Career Development Centre (CDC) > Academia Lecture Series

ব্যবসার কবি আনোয়ার হোসেন, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটতে।

(1/2) > >>

Noor E Alam:

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটকের সামনে ভীড়। এ দৃশ্য নতুন নয়। তবে কারণটা নতুন। আজ (শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি) এখানে এসেছেন দেশবরেণ্য শিল্পোদ্যোক্তা ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আলহাজ আনোয়ার হোসেন। তিনি যখন গাড়ি থেকে পা রাখলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িতে তখন তীব্র তেজ নিয়ে জ্বলতে থাকা ফাল্গুনের সূর্যটা হঠাৎ করেই যেন খানিকটা চুপসে গেল। কেনই বা যাবে না? যে আনোয়ার হোসেন মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন, বাবার রেখে যাওয়া সামান্য বোতামের ব্যবসা থেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ নামের বিশাল শিল্প সাম্রাজ্য, তার উজ্জ্বল আলোর সামনে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াবে সূর্য—সেটাই তো স্বাভাবিক। এই বরেণ্য শিল্পোদ্যোক্তা আজ বয়সের ভারে ন্যূজ্ব। ভুগছেন স্মৃতিভ্রম বা ডিমেনসিয়া নামের বিরল রোগে। অনেক চেনা মানুষকেও চিনতে পারেন না, তবু যখন দেখলেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে, তাঁকে দেখামাত্র বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন আনোয়ার হোসেন। এই সময় স্মৃতি তার সঙ্গে প্রতারণা করেনি, তিনি ঠিকই চিনতে পেরেছেন তার দীর্ঘ ব্যবসায়ী জীবনের সহচরকে, যার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। একসঙ্গে কত কাজ করেছেন তাঁরা, একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন ঢাকা চেম্বারকে; মাহবুবুর রহমানকে বুকে চেপে ধরে সেসব পুরনো দিনগুলোতে যেন ফিরে গেলেন তিনি। চোখ ভরে উঠল জলে। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল আবেগে। কী নিবিড় সম্পর্ক! কী দৃঢ় বন্ধন!







এমন হাজারো মানুষের সঙ্গে আনোয়ার হোসেনের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। কী রিকশাওয়ালা, কি বাড়ির দারোয়ান, কি কারখানার শ্রমিক, ‍কি ব্যাংক ম্যানেজার, কি উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা—সবার সঙ্গে ছিল তাঁর হৃার্দিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কই তাকে ব্যবসায়ী হিসেবে করেছে সফল।তাঁর সাফল্যের গল্প শুনতেই সেদিন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আয়োজন করেছিল ভিন্ন আমেজের এক অনুষ্ঠানের। ডিআইইউ ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া লেকচার সিরিজ নামের ওই অনুষ্ঠানটি মূলত তরুণ শিক্ষার্থীদেরকে উদ্যোক্তা হওয়ায় উৎসাহী করতে সফল উদ্যোক্তার একক বক্তৃতার। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ব্যবসাক্ষেত্রের প্রথিতযথা ব্যবসায়ীদের জীবন, উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প ও সংগ্রামের ইতিহাস শিক্ষার্থীদের শোনাতে এ ধরনের আয়োজন গত দুই বছর ধরে করে আসছে। সেদিন গল্প শোনার ১২তম আসর বসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ মিলনায়তনে।

Noor E Alam:
আনোয়ার হোসেনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ড. মো. সবুর খান


আলহাজ আনোয়ার হোসেনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ এম ইসলাম।


