এখন ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ ঘুরতে যায়
পাঁচ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ২৫ থেকে ৩০ লাখ।
২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, দেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন ১৫ লাখ মানুষ।
তরুণদের হাত ধরে শুরু হয়েছে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম। দল বেঁধে দুর্গম পাহাড়ে ঘোরা, সমুদ্রে ডুব লাগানো—এসব এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে।
অনেকের কাছে দেশের ভেতরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া মানে কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকত দেখা, সুন্দরবন অথবা সিলেটের চা-বাগান ভ্রমণ। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা শুধু এতটুকু ভ্রমণে এখন আর সন্তুষ্ট নন। তাঁরা এখন দুর্গম পাহাড়ের বুনো সৌন্দর্য অথবা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে সার্ফিংয়ের রোমাঞ্চ পেতে চান। চান সমুদ্রের তলদেশের বিস্ময়কর জগৎ দেখতে, সাঁতরে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিতে কিংবা সিলেটের সবুজ চা-বাগানের উঁচু-নিচু টিলায় সাইকেল চালাতে।
সুখবর হলো, এ ধরনের রোমাঞ্চে ঠাসা পর্যটনের অভিজ্ঞতা এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। ইংরেজিতে এ ধারার পর্যটনকে বলা হয় অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম। এমন পর্যটনের স্বাদ নিতে বান্দরবান, খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ে এখন দল বেঁধে ভ্রমণে যাচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কক্সবাজারে তৈরি হয়েছে ঢেউয়ের সঙ্গে সার্ফিং করার সুযোগ। সিলেটের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো চা-বাগান মালনিছড়ার উঁচু-নিচু টিলায় সাইকেল চালানোর সুযোগ এখন পাওয়া যাচ্ছে।
ভ্রমণপিপাসু কিছু তরুণের হাত ধরে অ্যাডভেঞ্চার পর্যটনের যাত্রা শুরু হলেও এখন সরকারিভাবেই এ ধরনের পর্যটন প্রসারে কাজ হচ্ছে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে এ খাতে এখন কাজ করছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড। পর্যটনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে গড়ে উঠবে। বাংলাদেশে চালু হওয়া বিভিন্ন ধরনের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিচে তুলে ধরা হলো:
ট্রেকিং
উঁচু-নিচু দুর্গম পাহাড়ে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোকে বলা হয় ট্রেকিং। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৩ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতার পাহাড় রয়েছে ১২টি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বান্দরবানের সাকা হাফং, মোদক মুয়াল, কেওক্রাডং প্রভৃতি। এসব পাহাড়ের কয়েকটিকে ঘিরে এখন দল বেঁধে ট্রেকিংয়ের আয়োজন করা হয়। এসব দলের আকার হয় সাধারণত ৫ থেকে ১০ জন। এসব দলকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করার জন্য একজন পাহাড়ি গাইড বা পথপ্রদর্শক থাকেন। পাহাড়ে রাতে থাকার ব্যবস্থা বা ক্যাম্প করা, খাবার ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো আয়োজক গ্রুপের মাধ্যমে করা হয়। দিনের বেলা বুনো পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি পাহাড়ে রাতের আকাশের তারা দেখার মতো রোমাঞ্চ উপভোগ করা যায় এমন ভ্রমণে।
জিপলাইনিং ও রাফটিং
জিপলাইনিং হলো উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে তার বা দড়ি বেয়ে ভূমিতে দ্রুতগতিতে নেমে আসা। আর পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জোরালো ঢেউয়ের ঝরনা বা নদী দিয়ে নৌকায় করে বয়ে চলাকে বলা হয় রাফটিং। বান্দরবানের মুনলাইপাড়া নামক স্থানে পর্যটন করপোরেশনের সহযোগিতায় এখন জিপলাইনিংয়ের সুযোগ রয়েছে। আর রাফটিংয়ের উত্তেজনা পেতে হলে যেতে হবে বান্দরবানের নাফাখুমে।
সার্ফিং ও প্যারাগ্লাইডিং
উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে ভেসে চলাই হলো সার্ফিং। প্যারাসুটের মাধ্যমে ওপরে ভেসে থাকাকে বলা হয় প্যারাগ্লাইডিং। কক্সবাজারে লাবণী সমুদ্রসৈকত পয়েন্টে সার্ফিং করার জন্য এখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সার্ফিংকে খেলা হিসেবে প্রসারের জন্য বাংলাদেশ সার্ফিং ফেডারেশন নামের একটি সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশে সার্ফিংকে উৎসাহিত করতে বিশ্বখ্যাত সার্ফার টম বাওয়ার পর্যটন করপোরেশনের আমন্ত্রণে ইতিমধ্যে কয়েকবার কক্সবাজারে ঘুরে গেছেন। আর কক্সবাজারের হিমছড়ি ও দরিয়ানগর সমুদ্রসৈকত পয়েন্টে প্যারাগ্লাইডিংয়ের সুবিধা রয়েছে। আকাশে ভেসে বেড়ানোর এই ক্রীড়াশৈলীর মাধ্যমে ১২ থেকে ১৫ মিনিট উড়তে উড়তে বঙ্গোপসাগর দেখা যায়।
নদীভিত্তিক পর্যটন
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা বা ছোট আকারের জাহাজে করে ঘুরে বেড়ানোও এখন বেশ জনপ্রিয়। রাজধানীর উপকণ্ঠে পূর্বাচলে শিমুলিয়া ঘাট থেকে বালু নদ আর শীতলক্ষ্যা ধরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঘোড়াশালে সারা দিন ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা ঢাকা ডাইনার ক্রুজ জাহাজে ঘুরে বেড়ানোর এ ব্যবস্থা চালু করে সম্প্রতি। এসব ভ্রমণে বড় নৌকার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ছোটখাটো জাহাজও। বেসরকারি উদ্যোগে সারা দেশের বিভিন্ন নদী ও হাওর ভ্রমণের এমন অনেক উদ্যোগ এখন নেওয়া হচ্ছে।
বাংলা চ্যানেল পাড়ি
কক্সবাজারে শাহ পরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পথটি বাংলা চ্যানেল নামে পরিচিত। বাংলা চ্যানেলের আবিষ্কারক প্রয়াত আলোকচিত্রী কাজী হামিদুল হক। পর্যটন করপোরেশন ও বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এখন বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার আয়োজন করা হয়। এমন সাঁতারের আয়োজনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ও প্রশাসনিক অনুমতি পাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী পর্যটকদের সহায়তা করে পর্যটন করপোরেশন।
স্কুবাডাইভিং
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সমুদ্রের তলদেশ দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে স্কুবাডাইভিংয়ের মাধ্যমে। সেন্ট মার্টিনের স্বচ্ছ সমুদ্রের নিচে দেখা মিলবে বিচিত্র কোরাল ও নানা বর্ণের জলজ উদ্ভিদের। ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যটকদের জন্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপে স্কুবাডাইভিংয়ের আয়োজন করে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটকেরা সব সময় বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য আর অ্যাডভেঞ্চার খোঁজেন। আমাদের দেশে যেমন বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য আছে, তেমনি অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। পাহাড়, পর্বত ও বন সবই আছে। বেসরকারি উদ্যোগে এখন বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারের আয়োজন হচ্ছে, আমরা তাদের সহায়তা করছি।’ তিনি মনে করেন, সঠিকভাবে প্রচার চালানো হলে রোমাঞ্চের খোঁজে বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশে আসবেন। ফলে সামগ্রিকভাবে পর্যটন খাতে আয় বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রাও বেশি আয় হবে।
পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, বছরে এখন ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যায়। বছর পাঁচেক আগেও এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ছিল। আর ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন ১৫ লাখ মানুষ। আর পরোক্ষভাবে আরও ২৩ লাখ লোক এ খাতের সঙ্গে যুক্ত আছেন। সব মিলিয়ে এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। আর্থিক মূল্যে দেশীয় পর্যটন খাতের আকার দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার।
Source:
http://www.prothomalo.com/economy/article/1496991/%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%95%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%9B%E0%A7%87