টিউশন
রুম্মান মাহমুদ
দুই বোন। বড়টা চিকন বুদ্ধির। আর গাধাটা আমার ছাত্রী। না বুঝতে পারার সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। সম্ভাব্য সব উপায়ে বোঝানোর পর একটা ক্ল্যাসিক 'বুঝি নাই' কাঁচের গ্লাসের মতো শব্দ করে মেঝেতে ছড়িয়ে যায়। এরই মধ্যে বড়টা আসে চা-নাস্তা নিয়ে। চা ভালোই। নুডলসটা বাদ দিলে বাদবাকি আইটেমগুলা চলে যায়। যায় না কেবল বড় বোনটা। অতি নাকি নাকি গলায় জিজ্ঞাসা করে, আরেক কাপ চা দিবো? ভাবি কষে চড় দেই। বলি, থাকুক চা, আপনিও থাকেন। দেখেন ছোটবোনের দৌড়। নাকি নারী জবাব দেয়, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব আমার বাবাও বলে। আমার বোনের মেয়েটা জন্মের দু'মাসের মাথায় ঠান্ডায় জমে হুট ক'রে ফুটে যাবার পর মাও বলেছিল তার জামাইকে। আমার চাকরি হয় না তিন বছর। সেশন জ্যাম সহ হিশেব করলে পাঁচ। সহপাঠিদের অনেকেরই বাড়ি ও বাচ্চা আছে। বড় হলে পড়াবো এটাও বলে রেখেছি। ঘরে ঘুমের ঔষুধ কিছু কিনে রেখেছি। ডিপ্রেশনেরও। সোমবার একটা ইন্টারভিউ আছে। সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
আমি শ্বাস ফেলি। বড়বোন বলে, জানেন আমি ছবি আঁকি?বললাম, শেখেন? সে বলে, এমনিই পারি। আপনাকে দেখাই। আমি কিছু বলার আগেই উড়ে যায়, উড়ে আসে নাকিস্বর নারী। সুবাইতা আজমাইন। ডাক নাম সুবাহ। আজমাইন অথবা আজরাইল তাদের দুবাইওয়ালা বাপ। ছবি দেখে তব্দা খাই। পেন্সিল স্কেচে অপূর্ব এক মেয়ে। বলি, এইটা কে? আপনিতো ভয়াবহ আঁকেন। শিখাবেন? এইটা তামিল নায়িকা বলে সুবাহ দুলতে দুলতে বলে, এইসব বলবেন না। আমার ভুল ধরেন। আমি ভেবে বলি, নাকটা ঠিক চেহারার সাথে যায়নি পুরোপুরি। বোঁচা হয়ে গেছে। সুবাহ বললো, আমার তো বোঁচ নাকই ভালো লাগে। কোরিয়ান মেয়েদের দেখেছেন? কি সুন্দর। বলি, আমার অসহ্য লাগে। মনে হয় রোলার কোস্টার চলে গেছে ওপর দিয়ে। সে রাগ করে চলে যায়। আমি রুবাকে পড়াই।
পরের দিনের পৃথিবী টিউশন মুক্ত ছিল। এরপরের দিন রোটেশানে ফেরত আসে মেজাজ খারাপ। না বোঝা ছাড়া রুবার অন্য কোন সমস্যা নাই। নখ কামড়ায় না। হাতের লেখা ভালো। একসময় মনে হয় ঠিক হয়েই যাবে। সুবাহ আসে নাস্তা নিয়ে। বলে, আপনার জন্মদিন কবে? বললাম, সাতাশ তারিখ, এই শুক্রবার। লাফিয়ে ছাদে বাড়ি খেয়ে সমস্ত নাক এক করে বললো, ওমা তাই! ট্রিট চাই। বললাম, মাসের শেষে জন্মানোদের কাছে ট্রিট চাইতে নাই। আল্লাহ নারাজ হয়। তাছাড়া আমার পৃথিবীতে আসার ইচ্ছা ছিল না। অনিচ্ছায় এসে গেছি। বললো, এইসব বুঝি না, ট্রিট চাই। মনে মনে কষে গালি দিয়ে মন খুলে বলি, ঠিক আছে। একটাই শর্ত। আমার গিফট চাই। আপনি আমার একটা ছবি আঁকবেন। পেন্সিলেই। কয়েকটা স্যাম্পল দিবো, যেটা খারাপ হয় না। সুবাহ বললো, ঠিক আছে। নিলো, ছবিকিছু।