সকাল ৯টা থেকেই মিলনায়তন ভর্তি কানায় কানায়। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা দশটায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যেন তর সইছিল না এই পথিকৃৎ ব্যবসায়ীকে এক নজর দেখার, তাঁর বাধা পেরোনোর গল্প শোনার। তাই আগে থেকেই জায়গা দখল করে বসে আছেন তারা।অবশেষে ব্যবসার কবি আনোয়ার হোসেন, যিনি ব্যবসাকে করেছেন কবিতার মতো প্রাঞ্জল ও সুন্দর, তিনি যথাসময়ে এলেন মিলনায়তনে, অশক্ত কিন্তু দৃঢ় পায়ে উঠলেন মঞ্চে, বসলেন নির্ধারিত আসনে। তাঁর শ্রদ্ধায় উদ্ভাসিত হলো পুরো মিলনায়তন, শত শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ব্যবসা জগতের প্রতিনিধিরা নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর তাঁকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন ডিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান, অ্যামচ্যামের সাবেক সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম, এম এ মোমেন, আসিফ ইব্রাহিম, এমএইচ রহমান, ডিসিসিআই-এর সাবেক সহ সভাপতি হোসেন এ শিকদার, আবসার করিম, হুমায়ূন রশিদ, আবু হোরায়রা, শহিদুল ইসলাম, আলাউদ্দিন মালিক, আনোয়ার গ্রপের প্রধান নির্বাহী হোসেন আখতার ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম, উপ উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম মাহবুব ‍উল হক মজুমদার, কোষাধ্যক্ষ হামিদুল হক খান, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল হক, বিভিন্ন বিভাগের ডিন, বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষকবৃন্দ, ড্যাফোডিল পরিবারের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ নূরুজ্জামান, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইমরান হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজু।

Noor E Alam:
আলহাজ আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে নির্মিত দুটি প্রামান্যচিত্র প্রদর্শিত হয় এ সময়। একটি নির্মাণ করেছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, অপরটি আনোয়ার গ্রুপ। এরপর আনোয়ার হোসেনের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করে শোনান ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টারের পরিচালক আবু তাহের খান। দুটি প্রামাণ্যচিত্র আর জীবনী পাঠের মাধ্যমেই মূলত উঠে আসে তাঁর সমগ্র জীবন।

আবু তাহের খান বলেন, চীনারা সাধারণভাবে ক্রুন্দনরত শিশুর কান্না থামাবার চেষ্টা করেন না, কাঁদতে কাঁদতে এক সময় এমনিতেই সে থেমে যায়। চীনাদের ধারণা, এভাবেই একটি শিশু অতি ছোট্ট বয়সে প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে জগৎসংসারে টিকে থাকবার সামর্থ অর্জন করে। চীনারা যা গভীর জাতিগত চিন্তাভাবনা থেকে করেন, আনোয়ার হোসেন সেটিই করেছিলেন ব্যক্তিগত প্রত্যয়, সাহস ও দৃঢ়তা থেকে। বস্তুতঃ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা যে জীবন—সেটিই আনোয়ার হোসেন, সেটিই তাঁর পথ ও পাথেয়। কে জানে, ও রকম বৈরিতার মধ্যে জীবন শুরু না করলে এ সংগ্রামী আনোয়ার হোসেনকে হয়তো আমরা পেতামই না।

আনোয়ার হোসেনের দার্শনিক দিকটিও উঠে আসে এই জীবনী পাঠে। সেখানে বলা হয়, আনোয়ার হোসেনকে কোন অভিধায় অভিষিক্ত করলে সবচেয়ে যথার্থ হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই হয়তো বলবেন যে, তিনি আসলে একজন সফল উদ্যোক্তা, সংগঠক, নেতা ও সমাজকর্মী। কিন্তু পাশাপাশি তিনি একজন দার্শনিকও কি ছিলেন না? তিনি একাধিক জায়গায় বলেছেন, কোনো মানুষই সম্ভাবনাহীন নয়; প্রয়োজন শুধু তার সম্ভাবনার আত্ম-উদ্বোধন। সক্রেটিসওতো সে কথাই বলেছেন—নো দাইসেলফ! সুতরাং আনোয়ার হোসেনের বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যবসা ও অর্থনীতির দার্শনিক চিন্তার শ্রেণিভূক্ত করা যায় না কি?

