ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে মোবাইল ডেটা বা ওয়াই-ফাই অন করলেই গোটা জগৎটা আমাদের মাথার ভেতরে ঢুকে পড়ে। মাথাটাই এখন বিশ্ব। ফেসবুক নিয়ে ভালো-মন্দ যত কথাই হোক, আর সেটাকে ‘অলীক’ জগৎ বলে যতই এর অস্তিত্বকে তাচ্ছিল্য করা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো এই যে পৃথিবীর মানুষদের একটা বড় সংখ্যা এখন ফেসবুকে প্রতিদিন দিনের একটা বড় অংশ কাটায়। সেখানে বন্ধুত্ব, ভাব, ভালোবাসা, সম্পর্ক, বিবাহ, বিচ্ছেদ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ থেকে শুরু করে ভালো-মন্দ, বিপদ-আশীর্বাদ—সবই আছে। ফেসবুক নিয়ে তাই নিন্দা, দ্বিধা যা-ই থাকুক না কেন, মানতে হবে যে এটা আমাদের বাস্তবতার বাইরের কিছু এখন আর নয়। আমরা যদিও নিন্দায় ভাসি যে ফেসবুক একটা ‘লোক দ্যাখানোর’ কেবল ঝলমলে রঙিন ছবির মিথ্যা মেকি জগৎ, কিন্তু এই জগতের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধগুলো কিন্তু মেকি নয়। যে জগতেই মানুষের পা পড়ে, সেখানেই অপরাধ ঘটবে। এত দিন আমরা রক্তমাংসের জগতের একধরনের বিপদ দেখেছি। সেখানে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে, সম্পর্ক হয়েছে, বিপদ-আপদ হয়েছে। সেসব বিপদের রূপ আমাদের অনেক দিনের পরিচিত।
কিন্তু ফেসবুকের এই নতুন জগতের বিপদগুলো সম্পর্কে আমরা ইদানীং জানতে পারছি। ধীরে ধীরে একের পর এক খুন, ধর্ষণ, প্রতারণার মতো ঘটনার খবর আমাদের কানে আসছে, যার অনেকগুলোরই শুরু এই ফেসবুকের পটভূমি থেকে। এই জগৎকে যদি আমরা আমাদের বাস্তবতার অংশ হয়েছে স্বীকৃতি দিয়ে থাকি, তবে প্রশ্ন হলো, এখানে টিকে থাকার জন্যও কি যথার্থ প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে? আমরা কি এই জগতের বিপদগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন? এখানেও টিকে থাকার সূত্র আসলেই সেই একটাই—সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমে নিরাপদে বসবাস করে এর আনন্দ নিতে হলে আমাদের এই জগতের শক্তি, দুর্বলতা ও ফাঁদগুলোর চরিত্র সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। তাহলেই ধীরে ধীরে ‘ফেসবুক ফিটনেস’ তৈরি হবে এবং এই মাধ্যমের নেতিবাচক দিকগুলো থেকে আমরা আমাদের বাঁচিয়ে চলতে পারব।
সর্বশেষ ঘটনাটির সূত্র ধরেই শুরু করি। মাত্র কদিন আগে ফেসবুকে পরিচয়ের পর বন্ধু বা প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ঘরে ফেরেনি চট্টগ্রামের একটি কিশোরী মেয়ে। এক দিন বাদে তার লাশ পাওয়া যায়। দায়ী সেই প্রেমিক যুবক কি না, নাকি অন্য কেউ? সেই প্রমাণ মিললেও কি মেয়েটিকে আর পাওয়া যাবে? এই ক্ষতির দায় কি ফেসবুকের, নাকি আমাদের অসাবধানতার? মাথাব্যথার দায় কি মাথার?
