রোকেয়া আফজাল রহমানের স্বপ্ন

Author Topic: রোকেয়া আফজাল রহমানের স্বপ্ন  (Read 985 times)

Offline Noor E Alam

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 94
  • Test
    • View Profile
তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’-রবীন্দ্রনাথের গানের এ উক্তি আর কারো জীবনের সঙ্গে মিলুক বা না মিলুক, রোকেয়া আফজাল রহমানের জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল ঠিকই।রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনকে সাঙ্গ করে যে বছর চলে যান, ঠিক সে বছরই জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া আফজাল রহমান, ১৯৪১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায়। তাঁর বাবা ব্যারিস্টার খোন্দকার আলী আফজাল ছিলেন বঙ্গীয় আইন পরিষদ বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লির সচিব। আর মা সাদিয়া আফজাল কোনো আনুষ্ঠানিক পেশায় না থাকলেও ছিলেন গভীর শিক্ষানুরাগী।

মিসেস রোকেয়া আফজাল রহমানের শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতার লরেটো কনভেন্ট স্কুলে। পরে করাচির সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট কলেজ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরপরই ১৯৬২ সালে তিনি করাচিতে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে যোগদান করেন। কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৪ সালেই তিনি ব্যাংকের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শাখার ব্যবস্থাপক নিযুক্ত হন। লক্ষণীয় যে, ১৯৬২ সালে ব্যাংকিংয়ের মতো পেশায় মেয়েদের যোগদানই যেখানে ব্যাতিক্রমী ঘটনা, সেখানে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হিসেবে।



ব্যাংকিং জীবনের অভিজ্ঞতাকে পটভূমিতে রেখে ১৯৮০ সালে নিজস্ব উদ্যোগ ও মালিকানায় বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ঋণে মুন্সিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আর আর কোল্ড স্টোরেজ’। ১৯৯৭ সালে এ তালিকায় যুক্ত হয় অন্যের কাছ থেকে কিনে নেয়া আরো একটি কোল্ড স্টোরেজ। কোল্ড স্টোরেজ চালাবার ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা একদিকে যেমন পরম আনন্দ ও পরিতৃপ্তির, অন্যদিকে তেমনি কিছু কিছু দুষ্টু সামাজিক ক্ষত দ্বারা তাড়িত পীড়নেরও। আনন্দ ও পরিতৃপ্তি এ কারণে যে এ কোল্ড স্টোরেজ দ্বারা প্রায় ১৫ হাজার চাষী সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন এবং ব্যবসায়ের উন্নত নীতি নৈতিকতা মেনে এগুলো পরিচালিত হবার কারণে সংশ্লিষ্ট চাষীরা এর দালিলিক মালিকানার অংশীদার না হয়েও একে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলেই মনে করেন। আর তিনিও একে শুধু আলু সংরক্ষণ ও বেচাকেনার প্রতিষ্ঠান না ভেবে একে চাষীদের ভবিষ্যৎ চাষ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাড়তি মুনাফা অর্জনের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আর সে কারণেই এ দু’ প্রতিষ্ঠানের ঢাকাস্থ অফিসে বসে কাজ করার চেয়ে নিয়মিত মুন্সিগঞ্জের কারখানায় গিয়ে কর্মী ও চাষীদের সাথে মিলে কাজ করতে অধিকতর আগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। আর কষ্ট ও পীড়নের বিষয় এই যে, এ কারখানা চালাতে গিয়ে তাকে অত্যন্ত শক্ত হাতে ও সাহসিকতার সাথে চরম ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয় চাদাবাজ ও মাস্তানদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।

স্বনামধন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাইডাসের একেবারে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি এর কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছেন এবং সে যুক্ততার ধারাবাহিকতাতেই সংশ্লিষ্টদের সাথে মিলে পরবর্তীতে তিনি গড়ে তোলেন মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড। আর তিনিই বস্তুতঃ সেখানে মহিলা উদ্যোক্তাদের বিনা বন্ধকীতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণদান, তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য ‘মিনি মার্ট’ নামক স্বতন্ত্র দোকান, উইমেন টু উইমেন সাপোর্ট পোগ্রাম ইত্যাদি চালু করেন।

১৯৭৪ সালে মহিলা উদ্যোক্তা সমিতি বা উইমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন। ২০০৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ মহিলা উদ্যোক্তা ফেডারেশন বা বিএফডব্লিউই; সারাদেশে যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ।