যে জীবন দোয়েলের ফড়িংয়ের তার সঙ্গে শৈশবে দেখা ছিল না আনোয়ার হোসেনের। ১৯৩৪ সালে জন্ম নেয়া আনোয়ার হোসেন মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারান। লেখাপড়া করবেন কি? সংসারই তো চলে না! হাল ধরতে হলো সংসারের। বাবা রহিম বকসের ছিল মহিষের শিং থেকে তৈরি বোতামের ব্যবসা। এ ব্যবসাই চালিয়ে যেতে পারতেন আনোয়ার হোসেন, কিন্তু উদ্ভাবনের ঘুনপোকা যাঁকে কুড়ে কুড়ে খায় তিনি কেন এক জায়গায় থেমে থাকবেন? তাই ১৯৫৩ সালে মাত্র ৪৮০ টাকা সম্বল করে খুঁজতে আরম্ভ করলেন ব্যবসায়ের নতুন নতুন পথ। তখন তাঁর বয়স মাত্র পনের। বোতাম ফেলে যুক্ত হলেন বস্ত্র বিপণনে। ঢাকার চকবাজারে মাত্র ৯৬ বর্গফুটের একটি জায়গায় ‘আনোয়ার ক্লথ স্টোর’ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর ১৯৬৮ সালে শুরু করলেন বস্ত্র উৎপাদন। উদ্যোগের নাম দিলেন ‘আনোয়ার সিল্ক মিলস’। তখন ‘মালা শাড়ি না দিলে বিয়া করমু না’ এমন একটি জিঙ্গেল শোনা যেত বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এই মালা শাড়ি উৎপাদন করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন আনোয়ার হোসেন। বিয়ের শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাঁর নাম।


ভাবার কারণ নেই এখানেই থেমে গেলেন তিনি—বরং আরও নতুন নতুন ব্যবসার পথ আবিষ্কার করে ক্রমশ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকলেন, আর একে একে গড়ে তুললেন একুশটি প্রতিষ্ঠান। সেসব প্রতিষ্ঠানে এখন ৩৬টির বেশি পণ্য উৎপাদিত হয়। তিনি দেশের বেসরকারি ব্যাংকের প্রথম উদ্যোক্তাদের একজন। তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে বেসরকারি সিটি ব্যাংক। তিনি বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে ইনস্যুরেন্স ও মোবাইল টেলিকম ব্যবসার পথিকৃৎদের একজন। ঢাকা চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন তিনি। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন আলহাজ আনোয়ার হোসেন ফাউন্ডেশন, এনএইচএন ডায়াবেটিক সেন্টারসহ বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আনোয়ার গ্রুপ শাখা বিস্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালি, দুবাই, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, লাইবেরিয়া, মিয়ানমার, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সফল রাজনীতিক। ১৯৮৮-৯০ সালে ঢাকা-৮ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন। আনোয়ার হোসেন বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ খুব দ্রুতই শিল্পভিত্তিক দেশে পরিণত হবে। এ জন্য তিনি শিল্পায়নে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন।

শিল্পায়নের জন্য ২০১১ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড (ডিএইচএল-দ্য ডেইলি স্টার) ও মওলানা ভাসানী জাতীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার। একজন সুযোগ্য পিতাও তিনি। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলেও সন্তানদের করেছেন সুশিক্ষিত। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় একটি উক্তি হচ্ছে—‘অসত্যের কাছে নত নাহি করি শীর/ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর।’ আনোয়ার হোসেনের সমগ্র জীবন অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি সারা জীবন বীরের মতোই লড়াই করেছেন।

ভিডিও ডকুমেন্টারিতে দেখা গেল, তাঁর স্ত্রী মোছাম্মাৎ বিবি আমেনা বলছেন, ‘আনোয়ার হোসেন ছিলেন অসম্ভব কর্মঠ একজন মানুষ। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বলতেন, চলো তো, ফ্যাক্টরিটা একটু দেখে আসি। কোনো সমস্যা হলো কি না। তখন তার সাথে আনোয়ার সিল্ক মিলের কারখানায় চলে যেতাম।’



ব্যবসার শুরুর দিকের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বিবি আমেনা। অশ্রুসজল চোখে বলেন, একবার বাড়িতে অনেক শাড়ি আনলেন। আমি কি মনে করে একটা শাড়ির নিচে পাড়ের সঙ্গে ঝালর লাগিয়ে দিলাম। তিনি দেখে খুব পছন্দ করলেন। বললেন, এভাবে সব শাড়িতে করো। আমি তখন মহল্লার মহিলাদেরকে নিয়ে এই কাজ করতে লাগলাম। তিনি আমাদেরকে চার আনা করে পারিশ্রমিক দিতেন।

