শিশুদের থেকে শৈশব কেড়ে নিচ্ছি না তো?

Author Topic: শিশুদের থেকে শৈশব কেড়ে নিচ্ছি না তো?  (Read 1010 times)

Offline Md.Towhiduzzaman

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 71
  • Test
    • View Profile
গ্রাম–মফস্বলের শিশুদের জন্য যত শিশুসুলভ আনন্দের সুযোগ থাকে, নগরের শিশুরা তা পায় কি? ছবি: ফারুক ওয়াসিফ
গ্রাম–মফস্বলের শিশুদের জন্য যত শিশুসুলভ আনন্দের সুযোগ থাকে, নগরের শিশুরা তা পায় কি? ছবি: ফারুক ওয়াসিফ
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৪ সালে একটি চিঠিতে অধ্যক্ষ মোহিতচন্দ্র সেনকে লিখেছেন, ‘...ছেলেদের নিয়মিত সাহিত্য চর্চা প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করবেন। প্রত্যেক ছেলের সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়েই অর্থাৎ লেখাপড়া রসচর্চা অশনবসন চরিত্রচর্চা ভক্তিসাধন সব-তাতেই আপনি ঘনিষ্ঠ যোগ রাখবেন...।’ তা ছাড়া তিনি আরও বলেছেন, সকালে ছেলেদের কায়িক শ্রম করতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজলে ক্ষতি নেই, কিন্তু গায়ে যাতে জল না বসে, তা দেখতে হবে ইত্যাদি। জানা নেই, আজকের দিনে এমন উপদেশ আমাদের স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষরা পান কি না! অথচ এখনকার দিনে আমরা সব ভুলে প্রাণপণ চেষ্টা করছি শিশুদের থেকে শৈশবের উচ্ছ্বলতাকে দূরে সরানোর। এ এক অদ্ভুত আত্মঘাতী প্রতিযোগিতা! আমাদের ছেলেমেয়েরা আজ বেড়ে উঠছে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আর তাদের সঙ্গে থাকছে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী, ইলেকট্রনিকস আর প্লাস্টিকের তৈরি পুতুল, খেলনা, বাঘ, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি। তারা বেড়ে উঠছে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যভাবে।

ছোট বয়স থেকেই হাতে তুলে নিচ্ছে ল্যাপটপ, মোবাইল। ব্যবহার করছে হরেক রকমের অ্যাপ, যা হয়তো আমরা বড়রাও এখনো অভ্যস্ত নই পরিপূর্ণভাবে। আর এভাবেই তারা ঢুকে পড়ছে একটি ভার্চুয়াল অনিয়ন্ত্রিত জগতে। হয়ে উঠছে বেপরোয়া, এমনকি অল্প বয়সে কৌতূহলবশত বীরত্ব দেখাতে গিয়ে এমন সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে, এমনকি সমাজকে। সে কারণেই একে অপরের প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি সব ক্ষেত্রে। নিছক তুচ্ছ কারণে ছেলেমেয়েরা জড়িয়ে পড়ছে বড় ধরনের সহিংসতায়। এসব খবরাখবর প্রতিদিনের খবরের কাগজেই আসছে।

একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ছেলেমেয়ের মধ্যে শৈশবের আনন্দময় প্রকৃতিগত অংশটুকু প্রায় অনুপস্থিত। তারা হঠাৎ করেই শৈশবকে ভুলে গিয়ে অথবা বাদ দিয়ে এক ধাপ উপরে কৈশোরে পা দিয়ে ফেলছে আচমকা। আচরণ করছে ঠিক বড়দের মতো করে। এমনকি তাদের চাহিদার জায়গাগুলোও ঠিক বড়দের মতো। হয়তো সাময়িকভাবে তাদের এই পাকনামোকে আমরা খুশিমনেই দেখছি, কিন্তু ভবিষ্যতে এর পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ। আর এ কারণেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংগঠিত হচ্ছে অনেক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধ ও অপসংস্কৃতি। তারা চিনছে না শৈশবের খেলার মাঠ, ডোবা-নালা, পাখপাখালি, কাদা-মাটি, সবুজ ঘাস, গাছগাছালি, আরও কত কিছু! সারা দিন হয়তোবা মুখ বুজে পড়ে রয়েছে নম্বরভিত্তিক পাঠ্যবইয়ের পাতায় অথবা অন্য কোনো কম্পিউটার গেমে। অথচ বেশির ভাগ মানুষ, যারা শিশু উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতন, তারা শিশুদের জন্য নকশা, পরিকল্পনা ও সৃষ্টিশীল ভাবনা সম্পর্কে এখনো তেমন কিছুই জানে না। জানলেও খুব সহজে এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে ধারণা কম বৈকি!

