যোগ্যতা ও পরিপূর্ণ শর্ত মোতাবেক কোনো লোক পাওয়া না গেলে উপস্থিত লোকদের মধ্যে যোগ্যতা ও আমানতদারি তথা সততার দিক
দিয়ে যে সবচেয়ে অগ্রবর্তী
হবে, তাকেই অগ্রাধিকার
দিতে হবে
শিরোনামোক্ত বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আলোচনা-সমালোচনা, আন্দোলন, ধরপাকড় চলছে। ফলে বিষয়টি সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিকোণ জানতে অনেকেই আগ্রহী। আমরা মনে করি, আমাদের সরকার, জনগণের বৃহত্তর অংশ, যারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছেন বা যাদের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করা হচ্ছেÑ সবাই এ সম্পর্কে ধর্মীয় নির্দেশনাকে সম্মান ও মূল্যায়নের চেষ্টা করবেন। আমাদের এ পর্যালোচনার পেছনে মূল লক্ষ্য কারও হক যেন নষ্ট না হয়, আবার কোনো সিদ্ধান্তের কারণে দেশের একজন মানুষও যেন তার ন্যায্য অধিকারবঞ্চিত না হয়, তার জন্য ইসলামের সিদ্ধান্ত জানা।
পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘আমানত’ তার হকদারদের প্রত্যর্পণ করতে। তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকাজ পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ্ তোমাদের যে উপদেশ দেন, তা কত উৎকৃষ্ট! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা নিসা : ৫৮)।
আয়াতটি নাজিলের বিশেষ প্রেক্ষিত হলো, ‘ইসলামপূর্বকালেও কাবাঘরের সেবাকে এক বিশেষ মর্যাদার কাজ মনে করা হতো। খানায়ে কাবার বিশেষ কোনো খেদমতের জন্য যারা নির্বাচিত হতো, তারা গোটা সমাজ তথা জাতির মাঝে সম্মানিত ও বিশিষ্ট বলে পরিগণিত হতো। সেজন্যই বায়তুল্লাহর বিশেষ বিশেষ খেদমত বিভিন্ন লোকের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হতো। জাহিলিয়াত আমল থেকেই হজের মৌসুমে হাজীদের ‘জমজম’ কূপের পানি পান করানোর সেবা মহানবী (সা.) এর চাচা হজরত আব্বাস (রা.) এর ওপর ন্যস্ত ছিল। একে বলা হতো ‘সাকায়া’। এভাবে অন্য আরও কিছু সেবার দায়িত্ব হুজুর (সা.) এর চাচা আবু তালেবের ওপর এবং কাবাঘরের চাবি নিজের কাছে রাখা এবং নির্ধারিত সময়ে তা খুলে দেওয়া ও বন্ধ করার দায়িত্ব ছিল ওসমান ইবনে তালহার ওপর।’ (তফসির : মা’আরিফুল কোরআন : খ--২, পৃ-৪০৩, ইফা)।
মক্কা বিজয়ের পর পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহের একপর্যায়ে ‘কাবা শরিফ’ খুলে দেওয়া ও বন্ধ করার দায়িত্বটিকে ‘আমানত’ শব্দরূপে উল্লেখপূর্বক মহান আল্লাহ্ তা ফের সেই ওসমান ইবনে তালহাকেই ফেরতদানের নির্দেশ প্রদান করলেন। অর্থাৎ কাবাগৃহ প্রচলিত নিয়মমতো খুলে দেওয়া ও বন্ধ করার দায়িত্বটিকে ‘আমানত’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে মক্কা বিজয়ের পর ওসমান ইবনে তালহা যখন এ চাবি মহানবী (সা.) এর কাছে অর্পণ করেছিলেন, তখন তিনিও বলেছিলেন, ‘এ আমানত’ আমি আপনার হাতে অর্পণ করলাম।
আয়াতটির তফসির অংশে বলা হয়েছে, ‘এ নির্দেশের লক্ষ্য সাধারণ মানুষও হতে পারে কিংবা বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন শাসকবর্গও হতে পারে।’ (প্রাগুক্ত : পৃ-৪০৫)।
হজরত আনাস (রা.) বলেন, এমন খুব কমই হয়েছে যে, রাসুল (সা.) কোনো ভাষণ দিয়েছেন অথচ তাতে এ কথা বলেননি, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিয়মানুবর্তিতা নেই, তার ধর্ম নেই!’ (শোয়াবুল ঈমান)। একইভাবে সহি বোখারি ও সহি মুসলিমের হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আমানতে খিয়ানত করা মুনাফেকির অন্যতম নিদর্শন!’