ডকুমেন্টারিতে বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন মেয়ে সেলিনা তারেক। তিনি বলেন, আব্বা সব সময় বলতেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব কাজ করতে হবে। কোনো কাজকে ছোট মনে করা ঠিক না। সাহস নিয়ে, প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হবে। বাবার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আব্বার ইচ্ছা ছিল তার সন্তানরা যেন সাফল্যের দিক থেকে তাকেও ছাড়িয়ে যায়। আমরা ভাই-বোনরা আব্বার এই স্বপ্ন পূরণ করতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’

Noor E Alam:
সুশিক্ষিত সন্তানরা, স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানে। বিরাশি বছর বয়সী এ কিংবদন্তী যেহেতু অসুস্থতাজনিত কারণে কথা বলতে পারছিলেন না, তাই তাঁর সুযোগ্য সন্তানরা শোনালেন বাবার কিংবদন্তী হয়ে ওঠার গল্প।

‘একজন মানুষ কতোটা উদার হলে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে পরিবারে রূপান্তরিত করা যায়, সেটা বাবাকে না দেখলে জানতাম না।’ এভাবেই কথা শুরু করেন জ্যেষ্ঠ পুত্র মানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাবার ব্যবসাজীবনের সফলতা ও নৈতিকতার কথা আপনারা অনেকেই জানেন। আমি শুধু বলতে চাই ব্যক্তি আনোয়ার হোসেনের কথা। বাবা বলতেন, আনোয়ার গ্রুপে নিম্নস্তরে যারা কাজ করছে তাদের ছেলে-মেয়েরা যেন পিতার মতো শ্রমিক হয়ে ফিরে না আসে। তাদের অবশ্যই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হতে হবে। এ জন্য তিনি তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। আনোয়ার গ্রুপের প্রতিটি মানুষকে তিনি পরিবারের সদস্য মনে করতেন বলেই এমন ভাবনা ভাবতে পারতেন।’ শিক্ষার প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগী ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তিনি সারা দেশে ৩৯৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহযোগিতা করেন। এখনো আনোয়ার গ্রুপের পক্ষ থেকে সেই সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান মনোয়ার হোসেন।

বাবা সম্পর্কে আরও অজানা কথা জানান মনোয়ার হোসেন। আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে তিনি বলেন, এক সময়ের অসম্ভব কর্মচঞ্চল মানুষ আজ অসুস্থতার কারণে বসে আছেন। তাঁকে বসিয়ে রেখে তাঁর সামনে তাঁর সম্পর্কে কথা বলা একইসঙ্গে কষ্টের এবং গৌরবের। তাঁর মতো একজন সৎ, নির্লোভ, পরিশ্রমী বাবার সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। অন্য সবার চেয়ে আনোয়ার হোসেন কেন ব্যতিক্রম, সেই কথা বলি। তিনি সবার কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনুসরণ করতেন। একবার খুঁজে খুঁজে বের করলেন, বোম্বে জুট মিলের মালিক কোন ফ্লাইটে কোথায় যান। তিনিও সেই ফ্লাইটের টিকিট কেটে তার পাশে বসলেন। তারপর পুরো যাত্রাপথে ব্যবসার নানা খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নিলেন।


আনোয়ার হোসেন ছিলেন অসম্ভব সময়ানুবর্তী। জীবনে কোনোদিন ৯টা পাঁচ মিনিটে অফিসে যাননি। নয়টা মানে নয়টা। আর তিনি ছিলেন প্রতিজ্ঞা পালনকারী। যখন যাকে যে কথা দিয়েছেন, সেই কথা রেখেছেন। কখনো কথার খেলাপ করেননি।’ বলছিলেন বড় ছেলে মনোয়ার হোসেন।

তিনি আরো বলেন, অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, বাবার ক্যাপিটাল কী ছিল? আমি বলি, বাবার সবচেয়ে বড় ক্যাপিটাল ছিল তার মায়ের দোয়া। তিনি তার মাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। তারপর সততা ও উদারতা ছিল তাঁর শক্তি।

এবার বাবার অসুস্থতা নিয়ে একটু বলি। বাবার ডিমেনসিয়া। এই রোগ হলে মানুষের বোধশক্তি ক্রমশ লোপ পায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২২ সালের মধ্যে ৭৫ বছর বয়সী পৃথিবীর ৭০ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে এই রোগের সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। যাইহোক, আমরা বিষয়টাকে মেনে নিয়েছি। আমরা মনে করি, সৃষ্টিকর্তা বাবাকে এই রোগ দিয়েছেন যাতে আমরা দেশের মানুষকে এই রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে পারি। আপনারা দোয়া রাখবেন। আমরা যেন এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পারি। কেউ যেন ডিমেনসিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই তা রুখে দিতে পারি।



