যুুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ: নতুন বছরে কী ঘটবে?

Author Topic: যুুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ: নতুন বছরে কী ঘটবে?  (Read 1312 times)

Offline alsafayat

  • Newbie
  • *
  • Posts: 22
  • Seeker of the Unknown
    • View Profile
    • Al Safayat
বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সদ্যসমাপ্ত ২০১৮ সালে সংঘটিত ও বহুল আলোচিত বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে অন্যতম ছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ। অথচ বছরের গোড়ার দিকে কিন্তু চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের তেমন কোনো উত্তেজনাই লক্ষ করা যায়নি; বরং সাম্প্রতিক অন্যান্য বছরের তুলনায় গত বছরের গোড়ার দিকে এ সম্পর্ক ছিল অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। মনে হচ্ছিল, পরিস্থিতি বোধহয় কিছুটা ভালোর দিকেই যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই আগস্টে (২০১৮) এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত চীনা পণ্যের ওপর বর্ধিত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে বসেন। স্বভাবতই পাল্টা ঘোষণায় চীনও তার দেশে মার্কিন পণ্য প্রবেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে। পরবর্তীতে আরো দুই দফায় উভয় দেশ এ শুল্কহার বৃদ্ধি করে এবং দুই পক্ষের এ পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা গ্রহণ ও রেষারেষির মধ্য দিয়ে ২০১৮ সাল সমাপ্ত হয়। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত তার টেলিফোন আলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর এক টুইটবার্তায় জানান, তাদের দুজনের মধ্যে ‘ভালো ও দীর্ঘ আলাপ’ হয়েছে এবং তিনি এটিকে ‘বড় ধরনের অগ্রগতি’ বলে উল্লেখ করেন। বাণিজ্য বিরোধ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

প্রথমত, যেকোনো নতুন বছরের শুরুতে ভালো কথা বলার রেওয়াজ পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো পশ্চিম মহাদেশীয় দেশগুলোয় এ প্রচলন আরো অধিক শক্তিশালী। ফলে নতুন বছরের প্রাক্কালে ক্রিসমাসে বা ক্রিসমাসের অব্যবহিত পরের দিনগুলোয় শুভেচ্ছামূলক ভালো কথা বলে জনগণের প্রীতি অর্জনের চেষ্টার অংশ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এমনটি বলতেই পারেন। আবার এমনও হতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও চাপে থাকা অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও গতিশীল করার চেষ্টায় চীনের সঙ্গে সমঝোতামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি চীনের প্রেসিডেন্টকে ফোন করেছিলেন। তবে কারণ যা-ই হোক, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিষয়টি খানিকটা হলেও স্বস্তিদায়ক। আর ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ও পরে বণিক বার্তায় পুনর্মুদ্রিত (১ জানুয়ারি ২০১৯) এক নিবন্ধে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক প্যানোস মুরদোকুতাস অভিমত ব্যক্ত করেন, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ আর না-ও বাড়তে পারে। তবে বিষয়টিকে এতটা সরলভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আর কেন এ আশঙ্কা, তা নিয়েই নিবন্ধে খানিকটা আলোকপাত করা হলো।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধের ঘটনাটি চরিত্রগতভাবে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ইস্যু। কিন্তু এর উৎসমূলে যতটা না রয়েছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণ, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশলগত ভূমিকা। চীনের সীমান্তসংলগ্ন দেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন যে বিরোধ, যা একবার যুদ্ধেও রূপান্তর হয়েছিল এবং যে ধারায় কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চল এখনো মাঝে মাঝেই উত্তেজনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সাম্প্রতিক সময়ে সেটিই আসলে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধের মূল অনুঘটক। অবশ্য বৈশ্বিক কূটনীতির অন্যান্য হিসাবনিকাশও রয়েছে! উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্তকরণে বাধ্য করার লক্ষ্যে দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় চীন যাতে তাদের পক্ষে থাকে বা নিদেনপক্ষে বিপক্ষে যেতে না পারে, সেটাই এ মুহূর্তে চীনকে ঘিরে মার্কিন কূটনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার বলে মনে হচ্ছে।