ক্লাউন সেজে ইন্টারভিউতে ঢুকলাম। প্রথম প্রথম ভয়ে পা কাঁপতো। এখন যখন বুঝতে পারি সব আগে থেকেই সেট করা আছে, রাগে গা কাঁপে। বোর্ডে ছয়জন ছিল। তেরটা প্রশ্ন হলো। এগারোটা ছক্কা। এক বুড়া জিজ্ঞাসা করলো, পাশ তো করলা অনেক আগে। কিছু করো নাই কেন। ইচ্ছা হচ্ছিল চেয়ার ঘুরায়ে তার মাথায় মারি। বললাম, পাশের বছর বেশি আগের নয় স্যার। সেশনটা আগের। আমরা যেখানে পড়েছি সেখানে সহজে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। বললো, বাবা কি করে। স্ট্রেইট বললাম, আমার চাকরি পাওয়ার অপেক্ষা করে। আগে স্কুলে পড়াতেন। এখন পেনশন। মনে হয়, ক্লোজ-আপ ওয়ানের নোলক সালমার পরেই আমি ঢুকে গেলাম এই কাতারে। ওদের চোখের শকুন ভাবটা কমলো। বললো, ঢাকার বাইরে পোস্টিং দিলে সমস্যা আছে? ধরো, চট্টগ্রামে? মনে মনে বললাম, জাহান্নামের চৌরাস্তায় দিলেও সমস্যা নাই। মাথা নাড়লাম। বের হয়ে এলাম। জীবনে এই প্রথম মনে হচ্ছিল, আজ মনে হয় চান্স আছে।
টিউশনে গেলাম। একই লুপ। বোঝানো-বুঝি নাই-আবার বোঝানো-চা সহ ভাসতে ভাসতে নাকি ও ন্যাকা নারী। আমাকে বললো, আপনার পেছনে পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডওলা ছবিটা কিন্তু সুন্দর। সেটাই আঁকছি। আমি কথা না পেয়ে বললাম ইন্টারভিউ'র কথা। দুই বোনই নড়েচড়ে ভরসা দিলো। এইবার হবে। আমিও ভাবি, এই টিউশন জীবন থেকে মুক্তি পেলেই হয়।
বৃহস্পতিবার নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলাম মেসে। নয়টার দিকে ফোন এলো। চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার নিতে বললো। আনন্দে গলা টিপে ধরলাম পাশের সিটের বাশার ভাইয়ের। বাড়িতে ফোন দিলাম। আব্বা হার্টফেইল করতে করতে সামলে নিলো, আম্মা ফিঁচফিঁচ করে কান্না। ছোট ভাই ফেইসবুকে স্ট্যাটাস। এপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়েই দেখলাম শালারা চট্টগ্রামেই পোস্টিং দিয়েছে। এক তারিখ জয়েনিং। এ খেলা খেলবো আমি কেমন করে -গুনগুন করে গাইতে গাইতে টিউশনে ফোন দিয়া বললাম, চাকরি হইসে। আমি আর নাই। গাধা ছাত্রীর মা বললো, কাল আসেন, টাকা নিয়া যান, মিষ্টি খাওয়াবেন তো! মনে পড়লো, কাল তো জন্মদিন। সুবাহ'র আঁকা ছবি নিয়ে হবে, ট্রিট দিতে হবে। টিট ফর ট্যাট।
গেলাম ঝাল-মিষ্টি সব নিয়ে। রুবা অভিনন্দন জানায়া দরজা খুললো। বসলাম, পর্দার ওপার থেকে আন্টির গলা শুনলাম। ছাত্রী 'এসব কি দরকার ছিল' বলে খাবারগুলা ভিতরে নিয়া গেল। তার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল চাকরি ওর হইসে। সুবাহ আসলো, অন্যদিনের মতো ভেসে ভেসে, দুলে দুলে না। হেঁটে হেঁটে। বললো, হ্যাপি বার্থডে। আমি ধন্যবাদাইলাম। বললো, আপনাকে মিস করবো। বললাম, আমিও। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ঢাকায় এলে বাসায় আসবেন। বললাম, আচ্ছা। সুবাহ তার রুমে চলে গেলো একটা আবছা অস্বস্তি ছড়িয়ে।
একটু পর যখন ফুটবো, সুবাহ এসে একটা রোল করা কাগজ ধরায়া দিলো। বললো, বাসায় গিয়ে খুলবেন। ভালো থাকবেন। বাসায় এলাম একটা জগাখিচুড়ি অনুভূতি নিয়ে। কাগজ খুলেই দেখি পাহাড়কে আড়াল করে দাঁত কেলিয়ে হাসছি আমি। নাকটা মেজাজ খারাপ করার মতো বোঁচা।