আমানতের প্রকারভেদ : এখানে লক্ষণীয়, পবিত্র কোরআনে ‘আমানত’ বিষয়টিকে ‘বহুবচন’রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে (গবেষণার দলিল : ‘ইশারাতুন্-নস্’ হিসেবে), যে-কারও কাছে অপর কারও কোনো বস্তু বা সম্পদ গচ্ছিত রাখাটাই শুধু ‘আমানত’ নয়, যাকে সাধারণত আমানত বলে মনে করা হয়; বরং আমানতের আরও কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। ইতঃপূর্বে আয়াতটির শানেনুজুলে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে, তা-ও কোনো বস্তুগত মাল-সম্পদের ব্যাপার ছিল না। কারণ বায়তুল্লাহ্র চাবি বিশেষ কোনো সম্পদ নয়। তা বরং একটা দায়দায়িত্ব বা সেবা-খেদমতের একটা পদ মাত্র! (প্রাগুক্ত : পৃ-৪০৫)।
রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা আল্লাহ্ তায়ালার আমানত : এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রীয় যত পদ ও পদমর্যাদা রয়েছে, সেসবই আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে আমানতস্বরূপ। যাদের হাতে নিয়োগ ও বরখাস্তের অধিকার রয়েছে, সেসব কর্মকর্তা ও অফিসার হলেন সে পদের আমানতদার। কাজেই তাদের পক্ষে কোনো পদ এমন কাউকে অর্পণ করা জায়েজ নয়, যে লোক তার যোগ্য নয়; বরং প্রতিটি পদের জন্য নিজের ক্ষমতা ও সাধ্যানুযায়ী যোগ্য ব্যক্তি অনুসন্ধান করা কর্তব্য।
কোনো পদে অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগকর্তা অভিসম্পাতযোগ্য : যোগ্যতা ও পরিপূর্ণ শর্ত মোতাবেক কোনো লোক পাওয়া না গেলে উপস্থিত লোকদের মধ্যে যোগ্যতা ও আমানতদারি তথা সততার দিক দিয়ে যে সবচেয়ে অগ্রবর্তী হবে, তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এক হাদিসে বর্ণিত রয়েছে , রাসুলে করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যাকে সাধারণ মুসলমানদের কোনো দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, তারপর যদি সে কাউকে তার যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই একান্ত বন্ধুত্ব কিংবা সম্পর্কের কারণে কোনো পদে নিয়োগ প্রদান করে, তাহলে তার ওপর আল্লাহর লানত হবে এবং না তার ফরজ (ইবাদত) কবুল হবে, না নফল। এমনকি সে জাহান্নামে প্রবিষ্ট হবে।’ (জমউল-ফাওয়ায়েদ, পৃষ্ঠা : ৩২৫)।
কোনো কোনো রেওয়ায়েতে এসেছে, কোনো লোক যদি জেনেশুনে কোনো যোগ্য লোকের পরিবর্তে অযোগ্য লোককে কোনো পদে নিয়োগ দান করে, তাহলে সে আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং জনগণের গচ্ছিত আমানতের খেয়ানত করার মতো কাজ করল। স্বীকার করতেই হবে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যেসব অব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়, তার অধিকাংশের মূলে রয়েছে উল্লেখিত কোরআনি শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শনের ফসল। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আত্মীয়তা কিংবা স্বজনপ্রীতির জোরে সরকারি পদ ও পদমর্যাদা বণ্টন করা কোনো ক্রমেই ইসলামসম্মত হতে পারে না। কেননা এর ফলে প্রায় ক্ষেত্রেই অযোগ্য, অনভিজ্ঞ, অসমর্থ লোক বিভিন্ন পদ কব্জা করে বসে। তারা নিয়োগ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বা রাষ্ট্রীয় অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করে না বা করতে পারে না; বরং ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও জনগণের সেবার পরিবর্তে উল্টো মানুষের ওপর জুলুম শোষণ চালায়। এতে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রে অব্যবস্থা দেখা দেয়।