আর এ রকম অবস্থাকে সামনে রেখেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে গত জুনে (২০১৮) সিঙ্গাপুরে তার সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য করেছিলেন। আর সে বৈঠক আয়োজনের নেপথ্যে চীনেরও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল অনেকখানি। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উত্তর কোরিয়া কর্তৃক সমুদয় পারমাণবিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম ধ্বংস করার বিনিময়ে দেশটিতে বিরাজমান মানবিক বিপর্যয় রোধকল্পে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে সমুদয় বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা এবং কোরীয় উপদ্বীপ থেকে সমুদয় মার্কিন সামরিক স্থাপনা ও বাহিনী প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, পারমাণবিক অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও তা ধ্বংসের নাম করে যেমন বুশ কর্তৃক ইরাক আক্রমণ করা হয়েছিল, তেমনি এখন আর গুরুতর তেমন কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম উভয় কোরিয়ার কাছে না থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা উভয় কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পীড়ন, নিগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে। এবং সে নিষেধাজ্ঞা ও নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাবে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট তার অসহায় সম্মতিতে গত জুনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলোও বস্তুত হোয়াইট হাউজ থেকে প্রণয়ন করা হয়েছিল বলেই ব্যাপকভাবে মনে করা হয়। কিন্তু তার পরও ওই চুক্তি অনুযায়ী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আংশিক প্রত্যাহার এবং ক্রমান্বয়ে কোরিয়া সন্নিহিত সমুদ্রাঞ্চল থেকে মার্কিন সামরিক স্থাপনা ও সৈন্য সরিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও ট্রাম্প প্রশাসন তার ধার-কাছ দিয়েও হাঁটেনি। আর এ অবস্থায় চীন যাতে কোনোরূপ প্রতিবাদ করতে উদ্যোগী না হয়, সেজন্যই কি মার্কিন প্রশাসন চীনকে চাপে রাখার জন্য আগস্টে হুট করেই চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে বসে?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক নির্লিপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়াও এখন অনেকটা হতাশ হয়ে ওই চুক্তি থেকে সরে আসার কথা ভাবছে (অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ক্রমাগত বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে নিঃস্ব হতে হতে এখন আর উত্তর কোরিয়ার চুক্তি থেকে সরে আসা বা না-আসার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।) এ অবস্থায় চীন যাতে উত্তর কোরিয়ার প্রতি আবার সহানুভূতিশীল না হয়ে পড়ে, বোধকরি সে কথা ভেবেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন আবার কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করেছে। বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প যেদিন (২৯ ডিসেম্বর ২০১৮) তার টুইটবার্তায় শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ‘ভালো’ আলোচনা হয়েছে বলে জানালেন, মার্কিন প্রশাসন বস্তুত সেদিনই এক হাজারের বেশি চীনা পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। আর সে ঘোষণাকে ভিত্তি ধরেই প্যানোস মুবদোকুতাস হয়তো আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, ২০১৯ সালে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধ আর তীব্র আকার ধারণ করবে না। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? গত সোয়া শতাব্দীর বিশ্বকূটনীতির ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে কোথাও কি পাওয়া যাবে যে কোনোরূপ যুক্তি ও নৈতিকতা মেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বসম্পর্ক নির্ধারণ করেছে? ফলে ২০১৮ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্র আংশিক চীনা পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দিল, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ তা ঘোষণার অনুরূপ আঙ্গিকে টিকে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবেন না।

আগামী বছরই (২০২০ সালে) মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে বরাবর যা ঘটে তা হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রত্যেকেই ভোটারদের আবেগ ও অহংকে উসকে দেয়ার লক্ষ্যে উগ্র রাষ্ট্রাভিমানকে (অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রই শ্রেষ্ঠ) উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন। আর তা করার জন্য নির্বাচিত হলে বিরোধী পক্ষ উল্লিখিত রাষ্ট্রাভিমানের পক্ষে কী কী করবে, সে বিষয়ে যেমন অঙ্গীকার করবে, তেমনি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকেও (প্রার্থী তিনি নিজে হন বা দলের অন্য কেউ হোক) প্রমাণ করতে হবে যে অন্য দেশ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে তার আচরণ যথেষ্টই যুদ্ধংদেহী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। আর তা করতে গিয়ে ২০১৯ সাল শেষ হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি চীনের সঙ্গে আরো বড় বাণিজ্যযুদ্ধ বাধিয়ে বসেন, তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ফলে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ঘোষণায় এটি ভেবে স্বস্তি বোধ করার কোনোই কারণ নেই যে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধ স্তিমিত হয়ে আসছে। ফোর্বস প্রতিবেদনের সঙ্গে এ সহমত অবশ্যই থাকল যে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধের চেয়েও অন্য আরো অনেক সমস্যাই ২০১৯ সালের বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। আর সে ব্যাপারে সব দেশেরই বিশেষত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এখন থেকেই যথেষ্ট সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকতে হবে বৈকি!

তবে প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত বিকাশমান চীনের প্রতি আহ্বান থাকবে, ক্রমাগত স্বেচ্ছাচারিতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজমান এবং তার বিপরীতে চীনকে বিশ্ব অর্থনীতির নিকট ভবিষ্যতের অন্যতম বিকল্প হিসেবে দেখার যে প্রচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষা দিন দিন জোরদার হচ্ছে, তারা যেন তা উপলব্ধি করতে পারে। আর তা করতে পারলে সেটি চীনের অবস্থানকেই শুধু শক্তিশালী ও মর্যাদাবান করে তুলবে না, বিশ্ব অর্থনীতি ও কূটনীতির একটি ভারসাম্যপূর্ণ যৌক্তিক বিকল্পও তৈরি হবে। এখানে নতুন কোনো পরাশক্তি গড়ে তোলার প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে না; বরং এ উপলব্ধিকেই উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, বিশ্বসম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে চরম বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা ও একচ্ছত্র মেরুকরণ চলছে, তা থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার জন্য হলেও বিশ্বব্যাপী চীনা বাণিজ্য ও অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য বিকাশ ও সম্প্রসারণ প্রয়োজন এবং তা প্রয়োজন বাংলাদেশের মতো দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর নতুন মিত্রবলয় গড়ে তোলার প্রয়োজনেও।


লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com



 Source: http://epaper.bonikbarta.net/1970637/Bonik-Barta/Bonik-Barta#clip/35570706/2ca6dbd5-0db7-4b1d-8362-58cadd622215/1573.3333333333333:826.5585774058577
Al Safayat
Administrative Officer, CDC, DIU
Cell: +8801991195579
www.safayat.info