ব্যাংকিং ছেড়ে নিজেকে ব্যাসায় যুক্ত করলেও শুধু মুনাফা অর্জন কখনোই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল না। বরং স্বপ্নের পরিধিতে সবচেয়ে বেশি জাজ্বল্যমান হয়ে আছে এ দেশের নারীদের মধ্যে একটি নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে তোলা, প্রকারান্তরে যা তাদেরকে সচ্ছল, সাবলম্বী ও বর্ধিত সামাজিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।আর এরূপ স্বপ্ন দেখেন বলেই তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে একজন দুস্থ নারী যখন জানান যে ঋণ নিয়ে কাজে লাগাবেন এমন কোনো কাজই তার জানা নেই-রোকেয়া আফজাল তখন মমতাপূর্ণ ধমকের সুরে তাকে বলেন যে, এটা হতেই পারে না। নিরুপায় নারী তখন জানান যে, তিনি শুধু রাধতে জানেন। পরে সাব্যাস্ত হলো যে, তাকে রান্নার জন্যই ঋণ দেয়া হবে এবং তাই হলো। তাকে ঋণ দেয়া হলো পিঠা তৈরির জন্য এবং সে পিঠা বেচে এখন তিনি স্বাবলম্বীই নন-একজন প্রতিশ্রুতিশীল নারী উদ্যোক্তাও বটে।

প্রসঙ্গত তাই বলা প্রয়োজন যে, সামর্থ বা সম্ভাবনার অভাব নয়-সামর্থ ও সম্ভাবনার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাবই বাংলাদেশে উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয় বড় বাধা; যে বাধা সামাজিক সংস্কার ও মূল্যবোধের কারণে আরো বেশি করে প্রযোজ্য।

বাংলাদেশের নারীদের সৃজনশীল চিন্তা ভাবনার ব্যাপারে রোকেয়া আফজাল রহমান শুধু আশাবাদীই নন-রীতিমতো মুগ্ধও। আর সে মুগ্ধতার বোধ থেকেই জানালেন কুড়িগ্রামের এক সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তার কথা যিনি তার ঘরের জানালায় বাইরের দিকে মুখ করে একটি টেলিভিশন সেট বসিয়ে দিয়ে সূর্যাস্তের পর থেকে রাত ১২টা অব্দি পালা করে ভারতীয় চ্যানেলের জনপ্রিয় ধারাবাহিকগুলো দর্শককে বিনা পয়সায় দেখাচ্ছেন। আর প্রত্যন্ত গ্রামের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষরা সারাদিনের খাটা খাটুনির পর বিনোদন লাভের এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন? না, তারা তা করছেনও না। বরং সারি বেঁধে সেখানে জড়ো হচ্ছেন। আর সেই সুযোগে ওই নারী উদ্যোক্তা জড়ো হওয়া দর্শকদের কাছে প্রতিদিন চা-পুরি ইত্যাদি বিক্রি করে যা আয় করছেন তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়।

রোকেয়া আফজাল রহমানের কর্মময় জীবন এমনই আরো নানা স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতায় ভরা যেখানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরাও বাদ পড়েননি। তিনি প্রতিশ্রুত যে, তাঁর সুবিধামতো সময়ে তিনি এখানকার নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছু কিছু নারী উদ্যোক্তার বাড়ি ও কারখানায় যাবেন।


রোকেয়া আফজাল রহমান খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন যে, অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো ব্যাক্তির সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ও করছেন। মিয়ানমারের নেত্রী অংসাং সুচির সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিশনে একসঙ্গে কাজ করেছেন, যদিচ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির বর্তমান ভূমিকায় তিনি খুবই অসন্তুষ্ট।

নিজের কর্ম ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ রোকেয়া আফজাল রহমান দেশে-বিদেশে বহু পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন যার মধ্যে লিডিং উইমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড, মন্টে কার্লো ১৯৯৯, আমেরিকান চেম্বারের বিসনেস পার্সন অব দি ইয়ার ২০০৩ ইত্যাদি অন্যতম। তিনি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক, ডেইলি স্টার ও দৈনিক প্রথম আলোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকাকালে একই সঙ্গে তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভাবেন বা কতটা আশাবাদী-এ প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর-‘তিন সন্তানের সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর বিদেশে থেকে গিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের সব ধরনের সুযোগ ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সবাই দেশে ফিরে যার যার ক্ষেত্রে অবদান রাখার চেষ্টা করছেন। আমি ব্যাপারে আমি তাদের উৎসাহিত করেছি। দেশের সম্পর্কে আশাবাদী না হলে আমি কি এটা করতাম?’

লেখক: প্রকল্প পরিচালক, ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (আইআইসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
Noor E Alam
Assistant Officer (Legal & Estate) 
Daffodil International University (DIU)
email- le@daffodilvarsity.edu.bd