মহানবী (সা.) এক হাদিসে এরশাদ করেছেনÑ ‘যখন (পদ/চাকরি/জনসেবা/ উন্নয়ন/প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি) কাজের দায়িত্ব এমন লোকের হাতে অর্পণ করা হয়, যে লোক সে কাজের যোগ্য নয়, তখন তুমি কেয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ অর্থাৎ এর কোনো প্রতিকার নেই। (বোখারি : কিতাবুল ইলম)।
কোটা ও যোগ্যতা : যেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, দুজন প্রার্থী বা একাধিক প্রার্থী বিদ্যমান এবং সবারই যোগ্যতা সমান, সেক্ষেত্রে কোটা রক্ষা করে বিশেষ বিবেচনায় এক অঞ্চলের পরিবর্তে অন্য অঞ্চলের প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এটা আইন, ন্যায্যতা-ইনসাফ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হয় না। তবে যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। এছাড়া যেসব পদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি শারীরিক যোগ্যতাও অপিরহার্য, যেমন হাতে কাজ করতে হবে, কম্পোজ করতে হবে অথবা ফাইলপত্র নিয়ে এদিক-সেদিক যেতে হবে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই পদপ্রার্থীকে শারীরিকভাবে সুস্থ ও সক্ষম হওয়া আবশ্যক। সুতরাং এমনসব পদে অযোগ্য, কর্মে অক্ষম প্রার্থীকে অসহায় বা প্রতিবন্ধী বিবেচনায় নিয়োগ দান সমীচীন নয়। কারণ তাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয় কাজের তথা রাষ্ট্র ও জনগণের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।
অসহায়-প্রতিবন্ধিদের কী হবে? এ প্রশ্নও সম্পূর্ণ বাস্তব ও যৌক্তিক। এর সুরাহাও অবশ্যই হতে হবে। আর এটাও রাষ্ট্র ও সরকারের আবশ্যিক দায়িত্বের অন্যতম। তবে তা এভাবে নয় যে, রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনীয় কাজের ক্ষতি করে অসহায়-প্রতিবন্ধীদের সাহায্য বা আনুকূল্য দিতে হবে। তা হতে পারে অন্যভাবে, যেমনÑ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বা তেমন কোনো মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে সংশ্লিষ্ট অসহায়, প্রতিবন্ধীদের দ্বারা আদায়যোগ্য কোনো কর্মের বিনিময়ে হোক বা কর্ম আদায় চিন্তা ব্যতিরেকেই, তাদের লালনপালন, ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তাদের এককালীন বা মাসিক, নিয়মিত বা অনিয়মিত, যেভাবে-যতটুকু সম্ভব দান-অনুদান, সাহায্য-সহযোগিতা করা যেতে পারে। এভাবে দ্বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের কাজের ক্ষতি থেকেও বাঁচা যাবে। আবার অসহায়-প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজনীয় সাহায্যও হয়ে যাবে এবং কোরআন-সুন্নাহ্র নির্দেশনা মোতাবেক আমলও হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ্ ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, সার্বিক বিবেচনা সামনে রেখে ‘কোটা পদ্ধতি’ প্রশ্নে আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের তওফিক দান করুন! আমিন!
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