Famous > History

কীভাবে শুরু হলো অটোগ্রাফ নেয়ার সংস্কৃতি?

(1/1)

710001113:
By Prakash Nath

অটোগ্রাফ সংগ্রহ করা অনেকের কাছে এক মজার শখ। হয়তো কোনো এক উপলক্ষে কোনো এক বিখ্যাত ব্যক্তির সই নেয়া থেকে যে শখের শুরু, তা কখন যে তীব্র নেশায় পরিণত হয়, ব্যক্তি নিজেও জানেন না! অনেকের জীবনে বইমেলায় স্বাক্ষর সংগ্রহের নানা মজার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখনো এমন অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন, যারা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব দেখলেই কাগজ-কলমের খোঁজ করেন। অটোগ্রাফ শিকারের নেশা এমনই। নিমেষে তারা ফিরে যান তারা ছোটবেলার দিনগুলোয়।

কীভাবে অটোগ্রাফ নেওয়ার চল শুরু হলো এই পৃথিবীতে, আর অটোগ্রাফ দেখে কীভাবে চেনা যায় সেই ব্যক্তিকে, তারই আদ্যোপান্ত  জানাবো আজ আপনাদের।
অটোগ্রাফ কী?

‘অটোগ্রাফ’ কথাটির অর্থ ‘নিজের লেখা’। গ্রিক ভাষায় ‘অটোগ্রাফোস’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। সেই অর্থে যেকোনো মানুষের নিজের হাতে কিছু লেখা মানেই তার অটোগ্রাফ। কিন্তু আমরা সাধারণত শব্দটিকে ব্যবহার করি ‘বিখ্যাত ব্যক্তিদের সই’ বোঝাবার জন্য।
কবে থেকে শুরু অটোগ্রাফ নেয়ার প্রচলন?

বলা হয়ে থাকে, ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জার্মানিতে অটোগ্রাফ নেয়ার প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে বিখ্যাত ব্যক্তিদের বা বিশেষ করে নিজের বন্ধুবান্ধবদের সই সংগ্রহ করার একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। সেই থেকেই অটোগ্রাফ নেয়ার উৎসাহটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানিতে সেই সময় এই সই সংগ্রহের ব্যাপারটা এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, অচিরেই বেরিয়ে যায় একধরনের ছোট, লম্বাটে অ্যালবাম, যা পকেটে রাখা সহজ। এই খাতাগুলোর নাম ছিল ‘অ্যালবা অ্যামিকোরাম’। ব্রিটিশ জাদুঘরে এই অ্যালবামের একটি বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। সেখানে রয়েছে কবি জন মিল্টনের মতো বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের সই।
ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত অ্যালবা অ্যামিকোরাম খাতার নমুনা; Image Source: sarahemilybond.com
বিখ্যাত ব্যক্তিদের বৈচিত্র্যময় অটোগ্রাফ

বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে অটোগ্রাফ দেয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা বৈচিত্র্যময়তা। কেউ শুধু সই দিয়েই ক্ষান্ত হন, আবার কেউ সইয়ের সাথে লিখে দেন নানা উদ্দীপনামূলক বাণী। এই ভারতীয় উপমহাদেশে সইয়ের সাথে কিছু একটা লিখে দেয়ার রীতি ব্যাপকভাবে চালু করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সই দেয়ার সাথে তৎক্ষণাৎ কিছু লেখার এক অসামান্য ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথের ছিল।
ভক্তকে দেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সই সহ কবিতা; Image Source: SAHITYA JAGAT - WordPress.com

অনেকে আবার লেখার বদলে প্রীতি বা শুভেচ্ছা জানান কিংবা শুধুই নাম সই করে দেন। তবে কেউ কেউ সইয়ের সাথে কিছু একটা লিখে দেন, যার ফলে অটোগ্রাফ অন্য একটা মাত্রা পেয়ে যায়। অনেক সময় অটোগ্রাফের সাথে এমন কিছু লেখা পাওয়া যায়, যা শুধুই উপরি পাওনা হিসেবে থাকে না, তার মধ্যে রীতিমতো ভাবনার খোরাকও পাওয়া যায়। সময়ের সাথে সাথে সে উক্তিটি ইতিহাসে পেয়ে যায় অমরত্ব। বিশ্ব বিখ্যাতদের এসব বিরল সই সারা পৃথিবীর এক বিরল সম্পদ। আর এসব অটোগ্রাফ ব্যক্তিগত সংগ্রহের চেয়ে কোনো জাদুঘরে দেখতে পাওয়া সম্ভাবনায় সবচেয়ে বেশি।
কেন মানুষ অন্যের সই সংগ্রহ করে?

