সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে? (ইত্তেফাক, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮; পৃ.৯)

Author Topic: সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে? (ইত্তেফাক, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮; পৃ.৯)  (Read 954 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ইং (ইত্তেফাক)

এবারের ঈদ যাত্রায় (১৬-২৮ আগস্ট পর্যন্ত) সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় ২৭৮ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩৫ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সড়ক পথেই দুর্ঘটনার হার বেশি। গত ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এ তথ্য প্রকাশ করে। বলা বাহুল্য, নিরাপদ সড়কের দাবিতে চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনসাধারণ অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসলেও এখন পর্যন্ত ফলাফল শূন্য। নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়িত না হওয়ায় দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনার ফলে প্রতিনিয়ত আহত-নিহত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। তাছাড়া দেশের সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতির ক্ষেত্রেও এসব দুর্ঘটনা মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন। রাজধানীর কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কে গত ৩০ জুলাই বাস উঠিয়ে দিয়ে দুই শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে এ আন্দোলন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সচেতন জনগণ মাত্রই দেখে থাকবেন, ঢাকায় চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে যাত্রী ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের নগ্ন প্রতিযোগিতা চলে।

দেশের গণপরিবহন খাতে প্রশিক্ষিত ড্রাইভার না থাকা এবং চুক্তি ভিত্তিক ড্রাইভারের হাতে মালিকপক্ষ বাস ছেড়ে দেওয়ার কারণেই মূলত বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক, মহাসড়কে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নসিমন-করিমন চলাচল, বিরতিহীনভাবে যানবাহন চালানো ইত্যাদি। রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা যেন কিছুতেই ফলপ্রসূ হয়নি। মূলত রাজনীতি এবং চাঁদাবাজির কারণে এই ধরনের উদ্যোগ অতীতে বিভিন্ন সময়ে ভেস্তে গেছে। সড়ক পরিবহনে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে এবং দেশের সড়ক-মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তা কমাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ জুন ছয়টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে; দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রাক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাধা নিশ্চিত করা।

সড়ক দুর্ঘটনা এ দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতিদিনই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার খবরা-খবর। এক হিসেবে দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর এতে প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসেব অনুযায়ী, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে ৭২ হাজার ৭৪৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৫২ হাজার ৬৮৪ জন আহত হয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের (২০১৮)  প্রথম ছয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে কমপক্ষে দুই হাজার ৪৭১ জন নিহত হয়েছেন। সুতরাং, দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে এতে মনে হয়, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদে চলার পথ না হয়ে তা দিনে দিনে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন যাত্রা করা মানেই যেন নিজের জীবন বাজি রাখা। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলোকে কোনোভাবেই জনগণের কপালের লিখন বলা যায় না। বরং তা এক প্রকার হত্যাকাণ্ড।

আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ, ঝুঁঁকপূর্ণ ও অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে পরিপূর্ণ। আর এর মধ্য দিয়েই যাত্রীদের নিকট হতে আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া আর অদক্ষ চালককে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দিয়ে, ট্রাফিক আইন না মেনে এবং ফিটনেসহীন গাড়ি চালানোর মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে সরকার ও জগগণের ইতিবাচক চিন্তা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। রাস্তার ওপর ফুটপাতে দোকানপাট স্থাপনসহ ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হকারদের ব্যবসা করার ‘সুযোগ’ করে দেওয়া, অপরিকল্পিত ও দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজি, খেয়ালখুশি মতো যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করা, সড়ক-মহাসড়কের ওপর রিক্সা, ভ্যান, টেম্পো, ম্যাক্সি, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড স্থাপন করা, রাস্তার মাঝখানে ডাস্টবিন স্থাপন করা, সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন না করা এবং অসত্ উদ্দেশ্যে একই রাস্তা বছরে বারংবার খনন করা, জনগণ কর্তৃক রাস্তা পারাপারের নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে না মানার কারণে এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে।

দেশে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয় বা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু জবাবদিহির জায়গাটি নিশ্চিত করা হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখানে যারা নীতিনির্ধারণ করেন, তারাই  মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি। জবাবদিহির ব্যাপারে যে অনাগ্রহ রয়েছে, এর মূলে রয়েছে এই স্বার্থের সংঘাত। যা হোক, সড়ক দুর্ঘটনারোধে সর্বাগ্রে চালকদেরকে হতে হবে বেশি দক্ষ, হতে হবে সতর্ক। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তা চলাচলের আইন-কানুন যথারীতি মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোরতার সঙ্গে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য। মাদক সেবন করে গাড়ি না চালানো এবং গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইলফোনে কথা বলাসহ চালকদের ‘অভার টেকিং’ করার মানসিকতাও পরিহার করা প্রয়োজন। তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সার্বিক সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোসহ চালকদের দক্ষতা বিচার করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি না ঘটে, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা আবশ্যক।

মোটকথা, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। সর্বোপরি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, সরকারসহ আপামর জনগণকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদের পরিবর্তে হয়ে ওঠবে নিরাপদে চলার পথ-যা আমাদের সকলেরই একান্ত কাম্য।

লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
ই-মেইল: kekbabu@yahoo.com
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd