজ্জ্বল এবং ধীরে ধীরে চলতে থাকা কোনো বিন্দু আপনার চোখে পড়েছে? যদি সেটা মিটমিট করে না জ্বলে থাকে তবে আপনার জন্য সেটি অনেক আনন্দঘন এক মুহূর্ত। কারণ সেই চলমান বিন্দুটিই হলো মানব ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব উদ্ভাবন যাতে অবদান ছিল ১৬টি দেশের। সেটি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস) বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো মহাকাশ বিষয়ক গবেষণাকে আরো ত্বরান্বিত করা। ভবিষ্যতে মহাকাশে মানুষের অভিযান, মাইক্রোগ্র্যাভিটি, মহাকাশে জীবের টিকে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করা হয় এখানে। ১৬টি দেশের সহযোগিতা আর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল এই বাসযোগ্য কৃত্রিম উপগ্রহের মহাকাশে যাত্রার সূচনা হয় ১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর কাজাখস্তানের বাইকোনুর কসমোড্রোম লঞ্চ সাইটের একটি লঞ্চ প্যাড থেকে প্রোটন-কে নামের রাশিয়ান রকেটের মাধ্যমে।
আকারে প্রায় একটি ফুটবল মাঠের সমান আর ওজনে প্রায় ৩২০টি গাড়ির থেকেও বেশি (প্রায় ৪৫০ টন) এই মহাকাশ স্টেশনকে একদিনে কিন্তু পুরোটাকে তার কক্ষপথে পাঠানো হয়নি। আগেই বলেছি, এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক টুকরো ইতিহাস। প্রায় বার বছর ধরে ৩০টিরও বেশি মিশন পরিচালনার মাধ্যমে পূর্ণতা পায় আইএসএস।
প্রতি ঘণ্টায় ২৮,০০০ (প্রায়) কিলোমিটারেরও বেশি বেগে পৃথিবীকে প্রতি ৯০ মিনিটে একবার প্রদক্ষিণ করে চলেছে এটি। ১৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে আবর্তনরত এই দানব স্পেস স্টেশন একদিনে আনুমানিক ১৬ বার প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীকে। মহাকাশের লোয়ার আর্থ কক্ষপথে পৃথিবী থেকে ৪০৮ কিলোমিটার দূরত্বে আবর্তন করে চলেছে আইএসএস।
কিন্তু শুরুর গল্পটা এখনো জানা হলো না। এবারে পাড়ি জমানো যাক বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মহাকাশ স্টেশনের শুরুর সময়টাতে। একটা সময় ছিল যখন মহাকাশ স্টেশনের কথা কেবল বিজ্ঞান কল্পগল্পেই শোভা পেত। কিন্তু বাস্তবতার মুখ দেখতে পাড়ি দিতে হয়েছে বেশ কিছুটা পথ। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কথা বলতে গেলে শুরুতেই যে মানুষটার নাম উঠে আসে তিনি হলেন আমেরিকার চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান। ১৯৮৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি নাসাকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অন্যান্য দেশের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি স্পেস স্টেশন তৈরি করার আদেশ দেন দশ বছরের মধ্যে, যাতে মানুষ মহাকাশে থেকেই আরো নিখুঁতভাবে গবেষণার কাজগুলো করতে পারে। শুরু হয় মহাকাশ স্টেশন তৈরির কার্যক্রম। এর দুই বছর পরই জাপান, কানাডা এবং ইউরোপ এই প্রকল্পে অংশীদারির চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৮৭ সালে এর চুড়ান্ত নকশা সম্পন্ন হয় আর তার পরের বছরই রিগান এর নাম দেন ‘ফ্রিডম‘।
কিন্তু এই প্রকল্পে বাঁধ সেধে বসে অর্থ সংকট। নকশাকৃত স্পেস স্টেশন ফ্রিডমের নির্মাণের জন্য খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার ধ্বংসে সাতজন ক্রুর মৃত্যুর পর এই প্রজেক্টের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় আসার পরে ১৯৯৩ সালে পুনরায় এর নকশা করার আদেশ দেন। কিন্তু এবারের খরচের দিকটা মাথায় রেখে নকশা করার এবং আরো কিছু দেশের সহযোগিতার জন্য আদেশ আসে।
এবারের খরচের কথা মাথায় রেখে আরো উন্নত একটি মডেল তৈরি করা হয় যার নাম দেয়া হয় ‘আলফা’। কিন্তু খরচ আরো কমে আসে রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। স্থগিত রাখা রাশিয়ান স্পেস স্টেশন মির-২ এর যন্ত্রাংশ আর মডিউলগুলো ব্যবহার করা হয় এতে। সবমিলিয়ে আগের ফ্রিডমের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী আর উন্নত একটি স্টেশন তৈরি সম্ভব হয়। আর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’।
যুক্তরাষ্ট্র (নাসা), রাশিয়া (রসকসমস), ব্রাজিল, কানাডা (কানাডা স্পেস এজেন্সি), জাপান (জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি) এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রধান ১১টি দেশের ‘স্পেস স্টেশন ইন্টার গভর্নমেন্টাল অ্যাগ্রিমেন্ট’-এ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে রচিত হয় সম্মিলিতভাবে কাজ করার এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। এর মাধ্যমে সবগুলো দেশ প্রয়োজন অনুযায়ী আইএসএস মডিউল পাঠানো, আর্থিক সহায়তা, মিশন পরিচালনা এবং এর দেখাশোনা করা, গবেষণা আর তথ্য ভাগাভাগি করে নেয়ার নিশ্চয়তা পায়। ১৫০ বিলিয়নেরও বেশি মার্কিন ডলার ব্যয়ে তৈরি এই স্পেস স্টেশন ২০১৫ সালের এক তথ্যানুযায়ী মানব ইতিহাসে তৈরি সবথেকে ব্যয়বহুল বস্তু।