মানুষ অন্যের সই সংগ্রহ করতে কেন চায়, মনস্তাত্ত্বিকরা বিভিন্ন আঙ্গিকে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের কিছুক্ষণের সান্নিধ্য লাভের উৎসাহ, তাদের হাতের লেখা নিজের সংগ্রহে রাখার গৌরব। এসব কারণই স্বাক্ষর সংগ্রহকে একটি দারুণ জনপ্রিয় শখে পরিণত করেছে।
১৮৮৮ সালের এক অটোগ্রাফ খাতা; Image Source: wikimedia commons

অবসর সময়ে খাতার পাতা উল্টে সেই যুগের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিজের হাতের লেখা দেখতে পাওয়ার শিহরণ এবং এগুলো সংগ্রহ করতে পারার দরুন একটা তৃপ্তি নিশ্চয়ই মানুষকে খুবই আনন্দ দেয়। অন্যান্য অনেক শখেরই মতো, এটিও কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যের প্রভাবে গড়ে ওঠে। বন্ধুর আছে, তাই আমিও একটা অটোগ্রাফের খাতা করবো, এভাবেই হয়তো একটি বিশাল সংকলনের শুরু হয়।
পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত সব অটোগ্রাফ শিকারী

অটোগ্রাফ সংগ্রহের জন্য পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত মানুষের অভাব নেই। কি বিশাল আর বৈচিত্র্যময় তাদের সংগ্রহ, তা না দেখলে কল্পনাই করা যায় না। স্বাক্ষর শিকারী হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন ইংল্যান্ডের অ্যালফ্রেড মরিসন। তার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, মরিসনের বাড়িতে শুধু অটোগ্রাফই থাকতো, তার নিজের জন্য ছিল সামান্য একটু জায়গা। তার এত অটোগ্রাফ অ্যালবাম ছিল যে, সেগুলোর আলাদা ক্যাটালগ ছিল। সেই বিশাল ক্যাটালগ থেকে বেশ কয়েকটি অ্যালবাম বেছে নিয়ে নির্বাচিত অটোগ্রাফের কিছু প্রতিলিপি সংস্করণ মরিসন নিজেই প্রকাশ করেন।
অটোগ্রাফের প্রতিলিপি

অটোগ্রাফের ‘ফ্যাকসিমিলি’ বা ‘প্রতিলিপি’ অর্থাৎ, সইটিকে হুবহু কাগজে ছেপে বের করা। এ ধরনের সংকলন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচুর বেরিয়েছে। ইংল্যান্ডের দুই ভদ্রলোক জে. নেদারক্লিফট এবং এফ. জি নেদারক্লিফট এই কাজে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন। এই দুজন ব্যক্তি সম্পর্কে পিতা-পুত্র। ১৮৩৫-৬৫ সাল, এই দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তারা কখনো একক, আবার কখনো যুগ্মভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাঁচটি বিশাল অ্যালবাম প্রকাশ করেন। এগুলোতে সেই সময় ও অতীতের তাবৎ বিখ্যাত মানুষের, এমনকি প্রাচীনকালের বহু রাজা-রানীরও সই পর্যন্ত বাদ ছিল না।
অটোগ্রাফের নিলাম

অটোগ্রাফের নিলামও বিদেশের বহু জায়গায় হইচই ফেলে দেয়। এই নিলামে বিক্রি হওয়া অটোগ্রাফ প্রধানত চার রকমের হতে পারে।

C.S. (Cut Signature), D.S. (Document Signed), L.S. (Letter Signed) ও A.L.S (Autograph Letter Signed)।

C.S. (Cut Signature): এই ধরনের অটোগ্রাফ সাধারণত কোনো চিঠি বা খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া সই।
Cut Signature-এর উদাহরণ; Image Source: The Auction at Graceland

D.S. (Document Signed): মোটামুটি অক্ষত কোনো দলিলে বিখ্যাত ব্যক্তির অটোগ্রাফ এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
কোনো দলিলে বিখ্যাত ব্যক্তির অটোগ্রাফ Document Signed নামে পরিচিত ; Image Source: MacLitigator

L.S. (Letter Signed): এ ধরনের অটোগ্রাফ কোনো টাইপ করা চিঠির তলায় সই।
 টাইপ করা চিঠির নচ সই; Image Source: Heritage Auctions 

A.L.S (Autograph Letter Signed): নিজের হাতের লেখা ও সই করা চিঠি।
Letter Signed বলতে হাতে লেখা কোনো চিঠির নীচে কোন বিখ্যাত জনের অটোগ্রাফ; Image Source: Heritage Auctions 

এই হাতে লেখা চিঠির দামই সাধারণত সবচেয়ে বেশি ওঠে। এছাড়াও নিলামে অটোগ্রাফের মূল্য নির্ভর করে আরো বেশ কিছু বিষয়ের ওপর। যেমন, কার অটোগ্রাফ, জনসাধারণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কেমন, নিলামে ওঠা অটোগ্রাফের পেছনের বড় কোনো খবর বা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কি না, এসবের ওপর।

১৯৭০ সালে একটি এরকম নিলামে রিচার্ড নিক্সনের হাতে লেখা একটি গোটা চিঠি বিক্রি হয়েছিল ৬,২৫০ ডলারে আর কেনেডির একটি বক্তৃতার আগে হিজিবিজি করে লিখে নেওয়া ছোট্ট নোটের দাম উঠেছিল ৮,০০০ ডলার। এখানে দুই প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার নিরিখে তাদের অটোগ্রাফের দাম নির্ধারিত হয়েছিল।
অটোগ্রাফের মধ্যে লুকিয়ে আছে অটোগ্রাফ দেয়া ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ যেমন আলাদা, প্রতিটি সইও তেমন আলাদা। তাই গোয়েন্দাদের কাছে সইও আঙুলের ছাপের মতোই মূল্যবান চিহ্ন। কোনো ব্যক্তির অটোগ্রাফ থেকে সেই ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কে বেশ কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সই ছোট, অল্প হেলানো, দেখতেও সুন্দর। পুরোটাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে ‘t’ এর মাথা কাটার উড়ন্ত টান। ‘E’- টাও কম শিল্পিত নয়। পরিচ্ছন্ন এই অটোগ্রাফে একই সঙ্গে চিন্তার শৃঙ্খলা ও শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। এই অনন্যসাধারণ বিজ্ঞানী আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক হবার পাশাপাশি ছিলেন চমৎকার এক বেহালাবাদকও।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সই ; Image Source: Live Science

মহাত্মা গান্ধীর সই এত ছোট যে, বিশ্বের রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত বিরল। সাধারণত নেতাদের সই খুব বড়ই হয়। কিন্তু গান্ধীজির সইয়ের মধ্যে দিয়ে তার চিন্তাধারা প্রকাশ বেশ পরিলক্ষিত হয়। তিনি বিশাল প্রতাপশালী নেতা কখনোই হতে চাননি, অহিংসা আন্দোলনের পথিকৃৎ গান্ধীজির মাটির কাছাকাছি অনাড়ম্বর, নম্র জীবনযাপনের সাথে সইটি বেশ মানিয়ে যায়।
মহাত্মা গান্ধীর সই; Image Source: PatnaBeats

পপ গানের সম্রাট এলভিস প্রিসলির সইয়ে সূক্ষ্ম বা শিল্পিত ব্যাপার যেন একটু কম। কিন্ত ‍একটা সূক্ষ্মতা আরোপের প্রবণতা বেশ দেখা যায়। অক্ষরগুলো খুব নমনীয়, আর পুরো সইটা বেশ বড়। জনপ্রিয়তাকামী ব্যক্তিদের সই সচরাচর বেশ বড়ই হয়। শেষ ‘y’– এর টানে সইটাকে আরো বিশিষ্ট করে তোলার চেষ্টাও সহজে চোখে পড়ে। এলভিসের গানের চরিত্রের সাথে একটা মিল এই সইয়ে আছে।
এলভিস প্রিসলির অ্যালবামের কভাবে পেইজে তার সইয়ের প্রতিলিপি; Image Source: discogs.com

টমাস আলভা এডিসনের সইয়ে শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যের যথাযথ সহাবস্থান বেশ লক্ষণীয়। সইটা তাড়াহুড়ো না করে অত্যন্ত যত্নে করা। পুরো স্বাক্ষরে দারুণ মনোযোগের ছাপ, অক্ষরগুলোও মাপা। পুরো সইটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেওয়া বিশাল টানটি তার জনপ্রিয় হওয়ার ইচ্ছাটিকেই ফুটিয়ে তোলে। তার শিল্পীসুলভ মানসিকতার পরিচয় দেয় সইয়ের সামগ্রিক সৌন্দর্যে।
শৃঙ্খলা ও সুষমামন্ডিত টমাস আলভা এডিসনের অসাধারণ সইয়ে; Image Source: Nate D Sanders

বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে এই অটোগ্রাফ রীতিমতো লাভজনক। লেখকরা তাদের বইয়ে, গায়করা অনুষ্ঠানের টিকিটে প্রায়ই অটোগ্রাফ দেন শুধু ভক্তদের খুশি করার জন্য নয়, এর ফলে বিক্রিও বাড়ে। তাই বর্তমানে অটোগ্রাফ এখন আর কারো কোনো নেশা বা শখের উপকরণ হয়ে থাকেনি। এর সাথে জুড়ে গেছে অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। তারপরও পছন্দের কোনো ব্যক্তি বা তারকার অটোগ্রাফ পেতে কে না চাই বলুন!

Navigation

[0] Message Index

Go to full version