বাবা সম্পর্কে কথা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে আনোয়ার হোসেন একটি কমন নাম। এই দেশে লাখ লাখ আনোয়ার হোসেন আছেন। কিন্তু আনোয়ার গ্রুপের আনোয়ার হোসেন একজনই। তিনি মানুষের মাঝে থাকতে পছন্দ করতেন, মানুষের উন্নতি দেখতে পছনন্দ করতেন।

দ্বিতীয় পুত্র হোসেন মেহমুদ শোনান বাবার এক উপদেশের কথা। ‘আমি পড়াশোনা শেষ করার পর বাবা আমাকে আনোয়ার টেক্সটাইল দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, মানুষের জীবনে শিক্ষার কোনো শেষ নেই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিখতে হবে।’বাবার সেই উপদেশ তিনি এখনো মেনে চলেন বলে জানান হোসেন মেহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমার পেশাজীবন শুরু হয়েছে নিজের প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে। কারণ বাবা চাইতেন, আমরা যেন তৃণমূল থেকে ব্যবসা শিখে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেই।’ এভাবেই একজন আনোয়ার হোসেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সন্তানদের দিয়েছেন প্রায়োগিক শিক্ষা।

কণিষ্ঠ পুত্র শোনান সবচেয়ে বেশি গল্প। তার নাম হোসেন খালেদ, ছিলেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। বাবাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বারবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে অশ্রু সংবরণ করে তিনি বলেন, বাবা সবসময় সততার ওপর গুরুত্ব দিতেন। আজকে কেউ বলতে পারবে না, তার কাছ থেকে কেউ একটি টাকা পাবে। তিনি বলতেন, মানুষকে না ঠকিয়েও জেতা যায়। আর বাবা চাইতেন ২০২০ সালের মধ্যে বিশ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করা। আমরা সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

বাবা কীভাবে হাতে কলমে শিক্ষা দিতেন, সেই গল্পও শোনালেন হোসেন খালেদ। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে একবার বাইরে রেস্টুরেন্ট খাওয়ার সুযোগ পেতাম আমরা। তার আগে অবশ্য একটা কাজ করতে হতো। আমাদের কোনো না কোনো ফ্যাক্টরি ঘুরে দেখতে হতো।’ এভাবেই সন্তানদের ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন আনোয়ার হোসেন।

হোসেন খালেদ আরো বলেন, ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া লেকচার সিরিজ একটি সময়পোযোগী অনুষ্ঠান। কারণ আমাদের বই পুস্তকের লেখাপড়ার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির একটা দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা মেতাবেক দক্ষ লোকবল আমাকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে পারছে না। ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমির এই দূরত্ব ঘোচাতে এই লেকচার সিরিজ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। আমাদের শুধু সাফল্যের গল্প শুনলেই চলবে না, ব্যর্থতার গল্পও শুনতে হবে। কারণ ব্যর্থতা থেকেই শেখা যায় সফল হওয়ার নিয়মকানুন। ভুল থেকে যদি না শিখতে পারি তাহলে একই ভুল বারবার হতে থাকে। এই কথাগুলো আসলে আব্বার কাছ থেকেই শেখা।


শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা উদ্যোক্তা হোন আর না হোন, ব্যবসা করেন আর না করেন, মনে রাখবেন, আপনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন সেখানকার নেতৃত্বদানকারী অবস্থানে যেতে চেষ্টা করবেন। আমার আব্বাকে দেখুন। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু তিনি স্বশিক্ষিত। সব জায়গা থেকে শিখেছেন। কখনো ভেঙে পড়েননি। কখনো পিছু হটেননি। আব্বার ছিল ফটোগ্রাফিক মেমরি। তিনি এখনো ক্যালকুলেটর ছাড়াই মুখে মুখে হিসাব করতে পারেন। আর আব্বা সব সময় সঙ্গে নোট রাখতেন। সারাদিন কী নোট করলেন তা বাসায় এসে স্টাডি করতেন। তো, আব্বা যদি পারেন, আপনারা কেন পারবেন না? তিনি যদি শূন্য থেকে এ পর্যায়ে আসতে পারেন; যার পুঁজি ছিল শুধু মেধা, যার পুঁজি ছিল ‍শুধু মায়ের দোয়া, তাহলে আপনারা কেন পারবেন না?

আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা শুরুর গল্পও শোনান হোসেন খালেদ। তিনি বলেন, আমার দাদির কাছে বেশকিছু রূপার মুদ্রা ছিল। আব্বা যখন ব্যবসা শুরু করতে চাইলেন তখন দাদি সেগুলো দিয়ে বললেন, শুরু করো। দাদির বিশ্বাস ছিল, তার ছেলে ব্যর্থ হবে না। তাই জীবনের শেষ সম্বল ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আর আজ আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, ছেলে তার মায়ের বিশ্বাস রেখেছে।



একটু আগে বলছিলাম, আব্বা ছিলেন স্বশিক্ষিত। শিক্ষার প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড অনুরাগ। তিনি আমাদেরকে বলতেন, আমি স্কুল কলেজে পড়তে পারিনি, কিন্তু তোমাদেরকে পড়তে হবে আমার জন্য। তারপর তিনি একাধিক স্কুল কলেজের সঙ্গে জড়িত। নানাভাবে সেসব স্কুল-কলেজকে সহযোগিতা করেন। কারণ একটাই, তিনি সমাজকে শিক্ষিত করতে চান। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চান। তার মতো যারা শিক্ষা নিতে পারেননি তাদেরকে সব সময় শিক্ষিত করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আনোয়ার হোসেন।

আমি আনোয়ার হোসেনের সন্তান—এটা শুধু গর্বেরই নয়; আরও একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে তার মতো নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন মানুষ পেয়েছি। তাকে আমি বাবা হিসেবে পেয়েছি, বন্ধু হিসেবে পেয়েছি, শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। এখনো প্রতিদিন তার কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখি। আমরা বই পুস্তকে পড়ি যে নেতারা জন্ম নেন, নেতারা সামনে থেকে ও পেছন থেকে নেতৃত্ব দেন। আমার আব্বা যেন এই সবকিছুর সমন্বয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে হবে, ব্যবসায়ী গড়ে তুলতে হবে এবং ব্যবসায়ী নেতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তিনি অসংখ্য ব্যবসায়ী তৈরি করেছেন। আমরা এখানে যারা ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি বসে আছি তারা প্রায় সবাই আব্বার হাতে তৈরি।

আমরা বলে থাকি যে সুযোগ বারবার আপনার দরজায় কড়া নাড়বে না। তাই সব সময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়। আব্বা আমাদের উপর আস্থা রেখে যে সুযোগ দিয়েছেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি তার আস্থার প্রতিদান দিতে।

আব্বার ব্যবসার কৌশল ছিল খুব সামান্য। তিনি বড় সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজে বের করতেন। সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, সেটা কত সহজে সমাধান করা যায় সেই পথ আব্বা আবিষ্কার করতেন। মালা শাড়ি কীভাবে এলো? আব্বা ভেবে দেখলেন, দেশে তখন প্রায় ৪২ শতাংশ নারী। এরা যে ধর্মেরই হোক না কেন, বিয়ে তো একবার হবেই। আর বিয়ের সময় শাড়ি লাগবেই। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বিয়ের শাড়ি তৈরি করবেন। যেন তেন সুতির শাড়ি নয়, বিয়ের শাড়ি। এরকম অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো তিনি খুব সাধারণ ভাবনা থেকেই বাজারে এনেছেন। সাবাই যা ভাবেন না, তিনি তা ভাবেন। সত্তরের দশকে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের কথা কেউ ভাবেইনি। তখন তিনি মালা শাড়ির মুভি অ্যাড বানিয়েছেন।

সফল মানুষদের অভ্যাস বা জীবনযাপন পদ্ধতি জানার জন্য আমরা অনেকেই ইন্টারনেটে সার্চ দেই। তো, আনোয়ার হোসেনের জীবনযাপন পদ্ধতি কেমন ছিল? তিনি তার মাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন, সন্তানদের স্নেহ করতেন, ব্যবসার কাজে যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন কখনো পরিবারকে ভুলে যেতেন না, নিয়মতান্ত্রিক খাবার খেতেন, প্রতিদিন হাঁটতেন, সঙ্গে নোট রাখতেন। আমাদেরকে বকা দিতেন, কেন নোট রাখি না। তিনি সব সময় নোট করতেন এবং কি কি অর্জন করলেন, কি কি পারলেন না সেটা শনাক্ত করতেন। আমাদেরকে সব সময় মনে করিয়ে দিতেন, আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রেখো না।

আব্বা গান শুনতে এবং গাইতে পছন্দ করতেন। বাংলা, হিন্দি, কাওয়ালী—সব ধরনের গান ‍শুনতেন। আমরা যখন পিকনিকে যেতাম বা বাসাতেও অাব্বা আমাদের সাথে খুব হাসি ঠাট্টা, মজা করতেন এবং গান গাইতেন।

আব্বার ব্যবসায়িক নৈতিকতা নিয়ে একটু বলি। তিনি সবসময় জেতার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কখনো ঠকানোর চেষ্টা করেননি। আমাদেরকে সবসময় বলতেন, কিনতে যদি না জেতো, বিক্রিতে কখনো জিততে পারবে না।

আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে অজানা কথা বলছেন তাঁর দুই কন্যা।

আরেকটা বিষয় আমার বড় ভাই ইতিমধ্যে বলে গেছেন, তবু বলি—আব্বা প্রচুর ভ্রমণ করতেন। তিনি বলতেন, তার ব্যবসার মার্কেট হচ্ছে তার দেশ। সুতরাং দেশের মার্কেট না চিনলে কিভাবে ব্যবসা করবেন? তো, বাবার সঙ্গে আমিও ঘুরে বেড়াতাম। আমি যখন এ লেভেলে পড়ি, তখন আমার গোটা দেশ দেখা শেষ।

অনুষ্ঠান শেষে আইন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ফারহানা মেহতাব হেলালের এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার হোসেনের দুই কন্যা বলেন, ছোটবেলা থেকে প্রতিটি কাজ আমরা আব্বার কাছ থেকে শিখেছি। যেমন পরের দিন অফিসে যাওয়ার জন্য যে শার্টটি পড়বেন সেটি আমাদেরকে দিতেন স্ত্রী করার জন্য। তারপর হাতে কলমে দেখিয়ে দিতেন কীভাবে স্ত্রী করতে হবে, কীভাবে কাপড় ভাঁজ দিতে হবে। কাজ শেষে আমারেকে সম্মানীও দিতেন। এভাবে আব্বা আমাদেরকে প্রতিটি কাজ নিজ হাতে শিখিয়েছেন।

আব্বা ছিলেন অসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ। প্রতিদিন অফিস থেকে এসে নিজের কাপড় নিজে গুছিয়ে রাখতেন। পরের দিন অফিসে কোন ড্রেস পড়ে যাবেন সেটাও রেডি করে রাখতেন। এখন তো অনেক লন্ড্রি হয়েছে। তো লন্ড্রি থেকে কাপড়টা যে প্যাকেটের মধ্যে দিত, আব্বা সেই প্যাকেটও ফেলতেন না। প্রতিটি প্যাকেট ভাঁজ করে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতেন। আব্বা গান শুনতেন, গান গাইতেও পছন্দ করতেন। ‘মেরা জীবন কোড়া কাগজ…’ অসম্ভব প্রিয় একটা গান তার।আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হোসেন মেহমুদের স্ত্রী বলেন, গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই আমি বউ হয়ে এ বাড়িতে আসি। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি আমার ছিল অসম্ভব আগ্রহ। সব সময় চাইতাম আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করব। আমার এই ইচ্ছার কথা শ্বশুরকে জানাই। তিনি বলেন, তোমার যতদিন পর্যন্ত পড়াশোনা করার ইচ্ছা ততদিন পর্যন্ত পড়বে। আমি একুশ বছর আগে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি। সেই থেকে এখনো পড়ালেখা করছি। মাস্টার্স শেষ করেছি অনেক আগেই। তবে এখনো আইবিএ থেকে বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্স করি। পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসাহ দিতেন। তিনি বলতেন, ‘বি অ্যা লাইফ লং স্টুডেন্ট।’ তিনি নিজে এই উক্তি মেনে চলেন এবং আমাদেরকেও মানতে উৎসাহিত করেন। কাজের ক্ষেত্রেও মেয়েদেরকে উৎসাহিত করতেন। তিনি সব সময় চাইতেন তার মেয়েরা ঘরে না থেকে কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ুক। আমি যখন অফিসে যোগ দেই, তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। প্রতিদিন খাবারের টেবিলে বসে জিজ্ঞাসা করতেন, আজ কী কী কাজ করেছ? তারপর কীভাবে কাজগুলো করলাম এবং কীভাবে আরও ভালো করতে পারতাম—সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতন। ২০০৩ সালে আমি আনোয়ার গ্রুপের টেক্সটাইলে যোগ দেই। তারপর মাঝে মাঝেই কারখানায় যেতে হতো। আমি কারখানায় গিয়ে মেয়েদের কাজ দেখতাম, তাদের সঙ্গে কাজ করতাম। এসব দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হতেন। সবমিলিয়ে বলব যে তিনি মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে, কাজের ক্ষেত্রে সব সময় উৎসাহ দিতেন। তাঁর কাছ থেকে আমি অনেক উৎসাহ পেয়েছি, পরামর্শ পেয়েছি। আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। পরিবার থেকে তিনি এতোটা সাপোর্ট না দিলে হয়ত এ পর্যায়ে আসা সম্ভব হতো না। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