আমাদের সবাইকে জানতে হবে, শিশুদের জন্য প্রয়োজন পানি, বালু, মাটি ও পরিবেশের অন্য অংশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ। তাদের দরকার এসবের সঙ্গে একধরনের শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়া, যা আসতে হবে তার চারপাশের পরিবেশ থেকে খুব সাধারণভাবে, বড়দের কাছ থেকে। তাদের জন্য আসলেই বদ্ধ ঘরের মধ্যে প্রাণহীন সরঞ্জামগুলোর প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় ভালো কিছু আন্তরিক সুযোগের সমাজ ও পরিবারের কাছ থেকে। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে যতটুকুই খেলার মাঠ আছে, সেখানে এসব মানবীয় সুযোগ নেই মোটেও। মনে রাখতে হবে, শুধু শহরে খেলার মাঠ তৈরি করলেই শিশুরা শৈশব ফিরে পাবে না। হয়তো সেখানে খেলার কিছু সরঞ্জামের ব্যবস্থা আছে ঠিকই, কিন্তু নেই সঠিক পরিবেশ ও সমন্বয়, যেখানে শিশু সুরক্ষা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খেলার মাঠ ছোট হোক কিংবা বড়, আসল কথা সেই মাঠগুলোকে হতে হবে অবাধ, নিরাপদ আর আনন্দময়।

একটু সুযোগ পেলেই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে শহরের বড় বড় শপিং সেন্টারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে আড্ডা দেওয়া, সিনেমা দেখা—এগুলোই এখন তাদের সময় কাটানোর প্রধান পথ। এমনকি একটু সচেতন থাকলেই শুনতে পাওয়া যাবে, অতি অল্প বয়সেই তাদের কথার মধ্যে স্থান পাচ্ছে এমন কিছু, যা তাদের বয়সের সঙ্গে অনেকটাই বেমানান। আমাদের দেশের প্রতিটি শহরকে শিশুবান্ধব করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে শহরের কাঠামোর মধ্যে শিশুবান্ধব জায়গা তৈরি করার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু নম্বরভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতিতে আঁকড়ে না থেকে নগর এলাকাগুলোয় আনন্দপুর শৈশবিক শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে স্কুলগুলো হবে মানবীয় গুণাবলি বিকাশের আঁতুড়ঘর। শিশুদের জন্য খেলার মাঠগুলোয় খুব সহজ কিন্তু সৃজনশীল উপায়ে সারা বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। ভাবতে হবে সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুসমাজের কথাও। শিক্ষাকে করতে হবে আরও সহজ ও প্রাণবন্ত। শিশুবান্ধব স্কুল উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ, শিশুদের সৃজনশীলতা, পরিচ্ছন্নতাবোধ, স্বাস্থ্য রক্ষা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং সৃজনশীল খেলার মাঠকে সমন্বয়ের কথা আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে সহজভাবে বোঝার জন্য শৈশবের শিক্ষার মধ্যে পরিবেশগত শিক্ষাকে এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যেন ছোটবেলা থেকেই সব শিশুর মধ্যে নিজ পরিবেশ সম্পর্কে ভালোবাসা জন্মায়।

আশার কথা, এরই মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগরীর ১৯টি পার্ক এবং ১২টি খেলার মাঠকে আধুনিকীকরণ করার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেখানে প্রায় ১৩টি প্রতিষ্ঠান এবং ৭০ জন স্থপতি একযোগে কাজ করছেন। এ ধরনের প্রকল্প অন্য শহরগুলোতেও সময় থাকতেই করা প্রয়োজন বৈকি। এসব প্রকল্পে বিভিন্ন প্রজাতির লতা-গুল্ম ও জলাধার সংরক্ষণ করার পাশাপাশি সমাজে মিলেমিশে থাকার সাধারণ সূত্রগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশ যেন হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, নতুন প্রজন্মকে তাদের শৈশবকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিশুবান্ধব স্থানগুলোয় নিজেদের মধ্যে মজা করা, খেলাধুলা, গান, নাটক, কবিতা এবং পুতুল তৈরির মতো বিষয়গুলোকে একত্র করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পড়া, মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি এবং জীবনবোধের মতো বিষয়গুলোকে শেখার সুযোগ তৈরি করে দেবে। আর তখনই এই জায়গাগুলো শৈশবের সৃজনশীলতা ও মতপ্রকাশের মাধ্যমে একটি সামাজিক মঞ্চে পরিণত হবে, যা বর্তমান অস্থির সমাজের জন্য খুবই প্রয়োজন।

সজল চৌধুরী, সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
Md. Towhiduzzaman
Asst. Coordination Officer
Department of CSE & English
E-Mail: towhiduzzaman@daffodilvarsity.edu.bd
Contact No: 01991195595