বেইজিং থেকে খানিকটা দূরের একটি স্থান হুট করেই গবেষকদের নজর কাড়ল। ঘটনাটি ছিল ১৯৫৮ সালের। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের ৫০ কিলোমিটার দূরের স্থানটিকে প্রত্নতাত্তি্বকভাবে যথেষ্ট সম্ভাবনাপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন গবেষকরা। বেইজিং থেকে উত্তর দিকে বিখ্যাত চীনের প্রাচীরে যাওয়ার পথে এই পাহাড়ি স্থানটি পড়ে। সেখানে ছিল অনেক ঢিবি। এতদিন সেখানে কোনো খননকাজ চালানো হয়নি। মানুষের কুসংস্কার ছিল ওই ঢিবিগুলোর সঙ্গে কোনো ভৌতিক ঘটনা জড়িত আছে। এগুলো খুঁড়লে তাদের ওপর কোনো অকল্যাণ নেমে আসবে। কিন্তু এক সময় গবেষকদের চেষ্টায় সেখানে খননকাজ শুরু হলে এক রহস্যময় অধ্যায় উন্মোচিত হলো। আবিষ্কৃত হলো মিং রাজাদের সমাধিক্ষেত্র। প্রাচীন মিসরের মতো চীনেও রাজাদের বাসস্থান থেকে সমাধিক্ষেত্র থাকত লোকচক্ষুর আড়ালে। ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল ওই বিশাল সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ কাজ। যেখানে শায়িত ছিল ১৩ জন মিং সম্রাট। ১৩৬৮ সালে মোঙ্গলদের হাত থেকে মিংরা দেশের অধিকার কেড়ে নেয়। চীনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য স্থানজুড়ে রয়েছে মিং সাম্রাজ্য।
মিং রাজবংশের সমাধি বেইজিং শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ইয়ানশান পর্বতমালার অংশ বিশেষ অঞ্চলে নির্মিত। সমাধির পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে পাহাড় এবং এর মধ্য দিয়ে চলে গেছে একটি আঁকাবাঁকা পথ। এ পথটি বেইজিংয়ে এসে পেঁৗছেছে। শাং লিং সমাধি হচ্ছে ১৩টি সমাধির মধ্যে প্রধান। অন্য ১২টি সমাধি ছাংলিংয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে অবস্থিত।
চীনা গবেষক লি মেই উল্লেখ করেছেন, ছাংলিং সমাধিতে সমাহিত রয়েছেন চু তি। তিনি ছিলেন মিং রাজবংশের সমাধি নির্মাণকারী প্রথম রাজা। রাজা চু তি ছিলেন একজন প্রতিভাবান ও দূরদর্শী মানুষ। তিনিই বেইজিংকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এর পেছনে কারণ ছিল এর ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য। আগ্রাসকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা। এর পাশাপাশি তিনি বেইজিং শহর, নিষিদ্ধ নগর (ফরবিডেন সিটি) এবং মহাপ্রাচীরও নির্মাণ করেছেন। চু তি'র নির্মাণ করা ছাংলিং হচ্ছে মিং রাজবংশের প্রথম সমাধিক্ষেত্র। পাহাড়ের অভ্যন্তরে সমাধি এবং উপরিভাগের স্থাপত্যকলা একে পূর্ণাঙ্গ সমাধিতে পরিণত করেছে।
ছাংলিং সমাধির স্থাপত্য নিষিদ্ধ নগরের গঠন কাঠামোর আদলে তৈরি লাল দেয়াল ও হলুদ টালি ও অসমতল প্রাসাদে সম্রাট চু তি'র অপূর্ব মর্যাদা ফুটে উঠেছে। সমাধিক্ষেত্রের প্রধান স্থাপত্য হচ্ছে লিং এর প্রাসাদ। প্রতি বছর রাজকীয় ব্যক্তিবর্গ এ স্থানে এসে পূর্ব-পুরুষদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। প্রাসাদ নির্মাণের উপকরণ হচ্ছে নানমু। প্রাসাদটিতে ৬০টি ১২ মিটার উঁচু ও এক মিটার ব্যাস সম্পন্ন নানমু রয়েছে। নানমু হচ্ছে এক ধরনের মূল্যবান কাঠের খুঁটি। তা খুব শক্ত ও সহজে নষ্ট হয় না। এ কাঠে এক ধরনের বিশেষ সুগন্ধিও রয়েছে। গাইড লি মেই জানান, প্রাচীনকালের পরিবহনের কাজ খুব সহজ ছিল না। সুতরাং এসব নানমুগুলো কেটে ডিজাইন করে নিয়ে আসা ছিল অনেক কঠিন কাজ। এর বর্ণণা দিতে গিয়ে মেই বলেছেন-
'এসব কাঠ দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশের বন থেকে সংগ্রহ করা হয়। কারণ কাঠগুলো খুব বড়, প্রথমে মানুষ গাছ কেটে বনে রেখে দিতো। গ্রীষ্মকালে যখন বন্যা হতো তখন বন্যার পানিতে ভাসিয়ে বন থেকে নদীপথে গন্তব্য স্থলে নিয়ে যাওয়া হতো এসব নানমু। নদীপথে নিয়ে যাওয়ার সময় কাঠগুলোকে বেঁধে ভেলার মতো করে নিয়ে আসত বেইজিংয়ে। পরে শীতকালে যখন বরফ পড়তো তখন হাজার হাজার শ্রমিক সমতল বরফের ওপর দিয়ে টেনে ধীরে ধীরে কাঠগুলো বেইজিংয়ের সমাধিস্থলে নিয়ে যেত। সুতরাং এসব কাঠ টেনে নিয়ে যেতে প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর লাগত এবং এতে ২০ হাজার লোককে দিন-রাত কাজ করতে হতো।'
লিং প্রসাদের পর চার-দিক ঘিরে আর একটি ঐতিহ্যিক স্থাপত্য বিশিষ্ট একটি উঁচু মিং স্থাপত্য রয়েছে। তা হচ্ছে মিং রাজবংশের রাজ প্রাসাদের প্রতিনিধিত্বমূলক স্থাপত্য। ভেতরে রয়েছে একজন রাজার সমাধি। পাথরে উৎসর্গের কথা উৎকীর্ণ।