Noor E Alam:
তাঁর আদর্শ অনুসরণের কথা বলেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালেয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খানও। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আনোয়ার হোসেন হচ্ছেন উদ্যোক্তাদের উদ্যোক্তা। তিনি তাঁর কর্মজীবনে অসংখ্য উদ্যোক্তা, ব্যবসায়িক নেতা, শিক্ষক—এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাতা পর্যন্ত তৈরি করেছেন। তাঁর কাছে বাংলাদেশের অনেক ঋণ রয়েছে। আজকের তরুণ শিক্ষার্থীদের উচিত এই সফল উদ্যোক্তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। তিনি বাংলাদেশের ব্যবসা জগতে পথিকৃতের মর্যাদায় থাকবেন। বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে এরকম শত শত আনোয়ার হোসেন তৈরি করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ড. মো. সবুর খান।


তিনি বলেন, এই লেকচার সিরিজের যাত্রা শুরু করার কথা ছিল আনোয়ার ভাইকে দিয়ে। কিন্তু নানা কারণে তখন সেটা সম্ভব হয়নি। যাইহোক, অবশেষে আজ সম্ভব হলো। এজন্য আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁর ছেলে মনোয়ার হোসেন, হোসেন মেহমুদ ও হোসেন খালেদকে। তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতা ও আগ্রহের কারণেরই এ রকম একটি অনুষ্ঠান করা সম্ভব হলো।
আমি শুধু বলতে চাই, আনোয়ার ভাই ও মাহবুব ভাই যেভাবে ডিসিসিআই গড়ে তুলেছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন সেটা ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমি এখানে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও আনোয়ার ভাইয়ের উত্তরসূরীদের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই, আনোয়ার ভাই ও মাহবুব ভাই অনেক বিষয় নিয়ে দ্বিমত করতেন। কিন্তু দিন শেষে তারা অত্যন্ত চমৎকারভাবে ঐক্যমতে পৌছতেন। বলতে দ্বিধা নেই, এই দুজন মানুষের কারণেই ঢাকা চেম্বার একটি উৎকৃষ্ট মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমি ছাত্র-ছাত্রীদের বলব, কিভাবে একসঙ্গে এক পরিবারের মতো কাজ করা যায় সেটা আনোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে শিখতে হবে। কিভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে হয় সেটা শিখতে হবে। আজ শুধু আনোয়ার ভাইয়ের সাথে সম্পর্কের কারণে ঢাকা চেম্বারের এতজন সাবেক প্রেসিডেন্ট হাজারো ব্যস্ততা ফেলে এখানে চলে এসেছেন। আমরা চাই, আনোয়ার ভাইয়ের উত্তরসূরী হিসেবে যারা কাজ করবেন, যারা ঢাকা চেম্বারে কাজ করবেন তারা যেন এই সম্পর্ক, এই শ্রদ্ধাবোধ ধরে রাখেন।   

Navigation

[0] Message Index

[#] Next page

Go to full version