ইসলামে যে এক মহান সভ্যতা লুকিয়ে আছে তা আমরা ঠাওর করি না। রোমানরা যখন নিজেদের দেহের পবিত্রতা জানত না তখন ইসলাম মানুষকে শিখিয়েছে কী করে অজু গোসল করে পাক-সাফ হতে হয়।
আজও ফরাসিরা গোসলের ব্যাপারে অলস। শংকরের লেখা জীবন সাগর তীরে বইটি পড়লে তাদের সভ্যতা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যাবে।
তবে ইসলামে একটি নির্ধারিত সভ্যতা আছে, তা হল তাওহিদ ও রিসালাতের আওতায় সেরা। যখন একজন ভালো ইসলামী বক্তাকে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, হুট করে বলে দেবে সংস্কৃতি! সেটা তো ইসলামে নিষিদ্ধ।
যদি বলেন এই যে আপনি ওয়াজ করছেন এটাও ইসলামী সংস্কৃতির অংশ। জবাবে বলবে সেটা কী করে? আপনি যদি এর পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে তার কাছে কিছু জানতে চান তখন হয় তোতলামি রোগে ধরে যাবে তার, অথবা বোবা জীনের খপ্পরে পড়ে যাবেন বক্তা। উলটা জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আপনি ইসলামী সভ্যতায় বিশ্বাস করেন না, জবাবে বলবে বিশ্বাস করব না কেন? কিন্তু সেটা কী?
একটু বুঝিয়ে বলুন। তখন এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কিছু বলবে যা সভ্যতা সংস্কৃতির ধারেকাছেও নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে কবিতা আবৃতি বা গান গাওয়া কিংবা নৃত্যকলা সংস্কৃতি নয় সংস্কৃতির বাহন মাত্র।
সংস্কৃতি হল এগুলোর বিষয়বস্তু। আমাদের মনে রাখা উচিত সংস্কৃতি হল সভ্যতার বাহন। সংস্কৃতির পিঠে চড়েই সভ্যতা কোনো জাতি-গোষ্ঠীর ডানা মেলে বসে। এ জন্যই প্রতিটি সভ্যতা সংস্কৃতিকে লালন করে থাকে।
আর পৃথিবীতে যত ধর্ম এসেছে তা তার বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিত সংস্কৃতিকে ধারণ করেই বেঁচে আছে। শুধু মুসলিম জাহানের সাহিত্য স্থাপত্য কলায় নয় জ্ঞান গরিমা পরিবেশ রক্ষা মানবাধিকারসহ আজকে পৃথিবীজুড়ে যে সভ্যতা ও সুকুমার সংস্কৃতি লালিত হচ্ছে তার দিকে তাকালে আরবের মরু দুলাল মহানবী (সা.)-এর শিক্ষাকেই দেখতে পাই।
সংস্কৃতি কী? আরবিতে একে সাক্বাফাহ বলে। প্রফেসর ড. উমর বাহাযিক্বের মতে সংস্কৃতি বা সাক্বাফাহের ভালো সংজ্ঞা হল, ‘মা তাসক্বিফু আলাইহিন নাস’ যেসব নিয়ে তুমি একটা মানব সমষ্টিকে পাও তাই সংস্কৃতি। মানে আপনি একটি মুসলিম সমাজে আছেন। এখানে আপনার ঘুম ভাঙে আজানের শব্দে। মসজিদে নামাজ হয় একতাবদ্ধ হয়ে।
এখানে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা, ফেরেশতা, নবী-রাসূল (সা.) আসমানি কিতাব, আখিরাত, কদর ও কেয়ামতের বিচার, জান্নাত-জাহান্নামকেন্দ্রিক জীবন থাকে। জুমা ঈদে মুসলিম স্কলারদের ভাষণ অভিভাষণ থাকে, আনন্দ উৎসব বিয়েশাদিতে নির্দোষ গান থাকে। মানুষে মানুষে মোলাকাত কুলাকুলি থাকে। নারী-পুরুষে মিলন হতে চাইলে বিয়ের ইজাব কবুল থাকে।
বিয়ের মাধ্যমে পরিবার হয়। পরিবার হয়ে ওঠে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেখান থেকেই বের হয়ে আসে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য যা একসময় সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। পরিবারে হৃদয় আনন্দিত করার নানা প্রক্রিয়া থাকে, দেহকে ভালো রাখার সামগ্রিক দিক থাকে, খাওয়া-দাওয়ার নানা ব্যবস্থা থাকে। আনন্দে ছন্দ থাকে বেদনায় কান্না থাকে। এসব ইসলামী সংস্কৃতি।
আর সভ্যতার আরবি হল হাদ্বারাহ। এটি হল সংস্কৃতি থেকে উৎপন্ন এমন জিনিস যা আপনার ও আমার কাছে হাজির থাকে।
মুসলিম সংস্কৃতির একান্ত অঙ্গ হল ইবাদাত। বিশেষ করে নামাজ আদায়। এটা মুসলিম সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নামাজ আদায়ে কিবলা লাগে, পবিত্র জায়গা লাগে, পবিত্র অর্জনে পানির স্থান লাগে, নামাজ পরিচালনার জন্য ইমাম ও ইমামের স্থান লাগে, মহিলা-পুরুষের জন্য আলাদা জায়গা লাগে, আজানের জন্য সর্বোচ্চ স্থান লাগে যেখান থেকে শব্দ ইথারে ভাসিয়ে লোকালয়ে পৌঁছানো যায়।
এগুলো মুসলিম সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি ঠিকভাবে চর্চা করার জন্য আমরা একটি জায়গা বাছাই করি যার মালিকানা নিজেরা না রেখে ওয়াকফ লিল্লাহ বা আল্লাহর মালিকানা করে সব তাওহিদবাদীর প্রবেশাধিকার করে দেয়া হয়। সেখানে তাওহিদকে ভিত্তি করে কাজ হয়।
নামাজের শুরুতেই বলি ‘ইন্নি ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাসসামাওয়াতে ওয়াল আরদ্বা হানিফাও ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন’। আল্লাহর উদ্দেশে একটা ঘর বানানোর কাজে অনেক হালাল টাকার জোগান দিয়ে আল্লাহর জন্য খাস করে সুন্দর একটা ঘর বানাই। এর মুখ করে দিই কিবলার দিকে। ভেতরে ইমামকে রাখি সুন্দর সুরক্ষিত মেহরাব নামক স্থানে।
ইমামকে সবাই দেখা ও কথা শোনার সুবিধার্থে মিম্বর বানিয়ে দিই। মুয়াজ্জিন হয় সুকণ্ঠ দরাজ আওয়াজের, যাতে তার আজানের সুর ধ্বনি দূর সুদূরে পৌঁছে, সেজন্য বানিয়ে দিই সুউচ্চ মিনার। অজুর জায়গা, ওয়াশরুম, টয়লেট, মহিলাদের আসার পথ, তাদের জন্য কাতার সংলগ্ন পৃথক কামরা বা পর্দাযুক্ত স্থান। এসবের মিলিত একটি নয়নাভিরাম স্থানকে আমরা মসজিদ বলি।
এই মসজিদই হল ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার স্থান। নবীজি (সা.) যেখানেই গেছেন সেখানেই আগে মসজিদ বানিয়েছেন কেননা তিনি জানেন এই মসজিদকে ঘিরেই গড়ে উঠবে ইসলামী সভ্যতা। এজন্য মসজিদগুলো আমাদের গর্বের ধন।
মসজিদ জগৎকে আলোর পথ দেখিয়ে খোদায়ী সুবাসে মোহিত করে তোলে। মানুষ তা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মানুষ ছুটে চলে উম্মুল মাসাজিদ বাইতুল আতিক কাবা পানে। আর দুনিয়ার অন্য মসজিদগুলোও কাবাকেন্দ্রিক।
এ কারণেই প্রতিটি মুসলিম দেশের ঐতিহাসিক মসজিদগুলো মুসলিম সভ্যতার প্রতীক। আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের সেরা সাহিত্য কা’বার গায়ে লাগিয়ে রাখা হতো। আসসাবউল মু’আল্লাকা নামে সাতটি ঝুলন্ত কবিতার কথা আমরা সবাই জানি।
ইসলাম আসার পর দরকার হল ইসলামী গান কবিতার। ছড়া ছন্দের যা মাসনুভী বা দ্বিপদী ছড়া। রুবাঈ বা চতুষ্পদী ছন্দ। সাবউল মু’আল্লাকার অন্যতম কবি লাবিদ ইসলাম কবুল করে জাহেলি কবিতা ছেড়ে ইসলামী কবিতা লেখা শুরু করেন। কবি হাসসান বিন সাবেত তো রাসূলের (সা.) প্রশংসায় কবিতা লিখে শায়েরুন্নবী খেতাব লাভ করেন।
ইসলামে দরকার হল কোরআন লেখার জিনিসপত্র। কোরআন লেখাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল আরবি ক্যালিগ্রাফি। দরকার হল হাদিস লেখার মনোযোগ। হাদিস গ্রহণে লাগল সত্য মিথ্যার বিচার বিশ্লেষণ গড়ে উঠল রিজাল শাস্ত্র। দরকার হল কোরআন-হাদিস থেকে হুকুম আহকাম, ব্যবহার ও আখলাক বের করার নীতিমালা, ফিকাহ-উসূলে ফিকাহ। এই হল ইসলামী সংস্কৃতির একেকটি দিক।
এই দিকগুলো এক সময় কোরআনের মলাটে গ্রন্থিত হল। হাদিসের কিতাবে ঘর ভর্তি হল। হাজার হাজার মাসআলা ঋদ্ধ হয়ে ফিকাহ’র কিতাবে দামেশক, কায়রো, বাগদাদ মক্কা, মদিনা ভর্তি হল। কবিতার বই হল। কবিতায় এলো হাফেজ সিরাজী শেখ সাদী উমর খৈয়াম সুফি কবিতায় মাওলানা রুমী আমির খসরু। গদ্য রচনায় হাফেজ ইস্পাহানী, ইবনে কুতায়বা, আবু আলী আল ফারেসিদের আগমন হল।
তাদের লেখা একত্রিত করে ঘরে আর জায়গা হল না, বায়তুল হিকমাহ বানাতে হল। এগুলো হয়ে গেল ইসলামী সংস্কৃতির এক একটা দলিল ও দস্তাবেজ। এই সাহিত্য সম্ভারের নাম হল ইসলামী সভ্যতা।
আজকের ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনও কিন্তু মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির অংশ। কোনো বিতর্কে না জড়িয়ে তা পালনে যা ভালো বিষয় তা ধরে রাখতে হবে আর মন্দ যা মিশ্রিত হয়েছে তা বাদ দিয়ে রাসূল (সা.) প্রেমে ইসলামী উম্মাহকে কীভাবে একতাবদ্ধ করা যায় তা এখনই ভাবতে হবে মুসলিম উম্মাহর।
লেখক : মানব ও ধর্ম গবেষক