আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস
আসুন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
০৯ ডিসেম্বর ২০১৮
আমাদের প্রিয় এ বাংলাদেশে যতগুলো সমস্যা জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে দুর্নীতি অন্যতম। চলতি বছরের ২২ ফেব্র“য়ারি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৭ অনুযায়ী, শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশ ২৮ স্কোর পেয়েছে, যা ২০১৬-এর তুলনায় ২ পয়েন্ট বেশি। ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকায় নিু অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৭তম স্থান পেয়েছে, যা ২০১৬-এর তুলনায় ২ ধাপ ওপরে। উচ্চ অবস্থান অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ ১৪৩তম, যা ২০১৬-এর তুলনায় ২ ধাপ উপরে। ২০০১-এ প্রথমবারের মতো এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের এবারের স্কোর সবচেয়ে বেশি। এবার বাংলাদেশের সমান স্কোর পেয়েছে গুয়াতেমালা, কেনিয়া, লেবানন ও মৌরিতানিয়া। বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর এখনও অনেক কম। অর্থাৎ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে মধ্যম মাত্রায় সাফল্য অর্জন থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তদুপরি, দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিু এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে চতুর্থ সর্বনিু। আফগানিস্তান ছাড়া অপর যে দুটি এশীয় দেশ বাংলাদেশের তুলনায় নিুতর অবস্থানে রয়েছে- সেদেশ দুটি হল উত্তর কোরিয়া ও কম্বোডিয়া।
বলাবাহুল্য, জনসংখ্যাধিক্য ও ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটির একদিকে রয়েছে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, অপুষ্টি, সম্পদের অভাব, অপরদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে দুর্নীতির কালো ছায়া। দুর্নীতি নামক কালোব্যাধি যে তার কালো থাবা বিস্তার করে সমাজকে দিন দিন গ্রাস করে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির ওপর জরিপ চালিয়ে যে ফল প্রকাশ করেছিল, তাতে পরপর টানা পাঁচ বছরই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। বারবার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে থাকায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতির কারণে জিডিপির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বিভিন্ন সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।
দেশের সমস্যা আর সম্ভাবনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তা হল ‘দুর্নীতি’। আইডিবি, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থা বিভিন্ন সময়ে সরকারগুলোকে দুর্নীতি হ্রাস করার জন্য অনেক পরামর্শ দিয়েছে এবং সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও রিপোর্টের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধে নানাভাবে সরকারসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এতকিছুর পরেও বিভিন্ন সরকারের আমলে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি নামক কালোব্যাধির ‘পাগলা ঘোড়া’কে বাগে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটেছে, জন্ম নিয়েছে অসংখ্য নতুন নতুন দুর্নীতিবাজ।
দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন সব কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা, দারিদ্র্য বিমোচন ও আয়-বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ, দুর্নীতি দমন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর করা, দুর্নীতি বিষয়ক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে শুধু ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করা দরকার। গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদঘাটন এবং তা দূর করতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়া দরকার। টিআই জরিপ অনুসারে, দেশ আগের চেয়ে কিছুটা হলেও দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর অনেক বড় বড় দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। এখনও অনেক বড় বড় দুর্নীতিবাজ দুর্নীতির দায়ে কারাগারে আটক থাকার পাশাপাশি তাদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকার কঠোরহস্তে দুর্নীতি দমনের ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়ন হবে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা।
বর্তমানে দুর্নীতি প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলছে শোভাযাত্রা-সমাবেশ-আলোচনা সভা ইত্যাদি। এসব কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন, যা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। সর্বোপরি, দুর্নীতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য দেশের সর্বত্র প্রয়োজন ‘সততা’র একটি আবহ তৈরি করা। দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটি সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশ। সবারই স্মরণ রাখা দরকার, এ দেশটি আমার, আপনার, সবার। স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে হলে ‘দুর্নীতি’ নামক ব্যাধিকে যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায় নেই। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে সম্মিলিত কণ্ঠে দুর্নীতিকে ‘না’ বলি। দুর্নীতির পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি এবং তাদের কঠোরহস্তে প্রতিরোধ করি। আর চেষ্টা করি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে। সরকারসহ আমাদের সবার প্রয়াসে এ দেশকে দ্রুততম সময়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের সবার উচিত হবে এখন থেকেই সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করা।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com
Link:
https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/120082/%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%97%E0%A7%9C%E0%A6%BF?fbclid=IwAR3_11snF-ToYKK2-XZWJdPyXjnQ9V4tfzVLfKXU4Zy4lPo83DY5_kMTxBE