সাবধানতার প্রথম পাঠ হিসেবে আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার যে ফেসবুক কোনো রূপকথার জগৎ নয়। টেলিভিশন সিরিজ নয়। চরিত্রগুলো প্রকৃত মানুষ, যারা সত্যিকারের জগতে অপরাধ ঘটাতে সক্ষম। সিনেমার ভিলেন যত খারাপ মানুষই হোক, সে টেলিভিশন থেকে বের হয়ে এসে আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু ফেসবুকের অনেক চরিত্র থাকতে পারে, যারা আপাতদৃষ্টিতে নায়কসুলভ হলেও সেই প্রক্ষেপিত নায়ক চরিত্রের অন্তরালে তাদের স্বরূপ আসলে হতে পারে কোনো হঠকারী মানুষের। আমি যদি তার নায়ক রূপে আকৃষ্ট হয়ে একটা মাত্রার বাইরে তার দিকে এগিয়ে যাই, তাহলে তার খলনায়ক রূপটি আমার বোকামি, দুর্বলতা, অসাবধানতা, অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আমার ভয়াবহ কোনো ক্ষতি করে দিতে পারে, যা কিনা অপূরণীয়। খেয়াল রাখা দরকার যে ফেসবুকে আমরা তা-ই দেখি, যা আমরা দেখাতে চাই। আমরা এখানে যেমন আমাদের মুখচ্ছবির সবচেয়ে নিখুঁত রূপায়ণে মনোযোগী, তেমনি আমাদের চরিত্রের ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচারে অতি আগ্রহী ও পারদর্শী। এই মানসিকতা তবু সরল বলে ভাবা যায়, যদি সেখানে মিথ্যাচার প্রবেশ না করে।
কিন্তু স্মরণ রাখা দরকার, যার বা যাদের মন অপরাধপ্রবণ, মিথ্যাপ্রবণ, তেমন অনেক মানুষও ফেসবুকে আমাদের আশপাশেই আছে। তারা যদি নিজের চরিত্রের কোনো অসত্য চিত্রায়ণ করতে চায়, তো ফেসবুকে তার পূর্ণ সুযোগ রয়েছে। এই জগতে তাই আমরা যখন মন দেওয়া-নেওয়ার খেলায় জড়িয়ে যাই, কারোর প্রতি আকৃষ্ট হই, তখন বারবার মনে রাখা প্রয়োজন যে যে চরিত্রে আমি আকৃষ্ট, সে যদি খাঁটিও হয়ে থাকে, তবু প্রথমত ফেসবুকে তার ‘আংশিক’ প্রকাশ ঘটেছে, যা সব সময়ই আমার আপন নিরাপত্তার খাতিরেই আগাপাছতলা যাচাই-বাছাইয়ের দাবি রাখে। অর্থাৎ ফেসবুকে যা দেখছি, সেটা একটা মানুষের পরীক্ষিত প্রকৃত পূর্ণাঙ্গ রূপ না-ও হতে পারে। নিজেকে নিরাপদ সীমানায় রেখে রক্তমাংসের বাস্তব জগতের পর্যবেক্ষণ ছাড়া শুধু ফেসবুকের পরিচয় আর বন্ধুত্বের ভিত্তিকে চিরন্তন ভরসার ধরে নিয়ে সম্পর্কের আরও গভীরে মানসিকভাবে প্রবেশ করাও তাই নিরেট নির্বুদ্ধিতা।
দ্বিতীয়ত, ফেসবুকের সূত্রপাত থেকে সংঘটিত অপরাধগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে সম্পর্ককেন্দ্রিক, তাই এই জায়গাটাকে ঘিরেই সর্বাধিক এবং সর্বোচ্চ মাত্রার সাবধানতার প্রয়োজন থাকলেও সব ধরনের আদান-প্রদানের এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ফেসবুককে শুধু একটা পরিচয়ের উৎসস্থল হয়েছে দেখাটাই উত্তম। লেনদেন, আলাপ-আলোচনা সবই যত বেশি ভার্চ্যুয়াল জগৎ থেকে আস্তে আস্তে বাস্তব জগতে নিয়ে আসা যায়, ততই আমাদের নিজস্ব বিচারক্ষমতার প্রয়োগের এবং পর্যবেক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি পায় আর বিপদের আশঙ্কা সংকুচিত হয়।
সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ফেসবুকের পরিচয়ের সূত্র ধরে কোনো অপরিচিত মানুষের (তার সঙ্গে আমরা যত দিনই কথাবার্তা বলে থাকি না কেন) সঙ্গে কোনো অরক্ষিত জায়গায় একলা চলে যাওয়াটা একটা অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। এই সব ক্ষেত্রে বড় কোনো বন্ধুদলের মধ্যে ধীরে ধীরে সেই মানুষটার সঙ্গে আরও সময় নিয়ে মেশা, তার পরিবারকে জানা, তার সমাজকে জানা, এভাবে ধাপে ধাপে এগোনোটাই সঠিক ও নিরাপদ পথ। মোদ্দাকথা, ফেসবুক থেকে সরাসরি বাস্তবের জগতে প্রবেশের আগে কিছুতেই মনের ভেতরেও সেই অচেনা বা অল্প চেনা মানুষটিকে নিয়ে বেশি দূর এগোনো ঠিক নয়। কেননা, তখনো জানার প্রক্রিয়াটি পর্যাপ্ত রূপ নেয়নি। দ্বিতীয়ত, এই সময়টাতেও একলা জড়িত না হয়ে ধাপে ধাপে বড় কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে ধীরে ধীরে মানুষটিকে আরও কাছে থেকে জানতে চাওয়াটাই বেশি নিরাপদ, যৌক্তিক এবং উভয়ের জন্যই সম্মানজনক। সম্পর্কের মতো জীবনের এত জটিল একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সময় নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
একটা যুগে ভাবা হতো ছেলেমেয়েরা বিপদগ্রস্ত হবে ঘরের বাইরে গিয়ে। এখন বাইরের গোটা জগৎটাই ঘরের ভেতরে ঢুকে গেছে ইন্টারনেটের ফাঁক গলে। এই নতুন যুগের নতুন সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রায় সাবধানতার প্রয়োজন আছে। প্রতিটি পরিবারের ছেলেমেয়েদের সেই বিষয়ে বাড়তি সচেতনতা এখন অত্যন্ত জরুরি। ছেলেবেলায় আমাদের বাবা-মায়েরা বলতেন, বাইরে গেলে অপরিচিত কারোর হাত থেকে প্রলোভিত হয়ে কিছু না খেতে, কোথাও না যেতে। কেননা, জগতে দুষ্ট লোকের, ‘ছেলেধরাদের’ অভাব নেই।
আজকের যুগের ফেসবুকের ‘ছেলেধরা’ দুষ্ট লোকেদের চোখে দেখা যায় না, আর সেই জগতেও প্রলোভনের প্রতারণার অভাব নেই। মানুষ যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ সেখানে অত্যন্ত সীমিত। তাই পরিমিত মেলামেশার এখানে কোনো বিকল্প নেই। অসাবধানী মানুষ এখানে বিপদে পড়বেই যদি সে কোনো অসাধু লোকের খপ্পরে পড়ে। তাই সাবধানতার মাত্রা বাড়ানো ছাড়া এর আর কোনো প্রতিকার নেই। আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত নিরাপদ-আনন্দময় এই জগৎটিতে যে পদে পদে বিপদ ছড়ানো আছে, এই কথাটাই আমাদের ছেলেমেয়েদের বারবার করে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। হয়তো তাতে বাবা-মায়েরা খানিকটা অপ্রিয় হবেন, তবু।
বাবা-মায়েরা সারাক্ষণই ছেলেমেয়েদের এটা-সেটা নিষেধ করে থাকেন। ‘এটা কোরো না, ওটা খেয়ো না, এখানে যেয়ো না, এর সঙ্গে মিশো না’! এই বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ির জন্যই বাবা-মায়েদের অনেক বদনাম সন্তানকুলে। যেন বাধা দেওয়াটাই তাঁদের প্রধান কাজ। কিন্তু চট্টগ্রামের কিশোরী তাসফিয়ার ঘটনাটির পর সন্তানদের কাছে খোলামেলা অনুরোধই করতে চাই একেবারেই মিনতির সুরে। বাবারা দয়া করো একটু! সন্তানের কোনো রকম ক্ষতি পিতা-মাতার পক্ষে অসহনীয়। সেই আশঙ্কার জায়গা থেকে অন্তত ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে যে কথাগুলো বাবা-মায়েরা বারবার বলেন, সেগুলোকে আমলে নেওয়াটা অত্যন্ত দরকার। পরিবারের ভেতরের বলয়ে যদি আমরা সচেতনতার শক্ত ভিত তৈরি করতে পারি সমাজের সব স্তরে, তাহলেই শুধু অপরাধী চেতনা ধীরে ধীরে কোণঠাসা হবে, সেটা ফেসবুকে হোক আর যেখানেই হোক!
লেখক: ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী ও মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী